POST EDITORIAL

সিকিমে বিপর্যয় অনেক প্রশ্ন সামনে এনেছে

জাতীয় উত্তর সম্পাদকীয়​

 অর্ণব রায়
 

অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে পর্যটকদের কাছে সিকিম এখন যথেষ্ট পরিচিত। সাম্প্রতিক সিকিমের তিস্তায় আকস্মিক বন্যা অনেককেই বিচলিত করেছে। পাহাড়ি অঞ্চলে ধসের সঙ্গে আমরা পরিচিত। ভূতাত্ত্বিক গঠন অনুযায়ী নব্য হিমালয়ের শরীরে সিকিমের অবস্থান। তাই নিয়মিত, বিশেষত বর্ষার পর এইসময়ে, সেখানে ছোট বড় ধস হয়, স্থানীয় মানুষ অসুবিধায় পড়েন, পর্যটকরা আটকে পড়েন- এসব পরিচিত ঘটনা। কিন্তু ৩অক্টোবর মধ্যরাতে হঠাৎ পাহাড়ি তিস্তা নদীতে প্রবল তীব্রগতির ফ্ল্যাশফ্লাড ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সিকিমের মঙ্গন, প্যাকিয়ং, নামচি, গ্যাংটক জেলার বহু বাড়িঘর, সেনাবাহিনী ক্যাম্পের গাড়ি , অস্ত্র, সেনা এবং স্থানীয় মানুষদেরকে; ভেঙেছে রাস্তা, বাঁধ, সেতু, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ইত্যাদি। এখনো শতাধিক নিখোঁজ। বহু লাশ তিস্তার নিম্ন অববাহিকা হয়ে ভেসে চলে গেছে। সিকিমের  রংপো পাহাড়ি উপত্যকায় এক গৃহস্থের ঘরে জল ঢুকে তাঁর তিন সন্তানকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সেনাক্যাম্পের ভেসে আসা মর্টার বিস্ফোরণে জলপাইগুড়ি জেলার ক্রান্তিতে এক বালকের মৃত্যু হয়েছে। পুরো ক্ষয়ক্ষতির হিসাব বুঝতে আরো সময় লাগবে। ভূস্তরের এত ঢালযুক্ত এলাকায় বন্যা সাধারণত হয় না। কিন্তু এই ঢালের কারণেই জলরাশি, তার সঙ্গে কাদামাটি, বড় ও ছোট পাথর, বালি, গাছের ছিন্ন শাখা, কিছু আবর্জনার প্রবল বেগে নেমে এসে ধ্বংস ও ক্ষয়ক্ষতি করেছে অনেক বেশি। সিকিমের নিম্ন উপত্যকায়, স্থানীয় "ওয়াটারগেজ" -এর রেকর্ড অনুযায়ী,  কেন্দ্রীয় জল কমিশন জানিয়েছে সিকিমের  সাঙকালাঙে রাত দেড়টার পর জলরাশির উচ্চতা ৬০ ফুট অবধি অতিক্রম করেছে, ঘন্টায় ৫৫ কিলোমিটার গতি নিয়ে। নিচে নেমে জলপাইগুড়িতে তিস্তার জল বিপদসীমা ছুঁয়ে ফেলছিল। আরেকটু বেশি হলেই ডুযার্সও অনেকটা ভাসত।


সিকিমে এই আকস্মিক বিপর্যয়ের প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথমে মনে করা হয়েছিল "ক্লাউডবার্স্ট" বা মেঘভাঙা বৃষ্টিই এই বিপর্যয়ের কারণ। এই ধরনের বৃষ্টি সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। ক্লাউডবার্স্টে স্বল্প সময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় ,  ২০- ৩০ কিলোমিটার এলাকায় ১০০ মিলিমিটার/ প্রতি ঘন্টা হারের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হলে ক্লাউডবার্স্ট বলা হয়। এত উঁচু এলাকায় বৃষ্টিমাপক যন্ত্র স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রায় অসম্ভব, বসালেও বরফ আচ্ছাদনে তা কার্যকরী থাকা কঠিন। তাই বৃষ্টির সঠিক পরিমাণ বোঝাও দুস্কর। শুধু স্যাটেলাইট রিমোট সেন্সিং চিত্রের মাধ্যমে যেটুকু বোঝা যায়। সম্প্রতি সিকিমে তিস্তার অত্যুচ্চ অববাহিকায় ‘ক্লাউডবার্স্ট’ কিছু হলেও দীর্ঘ সময় ধরে এত বিপুল পরিমাণ জলরাশি বয়ে নিয়ে আসা দেখে অন্য কারণের সম্ভাবনা পর্যবেক্ষণের মধ্যে আসে। দক্ষিণ লোহনাক হিমবাহের স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর গলনের কারণে, যাকে হিমবাহ বিস্ফোরণও বলা হচ্ছে ,  ১৭১০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত লোহনাক হ্রদে প্রবল জলস্ফীতি হয়েছে।‌  এই ধরনের হিমবাহ বিস্ফোরণকে বলা হয় ‘‘গ্লেসিয়ার লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড’’, সংক্ষেপে ‘জিএলওএফ’। বিগত কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ লোহনাক হিমবাহ গলনের বৃদ্ধি ও হ্রদে জলস্ফীতি নজরে আসছিল। লোহনাক ও আরো কিছু হিমবাহ দ্রুততার সঙ্গে গলে যাচ্ছে, এই সতর্কতা বিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদরা করেছিলেন। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর স্যাটেলাইট রিমোট সেন্সিং পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সিকিমে এখন ৩২০টিরও বেশি হিমবাহ হ্রদ রয়েছে বলে জানা গেছে। হ্রদগুলি যদি সবসময় বরফাবৃত থাকে তাতে অসুবিধা হল, হিমবাহের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল বোঝা যায়, কিন্তু হিমবাহ ও লেকের অন্তর্লীন গভীরতা বোঝা যায় না, ফলে বরফ গলনের আয়তন ও সম্ভাব্য জলস্ফীতির আয়তন আগাম অনুমান করা মুশকিল হয়। উত্তর সিকিমের লোহনাক হ্রদের কাছেই ১৭৮০০ ফুট উচ্চতায় গুরুদঙমার হ্রদ, চারদিকে হলুদ বালিয়াড়ির শীতল মরুভূমির মধ্যে এমনই একটি হিমবাহ লেক যা এখন অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ, যদিও সেখানেও অক্সিজেনের প্রবল সমস্যা রয়েছে। এখানেও এই দুর্যোগ হতে পারে যে কোনও দিন। ২০১৩ সালে কেদারনাথে এবং ১৯৮১ সালে হিমাচল প্রদেশের কিন্নর উপত্যকায় ফ্ল্যাশফ্লাড ‘জিএলওএফে’র কারণেই ঘটেছে বলে বিখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকা জানিয়েছিল।‌ 


মাঝারি থেকে বড় ভূমিকম্পও হিমবাহ গলনের একটা কারণ- ৩অক্টোবর মৃদু ভূমিকম্প নেপালে হয়েছিল, তবে কোনও বড় ধরনের ভূমিকম্প উত্তর সিকিমের এসব অঞ্চলে নজরে আসেনি। তা লোহনাক ঘটনার শুরু করতে পারে, যদিও দুর্গমতার কারণে ঐ এলাকার ফিল্ড-ডেটা যোগাড় করা মুশকিল। তবে, মূল কারণ জিএলওএফ বলেই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।‌ জলবায়ু পরিবর্তন তথা বিশ্ব উষ্ণায়ন হিমবাহ গলনের একটা বড় কারণ এবং বিজ্ঞানী- প্রযুক্তিবিদদের অভিমত হল , এখন এই কারণেই হিমবাহ গলন অনেক বেড়ে গেছে।  ফলে, হিমবাহ থেকে এবং হিমবাহর সামনে, নিচে, ওপরে নতুন নতুন হিমবাহ হ্রদ সৃষ্টি হচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব তিব্বতে ১৯৭০ থেকে ২০০৯-এর মধ্যে হিমবাহ হ্রদের সংখ্যা ৯৬ থেকে বেড়ে ১২৩ হয়েছে।‌ সিকিমে দক্ষিণ লোহনাক হিমবাহটি ১৯৬২ থেকে ২০০৮-এর মধ্যে গলনের কারণে ২ কিলোমিটার সরে গেছে, ২০০৮ থেকে ২০০৯ এর মধ্যে ৪০০ মিটার সরে গেছে। হিমবাহ গলে গিয়ে সরে যাওয়ার পরিণামে তার ফেলে আসা পাথর, মাটি প্রভৃতি নিয়ে প্রাকৃতিকভাবে ঘেরা বড় বড় হ্রদ সৃষ্টি হচ্ছে। ১৯৮৯-এ প্রাথমিক আকার থেকে লোহনাক ১.৫ গুণ এবং দক্ষিণ লোহনাক আড়াই গুণ বেড়ে গেছে বলে মার্কিন ভূতত্ত্ব সার্ভের স্যাটেলাইট আগেই জানিয়েছিল। ২৮/৯/২৩ ও‌ ৪/২০/২৩ এর পরবর্তী স্যাটেলাইট-ডেটা তুলনা করে ইসরো জানিয়েছে , সেদিন ১বর্গ কিলোমিটার লেক লোহনাক থেকে নেমে এসে তিস্তায় নেমেছে, সঙ্গে তিস্তার উচ্চ-মধ্য অববাহিকায় বৃষ্টিও হয়েছে।‌ যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার টেরা কৃত্রিম উপগ্রহের ছবি বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখেছেন, ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বিশ্বের হিমবাহগুলি গড়ে প্রতিবছর ২৬৭ বিলিয়ন টন বরফ হারিয়েছে। এসবের ফলে সমুদ্রের, নদীর জলের উচ্চতা বেড়ে উপকূল অঞ্চলকে আরো বিপন্ন করতে পারে, পাহাড়েও যে তা বিপদ সৃষ্টি করছে, সাম্প্রতিক সিকিম তার উদাহরণ। ২০০০ সালে তিব্বত মালভূমিতে জিএলওএফের ফলে ফ্ল্যাশফ্লাডে ১০ হাজার বাড়ি এবং ৯৮টি সেতু ধ্বংস হয়েছিল। ২০০৮ সালে কারাকোরাম হিমালয়ে গালকিন গ্লেসিয়ারে একই কারণে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভুটান, নেপালের  হিমবাহ হ্রদগুলি নিয়ে কিছুদিন হল  রিমোট সেন্সিং পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। সিকিম হিমালয়ে শাকু চু এবং এভারেস্ট অঞ্চলে ইমজা হিমবাহ হ্রদে জিএলওওফ-এর আশঙ্কা বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে বলে স্যাটেলাইট- ডেটা থেকে অনুমান করা হয়েছে। সিকিমে দশটি জিএলওএফ-এর আশঙ্কা যথেষ্ট বলে জানা গেছে স্যাটেলাইট চিত্র থেকে। বিশ্ব উষ্ণায়ন না কমাতে পারলে এসব সমস্যা বাড়তেই থাকবে। এসব সতর্কতা নিয়ে ভাবা হয়নি। সিকিম সরকার শুধু সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চুংথাং জলবিদ্যুৎ এলাকা সহ কিছু জায়গায় বাড়তি জল বের করার জন্য ৮ ইঞ্চি ব্যাসের ১৪০ মিটার হাইডেনসিটি পলিইথিলিন পাইপ বসিয়েছিল- বিপুল জলরাশির আঘাতে সেসব চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে।


আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তিস্তাতে এত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করার পরিকল্পনা।‌ পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজন আছে। পর্যটন এসব অঞ্চলে প্রধান জীবিকা। তাছাড়া এসব অঞ্চলে  দৈনন্দিন জীবনযাত্রা যথেষ্ট কঠিন। তাই পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজে একবগ্গা বিরোধিতা কোন কাজের কথা নয়।  সাধারণ ভাবে এগুলি বাঁধ বলা হলেও , ব্যারেজ বা ড্যাম বলতে যা বোঝায় এগুলি তা নয়। এগুলি হল উইয়ার। ছোট বাঁধ বা বেড়া ধরনের বলা যায়। ড্যাম বা ব্যারেজ এসব এলাকায় করা সম্ভব নয় ভূতাত্ত্বিক কারণে। উইয়ার করে জলরাশিকে একটি নির্দিষ্ট দিকে জড়ো করে তার ঢালের গতি দিয়ে টারবাইন চালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। কিন্তু তিস্তার পূর্ব হিমালয়ের পৌহানরী পর্বতের হিমবাহ থেকে শুরু হয়ে সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ , বাংলাদেশ হয়ে ব্রহ্মপুত্রে এবং শেষে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ৪১৪ কিলোমিটার প্রবাহতে বাঁধের সংখ্যা কত হতে পারে তার একটা সামগ্রিক বিজ্ঞানসম্মত পর্যালোচনা দরকার। হিমালয় বাস্তুতন্ত্র পৃথিবীর সবচেয়ে ভঙ্গুর। মনুষ্যসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন তাতে বড় প্রভাব ফেলছে।
কেউ কেউ প্রকৃতির কোনও রহস্যময়তা খুঁজেছেন এসবে - এসব বিজ্ঞানসম্মত নয়। দুর্যোগের বৈজ্ঞানিক কারণ জানতে হবে, সে অনুযায়ী যথাসাধ্য নিজেদের সংযত হতে হবে।‌ মানুষের অসতর্কতা, জীবনের প্রয়োজনে পরিকাঠামোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও মাত্রাহীন পরিবেশ- অসচেতনতা, সহনযোগ্য উন্নয়ন বা ‘সাসটেনেবল ডেভলপমেন্ট’ -এর প্রয়োজন মুনাফার লোভে বিস্মৃত হওয়া এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ইত্যাদি বিষয়ে সতর্কতা জরুরি। মানুষ প্রকৃতিরই অংশ, তবে প্রকৃতিকে সক্রিয় ও পরিবর্তনক্ষম অংশ। প্রকৃতির কিছু পরিবর্তন করতে করতেই সভ্যতা এগিয়েছে, কিন্তু সেকাজে সামগ্রিক মানবতার স্বার্থের বদলে এখনকার নিও- লিবারেল অর্থনীতির  মুনাফাকে একমাত্র অগ্রাধিকার দেওয়ার যে পথ নেওয়া হয়েছে এবং তাতে দ্রুতগতিতে বিশ্ব- উষ্ণায়নসহ বিবিধ পরিবেশ-বিপর্যয় ঘটছে, তাকে বন্ধ করতে হবে। নাহলে সমূহ বিপর্যয় সবার সামনে।

Comments :0

Login to leave a comment