পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আজ গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে চলছে এক জঘন্য পরিচয় সত্তা-ভিত্তিক ভোটের নিলাম, যেখানে মানুষ কেবলমাত্র ভোটের পণ্য। মতুয়া, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিশেষত মুসলমান ইত্যাদি সম্প্রদায়গুলির মানুষরা আজ আর স্বাধীন নাগরিক নয়; তাঁরা পরিণত হয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি এবং তৃণমূল কংগ্রেস উভয়ের হাতে ব্যবহৃত রাজনৈতিক খেলার ঘুঁটিতে। এই দলগুলির অ্যা জেন্ডায় এই সমাজের মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন বা সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার কোনও সদিচ্ছা নেই, আছে শুধু ভোটের স্বার্থে নির্মম ও সুবিধাবাদী বিভেদমূলক কৌশল।
মতুয়া সমাজ দেশভাগের শিকার হয়ে পূর্ব বাংলা থেকে আগত নমঃশূদ্র শরণার্থী এবং দীর্ঘদিন ধরে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ও সামাজিক মর্যাদার জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। এই সমাজের সবচেয়ে সংবেদনশীল ও মৌলিক সমস্যাটিকে বিজেপি এবং তৃণমূল উভয়ই চরম সুবিধাবাদী উপায়ে ব্যবহার করে আসছে। একসময় তৃণমূল কংগ্রেস এই সমাজের ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়িকে ব্যবহার করে আবেগের জাল বুনেছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত বীণাপাণি দেবী ('বড়মা')-কে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে, ঘন ঘন ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে মতুয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন। এই কৌশলটি ছিল অত্যন্ত চতুর এক আবেগ দিয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য নিশ্চিত করা। তৃণমূল সরকার কিছু ছোটখাট সুবিধা প্রদান করলেও, মতুয়াদের মূল দাবি, অর্থাৎ স্থায়ী ও সম্পূর্ণ নাগরিকত্বের প্রশ্নটি অত্যন্ত কৌশলে বারবার এড়িয়ে গেছে। তাদের প্রতি মমতার বার্তা ছিল, ‘আপনারা এখানকার ভোটার, সুতরাং নাগরিক।’ এর মাধ্যমে তৃণমূল মতুয়াদের নাগরিকত্বের দাবিকে ভোঁতা করে কেবল নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখতে চেয়েছে।
অন্যদিকে ২০১৯ সালের পর বিজেপি এই সমাজে প্রবেশ করে মতুয়াদের মনের মধ্যে থাকা গভীর আশঙ্কা ও দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষাকে একটি রাজনৈতিক অস্ত্রে পরিণত করে। বিজেপি লাগাতার প্রচার করে যে, তৃণমূলের আমলে পাওয়া নাগরিকত্ব স্থায়ী নয়, আপনারা কেবল 'বহিরাগত উদ্বাস্তু' এবং একমাত্র নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ’র মাধ্যমেই এই পরিচয় নিশ্চিত হতে পারে। আর এই নাগরিকত্ব দিতে পারে একমাত্র বিজেপি। তাই এসআইআর চলাকালীন সিএএ ফর্ম বিলির ক্যাম্পও তারা ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু করে। যদিও দিন সাতেকের মধ্যে সেসব ক্যাম্প গুটিয়ে গেছে। এই বার্তা মতুয়াদের মনে আরও গভীর এবং স্থায়ী অনিরাপত্তা ও আতঙ্কের বীজ পুঁতে দিয়েছে। বিজেপি নেতৃত্ব, বিশেষ করে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি শান্তনু ঠাকুর, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও এই আইন গত ছয় বছর ধরে কার্যকর বা তার বিধিমালা চূড়ান্ত করেননি। অর্থাৎ, তারা মতুয়াদের শুধু 'মিথ্যা আশা' দেখিয়ে তাদের ভোট সংগ্রহ করেছে। আইনটিকে তারা কেবল 'ভোটের ললিপপ' হিসাবে ব্যবহার করছে। ২০১৯ এবং ২০২১ সালের নির্বাচনে মতুয়ারা এই সিএএ’র আশাতেই বিজেপি’র দিকে ঝুঁকেছিলেন। কিন্তু প্রতিবার নির্বাচনের পর আইনটি স্থগিত রাখা হয়েছে। এই বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের মাধ্যমে বিজেপি প্রমাণ করেছে যে, তাদের কাছে মতুয়াদের নাগরিকত্ব নয়, কেবল তাঁদের ভোটই গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই দলের চরম সুবিধাবাদী রাজনীতির বলি হচ্ছেন মতুয়ারা। ঠাকুরবাড়ির রাজনৈতিক আনুগত্য ভাগ হয়ে যাওয়ায় মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা বা আঞ্চলিক উন্নয়নের মতো মূল সমস্যাগুলি নিয়ে কোনও আলোচনা নেই। পুরো রাজনীতি কেবল 'নাগরিকত্ব পাবে কিনা'— এই প্রশ্নের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। মতুয়াদের সংবেদনশীল পরিচয়কে রাজনৈতিক দলগুলি স্রেফ ক্ষমতা দখলের সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করছে, আর এই সমাজের মানুষ বারবার প্রতারিত হচ্ছে।
এই সম্প্রদায়ের কাছে এই দু’দলই ক্রমেই বিশ্বাসঘাতক বলে পরিগণিত হচ্ছে ধীরে ধীরে। তাই গত মঙ্গলবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভায় জনসমাগম ছিল নগন্য। একইভাবে এসআইআর চলাকালীন সিএএ ফর্ম বিলির ক্যাম্প বিজেপি-আরএসএস মহা ধুমধাম করে শুরু করেও দিন সাতেকের মধ্যে সেসব ক্যাম্প গুটিয়ে পিঠটান দিয়েছে। আর ললিপপের টোপ মানুষ বিশেষ একটা গিলতে চাইছেন না।
Editorial
নাগরিকত্বের ললিপপ
×
Comments :0