SEDITION ACT

'রাষ্ট্রদ্রোহ’ আইনের বৈধতা দেখবে সাংবিধানিক বেঞ্চ

জাতীয়

Supreme court central government food security mal nutrition sedition act bengali news

দানবীয় ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ আইনের সাংবিধানিক বৈধতা খতিয়ে দেখার শুনানি আটকে দেওয়ার ছক বানচাল করে দিল সুপ্রিম কোর্ট। এই শুনানি আপাতত পিছিয়ে দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন করেছিল কেন্দ্রের মোদী সরকার। মঙ্গলবার সরকারের এই আরজি সরাসরি খারিজ করে দিয়েছে আদালত। পাশাপাশি, ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারার সাংবিধানিক বৈধতা সংক্রান্ত এই মামলা উচ্চতর সাংবিধানিক বেঞ্চে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতিরা। এবার পাঁচ অথবা সাত সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চে এই মামলার শুনানি হবে।
প্রসঙ্গত, ইংরেজ আমলে যে আইনের জোরে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওপর দমনপীড়ন চালানো হতো, স্বাধীনতার পরেও সেই সংস্থান কার্যত অবিকৃত রয়ে গিয়েছে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারায়। স্বাধীন ভারতে নানা সময়ে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর দমনপীড়নে এই আইনটি কাজে লাগানো হলেও, কেন্দ্রে আরএসএস-বিজেপি’র সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই প্রবণতা ভয়াবহ আকার নিয়েছে। সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কোনও গণতান্ত্রিক প্রতিবাদকেও ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ হিসাবে দাগিয়ে দিয়ে প্রতিবাদীদের জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে।
এই অবস্থায় বহুদিন ধরেই জোরালো অভিযোগ উঠছে, ভারতীয় দণ্ডবিধির এই ১২৪এ নম্বর ধারাটি সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। ব্রিটিশ জমানার এই আইন ভারতীয় সংবিধানের বাক্‌ স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার লঙ্ঘন করছে। ফলে ১২৪এ নম্বর ধারার সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সর্বোচ্চ আদালতে একগুচ্ছ আবেদনও জমা পড়েছে। সেসব আবেদনের শুনানিই এদিন চলছিল সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে। তিন সদস্যের বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রও।
এদিন এজলাসে কেন্দ্রীয় সরকারের দুই শীর্ষ আইনি অফিসার, অ্যাটর্নি জেনারেল আর ভেঙ্কটরামানি এবং সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা ১২৪এ নম্বর ধারার সাংবিধানিক বৈধতা সংক্রান্ত চলতি শুনানি স্থগিত রাখার আরজি জানান। তাঁরা যুক্তি দেন, বর্তমান ভারতীয় দণ্ডবিধির পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকার ভারতীয় ন্যায় সংহিতা নামে একটি নতুন বিধি চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। আপাতত এই নয়া বিধি সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটিতে বিবেচনাধীন রয়েছে। খুব শীঘ্রই পুরানো বিধির বদলে নতুনটি চালু হয়ে যাবে। এই অবস্থায় পুরানো দণ্ডবিধির একটি ধারার সাংবিধানিক বৈধতা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন নেই।
এই সময়ে কেন্দ্রের আরজির প্রবল প্রতিবাদ করে জনৈক আবেদনকারীর আইনজীবী কপিল সিবাল বিচারপতিদের বলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত নতুন আইনটি আরও ভয়ঙ্কর, আরও খারাপ। নয়া বিধিতে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ শব্দটি না থাকলেও, বিরুদ্ধ মত দমনে আরও বিপজ্জনক সংস্থান রাখা হচ্ছে। সুতরাং সর্বোচ্চ আদালতে এই বিচারপ্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়াই উচিত। 


দানবীয় আইনটি চালিয়ে যেতে কেন্দ্রের কৌশলী চাল বুঝে এরপরেই প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, কেন্দ্রের নতুন আইন ভবিষ্যতের মামলাগুলিতে প্রযোজ্য হবে। বকেয়া মামলার ক্ষেত্রে তো প্রস্তাবিত আইনের কোনও ভূমিকা নেই। পুরানো মামলাগুলি বিচারের ক্ষেত্রে চলতি দণ্ডবিধির ১২৪এ নম্বর ধারার সংস্থানই বৈধ থাকবে। তাই ১২৪এ ধারার সাংবিধানিকতা খতিয়ে দেখার কাজ আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে শুনানি স্থগিতের আবেদন আমরা খারিজ করছি।
প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ এদিন একইসঙ্গে জানায়, ১২৪এ ধারার সাংবিধানিক বৈধতা ঘোষণা করে অতীতে কেদারনাথ সিং বনাম বিহার সরকার মামলায় সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছিল, তা সঠিক কিনা এবার তা-ও খতিয়ে দেখা হবে। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে সেই মামলার শুনানি হয়েছিল। ফলে এবারেও পাঁচ অথবা সাত সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ নতুন করে ১২৪এ ধারার বৈধতা বিবেচনা করবে। আদালতের প্রশাসনিক বিষয় বুঝে নতুন সাংবিধানিক বেঞ্চের সদস্যসংখ্যা ঠিক করবেন প্রধান বিচারপতি। উল্লেখ্য, ১৯৬২ সালে এক মামলায় ১২৪এ ধারাকে বৈধ বলে ঘোষণা করেছিলেন তদানীন্তন বেঞ্চের পাঁচ বিচারপতি।
প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রদ্রোহের অজুহাতে বিরোধী স্বর দমনের চেষ্টা রুখতে সাম্প্রতিক অতীতেও সক্রিয় হতে দেখা গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টকে। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশকে তোয়াক্কা না করেই মোদী সরকার নানা কায়দায় প্রতিবাদী কবি, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মীদের বিরুদ্ধে দমননীতি প্রয়োগ চালিয়ে গিয়েছে। গত বছরের মে মাসে এক গুরুত্বপূর্ণ রায়ে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে কোন ফৌজদারি মামলা দায়ের না করার জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলিকে নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের ডিভিসন বেঞ্চ। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এনভি রামান্না, বিচারপতি সূর্য কান্ত এবং বিচারপতি হিমা কোহলির বেঞ্চের নির্দেশে স্পষ্ট বলা হয়েছিল,  ‘‘ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারা পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে বলে আদালতে হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে কেন্দ্র। সরকারের এই প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত ১২৪এ ধারার প্রয়োগ স্থগিত থাকবে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলি আপাতত এই আইনে কোথাও কোনও ফৌজদারি মামলা দায়ের করবে না।’’ কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের এই মনোভাবকে সম্মান দেখানোর পরিবর্তে মোদী সরকার এখন আরও বেশি দমনপীড়নমূলক আইন আনতে চলেছে।
১২৪এ ধারার ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ আইনের প্রবল বিরোধিতা জানিয়ে আবেদনকারীরা সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ করেছেন, এই দমন আইনে ‘রাষ্ট্র’ এবং ‘সরকার’এর মধ্যে কোনও ফারাক করা হয়নি। বহুক্ষেত্রেই ‘রাষ্ট্র’ এবং ‘সরকার’ সমার্থক নয়। ফলে সরকারি নীতির বিরোধিতা করলেই এই ভয়ঙ্কর আইনের সুযোগে প্রতিবাদীকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসাবে দাগিয়ে জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে। কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই অন্যায় চলতে পারে না। তাছাড়া ১২৪এ ধারার ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ আইনে ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত ১৪ (সমতার অধিকার), ১৯ (বাক্‌ স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার) এবং ২১ (জীবনের ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার) নম্বর ধারা লঙ্ঘিত হচ্ছে বলেও অভিযোগ জানিয়েছেন আবেদনকারীরা। সুপ্রিম কোর্টের এদিনের নির্দেশের ফলে মোদী সরকারের আপত্তি সত্ত্বেও এবার নতুন করে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। 


 

Comments :0

Login to leave a comment