ARTICLE 370

হিন্দুত্ববাদীদের মিথ্যার ফাঁদে পড়বেন না

জাতীয়

Article 370 cpim md yusuf tarigami bengali news

মহম্মদ ইউসুফ তারিগামি
 

সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদাহানি করার কেন্দ্রের সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সিপিআই (এম) সহ অনেকেই সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিল। তা নিয়ে শীর্ষ আইনজীবীরা দীর্ঘ আইনি সওয়াল করেছেন জোরালোভাবে। আইনজীবীরা একদিকে সওয়াল করেছেন, সংবিধানের নির্দেশিকা নিয়ে। দ্বিতীয়ত, তাঁরা তুলে ধরেছেন কোন অনন্য পরিস্থিতিতে জম্মু-কাশ্মীরের ভারতভুক্তি হয়েছিল। 
জম্মু-কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং ভারতভুক্তিতে রাজি ছিলেন না। যে কারণে ১৯৪৭ সালের আগস্টে অন্যান্য ‘রাজন্য শাসিত’ রাজ্যগুলি ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলেও, মহারাজা হরি সিং রাজি হননি। পাকিস্তান থেকে জম্মু-কাশ্মীরে হানাদার বাহিনী হামলা করার আগে পর্যন্ত তিনি এই অবস্থানেই ছিলেন। হামলা হওয়ার পরে তিনি কাশ্মীর ছেড়ে পালিয়ে যান নিজের বাহিনী নিয়ে। তাঁর দরবারের লোকেরাও পালিয়ে যায়। তারপরেই একমাত্র তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্য চান। সেই সময়ে বলা হয়, মহারাজাকে ভারতভুক্তির চুক্তি করতে হবে। সেই চুক্তিতেও বলা হয়েছিল বিশেষ পরিস্থিতিতে এই ভারতভুক্তির চুক্তি হচ্ছে। ভারত সরকার ও রাজার মধ্যে ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন’ স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৪৭-র ২৭ অক্টোবর সেই চুক্তি অনুযায়ী তিনটি বিষয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়: বৈদেশিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ। ওই চুক্তির ৮নং পরিচ্ছেদ অনুযায়ী বাকি সমস্ত বিষয়ে রাজ্যের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে। তদানীন্তন জম্মু কাশ্মীর সংবিধান আইন, ১৯৩৯ মোতাবেক বাকি ক্ষমতা জম্মু কাশ্মীর রাজ্যের হাতেই থাকে। 
আমাদের আইনজীবীরা সওয়াল করার সময়ে বলেছেন, এই চুক্তি যখন হচ্ছে তখন কাশ্মীরে ভারতের কোনও সেনা ছিল না, পাকিস্তানী হানাদাররা ছিল। সেই পরিস্থিতিতেও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের মানুষ সেদিন ধর্মীয় আবেদনে সাড়া দেননি। তাঁরা বলেছিলেন, আমরা ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা শেখ আবদুল্লার নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সঙ্গে যাব। দ্বি-জাতি তত্ত্বকে খারিজ করেছিলেন। তাঁরা বিক্ষোভ দেখিয়ে ছিলেন, রাস্তায় নেমে এসেছিলেন হাজারে হাজারে। এটাই ছিল কাশ্মীরের বিশেষ পরিস্থিতি, যা অন্য রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে ছিল না। এই বিশেষ পরিস্থিতির বিবেচনা করেই গণপরিষদ ৩৭০ ধারা যুক্ত করেছিল ভারতের সংবিধানে। জওহরলাল নেহরু সহ গোটা মন্ত্রীসভা তাতে সম্মতি দিয়েছিল। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ছাড়াও মন্ত্রীসভায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিও ছিলেন। যিনি পরবর্তীকালে জনসঙ্ঘ তৈরি করেছিলেন। কেউ এমনকি ভিন্নমতও জানাননি। এখন ৩৭০ ধারা নিয়ে বলতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলছে, অভ্যন্তীরণ সার্বভৌমত্বের কোনও প্রশ্ন নেই। 
অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বের অর্থ কী? আমাদের দেশের মূল হলো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের সেই অধিকারকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে অনন্যতাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। গণপরিষদ যা বলেছিল, তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। ভারত সরকার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের বিপরীতে গিয়ে, জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে এই কাজ করেছে। গোটা জম্মু-কাশ্মীরকে অবরুদ্ধ করে, কারফিউ জারি করে সংসদে এই কাজ করা হয়েছিল। তখন জম্মু-কাশ্মীরে কোনও নির্বাচিত সরকার ছিল না। কোনও নির্বাচিত বিধানসভা ছিল না। এই বিষয়গুলি সুপ্রিম কোর্ট বিবেচনায় রাখল না। একে উদাহরণ করে আগামী দিনে যে কোনও রাজ্যকে বিভাজন, মর্যাদাহানি করতে পারবে কেন্দ্র সরকার। তাই কেন্দ্র সরকার যা করেছে, তা দুঃখজনকভাবে শুধু জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের উপরে হামলা নয়, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপরেই আঘাত। আগামী দিনে যে কোনও রাজ্যের মানুষের অধিকারের উপরে এই হস্তক্ষেপ হবে। আজকের সুপ্রিম কোর্টের রায় সেই কাজে সহায়তা করবে। সেই কারণেই আবেদন, এটাকে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্ন বিষয় বলে দেখলে হবে না। 
কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, ৩৭০ধারাই সন্ত্রাসবাদের উৎস। ১৯৫০ থেকে ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত তো কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ ছিল না। তখনও তো ৩৭০ ধারা ছিল। আশির দশকের শেষ থেকে এবং নব্বইয়ের প্রথম দিক থেকে সন্ত্রাসবাদের সূচনা হয়। সিপিআই(এম)’র বক্তব্য হলো, জম্মু-কাশ্মীরে লাগাতার ৩৭০ ধারার অবনমন এবং গণতন্ত্রকে অস্বীকার করার কারণেই একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়, যা তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে যারা ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের এই সম্পর্ককে ধ্বংস করতে চায় এবং সন্ত্রাসবাদকে মদত দিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা করে। সেই কারণে সিপিআই (এম) বরাবর দাবি জানিয়ে এসেছে, সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে তার মূল চরিত্রে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। গণতন্ত্রকেও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে মানুষের ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে, তার মাধ্যমেই সন্ত্রাসবাদকে মোকাবিলা করা যাবে। কিন্তু যারা জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের ঐক্য ধ্বংস করতে চায়, বর্তমান কেন্দ্রের সরকার শুধু তাদেরকেই সমর্থন করেছে। অন্যান্য রাজ্যেরও যে বিশেষ অধিকার আছে, সুপ্রিম কোর্ট এদিনের রায়ে তার উল্লেখ করেনি। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির বিশেষ অধিকার আছে। হিমাচলে জমির মালিকানার বিশেষ অধিকার এবং রক্ষা করার অধিকার আছে। সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের এই অধিকার রক্ষা করার, তার অনন্যতা রক্ষা করার এই কথাটুকুও বলেনি। ফলে এই রায় খুবই হতাশাজনক, বিস্ময়কর। একইসঙ্গে এই রায় জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের মনোবল নতুন করে নষ্ট করে দেবে। তাদের আরও বিচ্ছিন্ন করবে। এই রায়ে শুধু তাদেরই ভালো হবে যারা হিংসা ছড়াতে চায়, ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সম্পর্ককে ধ্বংস করতে চায়। 
তাই সিপিআই(এম) সারা দেশের মানুষের কাছে আবেদন করছে, জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের যন্ত্রণা এবং উদ্বেগকে উপলব্ধি করুন। হিন্দুত্ববাদী শক্তির, সঙ্ঘ পরিবারের মিথ্যার ফাঁদে পড়বেন না। ওদের বাতিল করুন। জম্মু-কাশ্মীর সহ সমস্ত রাজ্যের মানুষের অধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসুন।

Comments :0

Login to leave a comment