Nandigram

সিপিআই(এম)-কে দুর্বল করে নন্দীগ্রামকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ বিজেপি, তৃণমূলের

রাজ্য লোকসভা ২০২৪

সিপিআই(এম)-কে মেরে, জেলে ভরে, ঘর ছাড়া করে দুর্বল করলে ধর্মের নামে বিভাজন কীভাবে গ্রাস করে সমাজকে, তার দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াল নন্দীগ্রাম।
নন্দীগ্রাম বিধানসভা এলাকা তমলুক লোকসভার মধ্যে। এই বিধানসভার আওতায় দুটি ব্লক— নন্দীগ্রাম ১ এবং নন্দীগ্রাম ২নং ব্লক। ২০০৭-’০৮-এ সিপিআই(এম)-কে নিকেশ করার চক্রান্তের কেন্দ্র ছিল মূলত নন্দীগ্রাম ১নং ব্লক এলাকা। ২০০৭-র জানুয়ারি থেকে টানা ১১মাস সেই ব্লক এলাকার বেশিরভাগ এলাকায় মমতা ব্যানার্জি-শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে নৈরাজ্যের মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলেছিল মাওবাদী, আরএসএস, মৌলবাদী শক্তি। নেতৃত্বে ছিল তৃণমূল। জমিরক্ষার নামে সেই নৈরাজ্য চালালেও আসলে তা ছিল সিপিআই(এম)-কে নিকেশ করার চক্রান্তের পরীক্ষাগার। ২০০৭-র ৯ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য খেজুরির সভা থেকে ঘোষণা করেছিলেন যে, মানুষ না চাইলে সরকার এক ইঞ্চি জমিও নেবে না। যদিও তৃণমূল, বিজেপি তারপরেও রাস্তা কাটা, সেতু ভাঙা চালিয়ে গেছিল নন্দীগ্রাম ১নং ব্লক এলাকার পঞ্চায়েতগুলিতে। ১৪ মার্চ পুলিশ যায়। ১৪জন গ্রামবাসীর মৃত্যু হয়। যদিও ইদানীং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বিভিন্ন সভায় জানিয়েছেন যে, তৎকালীন তৃণমূল নেতা শিশির অধিকারী, শুভেন্দু অধিকারীরাই সশস্ত্র বাহিনী ঢুকিয়েছিল নন্দীগ্রামে। সেই ঘটনার সিবিআই তদন্ত করিয়েছিল ইউপিএ সরকার। সেই তদন্তেও বহিরাগতদের উপস্থিতির কথা জানানো হয়েছিল। 
নৈরাজ্যের দিনগুলিতে নন্দীগ্রাম এবং লাগোয়া খেজুরিতে সিপিআই(এম)-র অনেক কর্মী, নেতা শহীদ হয়েছিলেন। ২০১১ পরবর্তী সময়েও নন্দীগ্রামে তৃণমূল লাগাতার আক্রামণ চালিয়েছে সিপিআই(এম) কর্মীদের উপর। অনেকে আজও ঘরছাড়া। এই ভাবেই গত ১৩ বছরে নন্দীগ্রামে সিপিআই(এম) দুর্বল হয়েছে। 
ফল কী হয়েছে? দেখাচ্ছে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের তথ্য। সেখানে তৃণমূল এবার লোকসভা নির্বাচনেও হেরেছে। গত বিধানসভা নির্বাচনেও মমতা ব্যানার্জি এখানে হেরেছিলেন। জিতেছে বিজেপি। গত কয়েক বছরে নন্দীগ্রামে তৃণমূল, মাওবাদীদের ‘তৈরি’ করা জমিতে আরএসএস’র সংগঠন বেড়েছে। শুভেন্দু অধিকারী সহ নন্দীগ্রামের অনেক তৃণমূল নেতা এখন বিজেপি’র নেতা।
পঞ্চায়েতগুলির ফলাফল কেমন?
সোনাচূড়া, গোকুলনগর, ভেকুটিয়া, হরিপুরে হিন্দুদের বসবাস বেশি। প্রতিটিতে বিজেপি ভোট পেয়েছে ৬০শতাংশের বেশি। উদাহরণ হিসাবে তালপাটি খালের ধারে সোনাচূড়া পঞ্চায়েতকে ধরা যায়। সোনাচূড়ায় ঘাঁটি ছিল মাওবাদীদের। সোনাচূড়াতেই শহীদ হয়েছিল কমরেড শঙ্কর সামন্ত। সেখানে বিজেপি ভোট পেয়েছে ১১,৭৭৪টি। মোট ভোটের ৬০শতাংশ। আর সেখানে তৃণমূল ভোট পেয়েছে ৩৬শতাংশ—  ৭০৬৩টি। ঠিক উলটো ছিল ২০০৭-র তথাকথিত ‘জমিরক্ষা’র আন্দোলনের আর এক ক্ষেত্র কেন্দেমারী। এখানে মুসলিমদের বসবাস বেশি। ২০০৭-০৮-এ এই এলাকার ভূমিহীন খেতমজুররা শিল্পের দাবিতে তৃণমূল-মাওবাদী-বিজেপি-মৌলবাদীদের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে নিজেদের সামর্থ্য অনুসারে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। খুন হয়েছিলেন কয়েকজন। লোকসভার নির্বাচনে এই পঞ্চায়েতে তৃণমূল ভোট পেয়েছে ৬১শতাংশ। আর বিজেপি পেয়েছে ৩৪ শতাংশ। একই ছবি কালীচরণপুরে— যেখানে ২০০৭-র ৩জানুয়ারি সব ধর্মের, অংশের গ্রামবাসীদের ভুল বুঝিয়ে তৃণমূল প্রথম হামলা চালিয়েছিল পঞ্চায়েত অফিসে, আগুন লাগিয়েছিল পুলিশের গাড়িতে। আবার ঠিক বিপরীত ছিল গোকুলনগরে। এখানে ‘জমি আন্দোলনের সেনানী’রা বিজেপি’র নেতা হয়ে বসেছেন। গোকুলনগরে প্রধানত হিন্দুদের বসবাস। সেখানে তৃণমূল দাঁত ফোটাতে পারেনি, মাত্র ৩৮শতাংশ ভোট পেয়েছে।
নন্দীগ্রামের এই হাল প্রসঙ্গে মমতা ব্যানার্জির নির্বাচনী এজেন্ট, তৃণমূল নেতা শেখ সুফিয়ান বলেছেন,‘‘এই শকুনের রাজনীতির পুরো দায় শুভেন্দু অধিকারীর। ধর্মের নামে রাজনীতি করে নন্দীগ্রামকে ভাগের চেষ্টা করেছেন উনি।’’ বিজেপি’র তমলুক সাংগঠনিক জেলার সাধারণ সম্পাদক, শুভেন্দু অধিকারীর ছায়াসঙ্গী মেঘনাদ পালের বাড়িও সুফিয়ানের মতোই নন্দীগ্রামে। মেঘনাদ পালের কথায়,‘‘ধর্মীয় মেরুকরণ তো হয়েছেই। এর জন্য তৃণমূল দায়ী। মুসলমানদের একমাত্র পার্টি তৃণমূল তো ওরাই লাগাতার বোঝাচ্ছে। তাতে অনেকে প্রভাবিত হচ্ছে। তবে এবার নন্দীগ্রাম ১নং ব্লকে বিধানসভা নির্বাচন থেকে আমাদের ভোট বেড়েছে।’’ তাঁর দাবি,‘‘কিছু সংখ্যালঘু আমাদের ভোট দিয়েছেন।’’
সিপিআই(এম)-র পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কমিটির সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি বলেন,‘‘এই অবস্থার জন্য শুভেন্দু অধিকারী যেমন দায়ী, মমতা ব্যানার্জিও দায়ী। দুজনেই প্রবল ভাবে ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা করেছেন। শুধুমাত্র একটি ভোটে জেতার জন্য, ভবিষ্যতের কথা না ভেবে তাঁরা যা করলেন কিংবা করছেন তা রাজ্যের সবার জন্য মারাত্মক।’’
এরই মধ্যে সরু রূপালি রেখা আছে। বিধানসভা নির্বাচনের থেকে নন্দীগ্রামে সিপিআই(এম)-র ভোট সামান্য হলেও বেড়েছে। সিহির কথায়,‘‘দুই ধর্মেরই মানুষের মধ্যে আমাদের ভোটদাতারা আছেন। পঞ্চায়েত ভিত্তিক ফলাফলে তা স্পষ্ট।’’
 

 

 

Comments :0

Login to leave a comment