অনীল কুণ্ডু
তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধানের স্বামী এবং দলের অঞ্চল সভাপতি সইফুদ্দিন লস্করকে খুন করেছে দুষ্কৃতীরা। হত্যার পরই ৫ কিলোমিটার দূরের গ্রামে সিপিআই(এম) দরদি, সমর্থকদের বাড়িতে উন্মত্ত তাণ্ডব চালালো তৃণমূলের দুষ্কৃতী বাহিনী। রেহাই পাননি মহিলারা, শিশুরাও।
পুলিশের সামনেই পুড়িয়ে দেওয়া হয় ঘর। আটকে রাখা হয় দমকলকে।
জয়নগরের বামনগাছি অঞ্চলের বাঙালবুড়ির মোড়ে তৃণমূল নেতা সইফুদ্দিন লস্কর (৪৩)’কে খুব কাছ থেকে গুলি চালিয়ে খুন করা হয় সোমবার ভোরে। ক্ষমতাবান সইফুদ্দিনের গোষ্ঠীর বাহিনী খুনি অভিযোগে একজনকে বেধড়ক মারধর করে ঘটনাস্থলে। সাহাবুদ্দিন সেখ নামে সেই ব্যক্তিরও মৃত্যু হয়। তৃণমূলের ওই বাহিনী আরও একজনকে বেধড়ক মারে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, তার নাম সাহরুল সেখ। সে পদ্মেরহাট গ্রামীণ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
গত বারো বছরে হঠাৎ বড়লোক হয়ে ওঠা সইফুদ্দিনের খুনের বদলা তারপরও শেষ হয়নি তৃণমূলীদের। দু’জনকে বেধড়ক মারধরের পর তারা হানা দেয় প্রায় চার কিমি দূরে আর একটি গ্রাম — দলুয়াখাকিতে। এমন সময় সেই দুর্বৃত্তবাহিনী সেখানে হানা দেয়, যখন দলুয়াখাকির মহিলারা রান্না চাপিয়েছেন। বাড়ির পুরুষরাও যে যার কাজে। তৃণমূলীরা সেই গ্রামে দস্যুর মত হানা দেয়। ভাতের হাঁড়ি সহ খাবার লাথি মেরে ফেলে দেয়। খড়ের গাদায়, বাড়ির চালে, দরজায়, খাটে আগুন ধরিয়ে দেয়। অন্তত ২০টি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় ‘নেতার খুনে শোক পাওয়া’ তৃণমূলের উন্মত্ত দলবল। দলুয়াখাকির মহিলাদের ওই বাহিনী মারধর করে।
স্থানীয়দের বয়ান অনুযায়ী, পথে যে শিশুদের পেয়েছে ছুঁড়ে ফেলেছে ডোবা, পুকুরে। তারা মহিলাদের শ্লীলতাহানিও করে। শুধু তাই নয়, প্রায় ঘন্টা সাড়ে তিন ধরে দলুয়াখাকিতে তান্ডব চালানোর সময় তৃণমূলীরা দমকল বাহিনীকে আসতে বাধা দেয়। পুলিশ পৌঁছায়নি।
প্রসঙ্গত, নিহত সইফুদ্দিন লস্কর বেশ কিছুদিন থানার ডাকমাস্টার ছিলেন। পুলিশের সঙ্গে তার বিশেষ দহরম মহরম ছিল। অন্যদিকে দলুয়াখাকিতে যাঁদের বাড়িতে হামলা চলেছে, তাঁরা এলাকায় সিপিআই(এম)-র দরদী, সমর্থক হিসাবেই পরিচিত।
পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ‘‘সুচতুর ভাবে সবার নজর খুনের জায়গা থেকে দূরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সইফুদ্দিনের খুনের পর পিটিয়ে একজনকে খুন করার পর তাদের নজর ঘোরাতে পাঠানো হয় দূরের গ্রামে। এদিন ভোর সাড়ে ৫টার সময় সইফুদ্দিনের বাড়ির কাছে তার উপর হামলার সাহস যে কারও হওয়া সম্ভব নয়। সইফুদ্দিন ওই সময়ে একা মসজিদে নমাজ পড়তে যান, তা তার ঘনিষ্ঠরা, দলের কর্মীরা জানেন। চার কিমি দূরের গ্রাম থেকে ওই সময়ে এসে তার উপর হামলা চালাবে দলুয়াখাকির লোক, এটি সম্ভব নয়।’’
তাহলে? স্থানীয় মানুষ এবং তৃণমূলের একটা অংশের বক্তব্য, সইফুদ্দিনের খুনের পিছনে এলাকা দখল, পঞ্চায়েতের টাকা এবং কোন বিধায়কের হাতে অঞ্চল থাকবে, তা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে চলা রেষারেষি জড়িয়ে আছে। জয়নগর-১নং ব্লকের একাংশ বারুইপুর পূর্ব বিধানসভার মধ্যে। আরেক অংশ ক্যানিং পূর্বের মধ্যে। বারুইপুর পূর্বের বিধায়ক বিভাস সর্দার ওরফে ভোবো। আর ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক সওকত মোল্লা। জয়নগর-১নং ব্লকের দখল নিয়ে দুজনের রেষারেষিতে ওই এলাকায় তৃণমূল দু’ ভাগ হয়ে আছে। এদিন সওকত মোল্লা দাবি করেছেন, ‘‘সইফুদ্দিনের খুনের ঘটনটায় সিপিএম দায়ী।’’ অন্যদিকে বিভাস সর্দার জানিয়েছেন, ‘‘এটি দুষ্কৃতীদের কাজ।’’
সিপিআই(এম) দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক শমীক লাহিড়ী বলেন, ‘‘এলাকার দখলদারি ও লুটের বখরা নিয়ে তৃণমূল নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করছে। এর আগে জয়নগরের তৃণমূল বিধায়ককে খুনের চেষ্টা করা হয়েছিল।’’ এদিন তিনি বারুইপুর পুলিশ জেলার সুপারকে লিখিত অভিযোগে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘দুষ্কৃতীদের আড়াল করতেই বগটুইয়ের মতো গ্রামে আগুন ধরিয়েছে তৃণমূল। যে কোন মৃত্যু দুঃখজনক। খুনের ঘটনার নিন্দা করছি। অন্য কারো উপর দোষ না চাপিয়ে খুনিকে খুঁজে বের করা হোক।
ঘটনাস্থলে আসেন এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সিদ্ধিনাথ গুপ্তা সহ বারুইপুর পুলিশ জেলার আধিকারিকরা। সিদ্ধিনাথ গুপ্তা সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন,‘‘তদন্ত চলছে। এর বাইরে এখন কিছু বলা সম্ভব নয়।’’
Comments :0