রামের মন্দিরের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তা নিয়ে দেদার প্রচার শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ব্রিগেডে গীতা পাঠের আয়োজন করা হয়েছিল হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে। রাজ্যেও মমতা ব্যানার্জির সরকারের শাসনে, বিশেষত গত দশ বছরে খোলা তলোয়ার হাতে রামনবমীর মিছিলে তৃণমূলের নেতাদের দেখা গেছে। আবার রাজ্য সরকার মন্দির নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছে। ধর্ম নিয়ে এই ভোট-কাড়াকাড়ির প্রচারে ডুবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে সেই প্রশ্নকে, যার উপর নির্ভরশীল রাজ্য তথা দেশের মানুষের জীবনযাপনের। সেই প্রশ্ন কর্মসংস্থানের,মূল্যবৃদ্ধির। অন্যদিকে বিপুল সুবিধা দেওয়া হয়েছে কর্পোরেটদের। যদিও আগে, লোকসভা কিংবা বিধানসভা নির্বাচনে সেই বিষয়গুলিতে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিজেপি। তৃণমূল সে সব নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না। কারণ, তারাও মানুষের সঙ্কট সমাধানে নিয়ে যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা পূরণ করেনি।
মানুষের চার্জশিট সেই সমস্যা নিয়ে—কী হয়েছে মোদী-জমানায়?
--------------------------------
বেকারি
২০০৮ থেকে ২০১৩—এই ১৫ বছরের মধ্যে দেশে সবথেকে বেশি বেকারত্বের হার বেড়েছে ২০২৩ সালে। আগে কখনও এই হারে বাড়েনি। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)-র পর্যালোচনা এমনই জানাচ্ছে। রিপোর্ট আরও জানাচ্ছে, গত ১৫ বছরে বেকারত্বের হার ছিল যথাক্রমে ৫.১১%, ৫.৫৪%, ৫.৫৫%, ৫.৪৩%, ৫.৪১%, ৫.৪২%, ৫.৪৪%, ৫.৪২%, ৫.৩৬%, ৫.৫৩৩%, ৫.৩৭%, ৮.০০% (২০২০), ৫.৯৮%, ৭.৩৮% এবং ৮.৭%(২০২৩)। করোনা মহামারীর পর থেকে শিল্প-বাণিজ্যে যে বিপর্যয় এসেছে, তাতে কাজের সংস্থান কমে গিয়ে বিপুল হারে বেড়েছে বেকারত্ব। গত দেড় দশকের মধ্যে চলতি বছরে সর্বাধিক হারে পৌঁছে গিয়েছে বেকারত্বের হার। চলতি বছরে বেকারত্বের হার এতোটাই বেশি যে, মহামারীর সময়ের থেকেও এবছর বেকারত্বের হার বেশি।
বেকারি এবং তরুণ প্রজন্ম
তাঁর আমলে দেশে বেকারি কমেছে বলে নরেন্দ্র মোদী বারবার দাবি করেছেন। কিন্তু সম্প্রতি বিশ্বব্যাঙ্ক তাদের রিপোর্টে সেই দাবি সরাসরি খারিজ করে দিয়েছে। রিপোর্টে বিশ্ব ব্যাঙ্ক জানিয়েছে ভারতের তরুণদের বেকারির হার বিপুল হারে বেড়েছে। প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটানের থেকেও ভারতে তরুণ প্রজন্মের বেকারির হার বেশি।
বেকারি নিয়ে রিপোর্টে বিশ্বব্যাঙ্ক জানাচ্ছে, ২০২২সালে ভারতে তরুণদের মধ্যে বেকারির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩.২২ শতাংশ। সেখানে ভারতের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে এই একই সময়ে বেকারির হার হলো ১১.৩ শতাংশ, বাংলাদেশে এই বেকারির হার হলো ১২.৯ শতাংশ এবং ভুটানে বেকারির হার হলো ১৪.৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাঙ্কই জানিয়েছে, গত বছর চীনে বেকারির হার ছিল ১৩.২শতাংশ, সিরিয়ায় ২২.১ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ১৩ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ১১.৭ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৭.৪ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৬.৯ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৬.১ শতাংশ। ভারতে তরুণ প্রজন্মের মধ্যেই বেকারি হারে এই বিপুল বৃদ্ধি বলে জানানো হয়েছে। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সকেই তরুণ প্রজন্ম হিসাবেই ধরা হয়েছে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের (আইএলও) সূত্রে এই বেকারির হার নিয়ে সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।
সংগঠিত শিল্পে কাজ
নরেন্দ্র মোদীর শাসনে সরকারি সমীক্ষাতেই স্পষ্ট রেকর্ড হারে সংগঠিত শিল্পে নতুন নিয়োগ কমছে। দেশের সংগঠিত শিল্পের শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনতে এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ডে (ইপিএফ)-এ সদস্য করা হয়। পিরিওডিক লেবার ফোর্স (পিএলএফএস) সমীক্ষায় জানিয়েছে দেশে ৯০ শতাংশ শ্রমিক হলেন অসংগঠিত শিল্পের। বাকি সংগঠিত শিল্পের। যে শিল্পের ২০ জনের বেশি কর্মী রয়েছে তাদের ইপিএফ’র সদস্যপদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যে শিল্পে তার ২০ জনের নিচে কর্মী রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে সদস্যপদ বাধ্যতামূলক নয়। ফলে দেখা যাচ্ছে মোট শ্রমিকের মাত্র ১০ শতাংশ সংগঠিত শিল্পের কর্মী। তাঁদের একাংশ ইপিএফ’র সদস্য। দেশের ১০ শতাংশ শ্রমিকের সেই সংগঠিত শিল্পের প্রসার কমছে, ফলে তার নতুন নিয়োগ হার কমছে। ইপিএফ সম্প্রতি তার মাসিক সদস্য সংখ্যা প্রকাশ করে জানিয়েছে গত সেপ্টেম্বরে ইপিএফ-এ নতুন সদস্য সংখ্যা ছিল ৯ লক্ষ ২৬ হাজার ৯৩৪জন। তা অক্টোবরে দাঁড়িয়েছে ৭ লক্ষ ৭২ হাজার ৮৪জন। একমাসেই নতুন সদস্য ২লক্ষের উপর কমেছে। চলতি বছরের মার্চে একই ভাবে নতুন সদস্য সংখ্যা কমে হয়েছিল ৭ লক্ষ ৫৭ হাজার ৭৯২ জন। অক্টোবরে রেকর্ড ১৬.৭শতাংশ হারে নতুন সদস্য কমায় ফের বেকারি আর উর্ধ্বমুখী হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ১৮থেকে ২৮ বছর বয়সের ইপিএফ-এ নতুন সদস্য সামান্য বেড়েছে। নতুন প্রজন্মের এই সদস্য সেপ্টেম্বরে ছিল ৬৮.৫ শতাংশ। তা বেড়ে অক্টোবরে হয়েছে ৬৮.৭ শতাংশ। মাত্র ০.২ শতাংশ বেড়েছে নতুন প্রজন্মের সদস্য। অন্যদিকে ৩৫ বছরের উর্ধ্বে নতুন সদস্য ১৫.৯ শতাংশ থেকে ১৬.১ শতাংশ। মোট বৃদ্ধি হলো ০.২শতাংশ। নিয়মিত ইপিএফ’র সদস্যপদের চাঁদার অর্থ জমা দেওয়া সদস্যের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। কলকারাখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া নতুন কলকারাখানার বিকাশ কমে যাওয়ার কারণেই নিয়িমিত অর্থ জমা দেওয়া সদস্যর সংখ্যা বিপুল হারে কমেছে। ইপিএফ সুত্রে জানা গেছে মোট ২.২৭ কোটি সদস্যের মধ্যে মাত্র ১০.২২ লক্ষ সদস্য নিয়মিত তাদের সদস্য পদের অর্থ জমা দিয়ে থাকে।
স্থায়ী চাকরি কমেছে
কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় ২ লক্ষ চাকরি বিলোপ ঘটিয়ে লক্ষ লক্ষ চাকরির স্বপ্ন ধুলিসাৎ করেছে মোদী সরকার। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় মোদীর জমানায় কিভাবে বিপুল সংখ্যায় স্থায়ী চাকরি কমানো হয়েছে এবং একই সঙ্গে অস্থায়ী চাকরি বাড়ানো হয়েছে তা তাদের সমীক্ষা রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়েছে। ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় স্থায়ী চাকরি ছিল ১৬.৯ লক্ষ। ২০২২ সালে তা কমে হয়েছে ১৪.৬ লক্ষ। ২ লক্ষের উপর স্থায়ী চাকরি কমানো হয়েছে।
অন্য দিকে অস্থায়ী চাকরির সংখ্যা এই সময়ে দ্বিগুন হারে বাড়ানো হয়েছে। যেসব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় বিপুল স্থায়ী চাকরি কমানো হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে বিএসএনএল। সেখানে স্থায়ী কর্মীকে স্বেচ্ছা অবসর প্রকল্প ধরিয়ে ১লক্ষ ৮১ হাজার ১২৭ স্থায়ী চাকরি বিলোপ ঘটানো হয়েছে। সেইলে একইভাবে কমানো হয়েছে ৬২ হাজার চাকরি, এমটিএনএল’এ ২৮হাজার ১৪০ চাকরি, এফসিআই’তে ২৮ হাজার চাকরি এবং ওএনজিসি’তে ২১ হাজার চাকরি। প্রতিবছর ঢালাও স্থায়ী চাকরি কমিয়ে মোদীর বছরে ২কোটি নতুন চাকরি প্রতিশ্রুতি কোথায় গেল বলে প্রশ্ন উঠেছে।
গ্রামের কাজে কাটছাঁট
ভারতের গ্রামীণ এলাকায় কাজের অন্যতম ভরসা ছিল ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প, রেগা। সেই প্রকল্পেই রেগায় বরাদ্দ ৩২ শতাংশ বা এক তৃতীয়াংশ হারে কমানো হয়েছে বাজেটে। বাজেটে রেগায় বরাদ্দ হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। তাতে গত বছর (২০২২-২৩) সালে সংশোধিত বরাদ্দ ছিল ৮৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। রেগার বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় একধাপে কমানো হলো ২৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। মহামারী ও মন্দায় বহু মানুষের কাজ চলে গেলেও দেখা গিয়েছে প্রতিবছর রেগা কর্মসংস্থান প্রকল্পে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। যেমন ২০২০-২১ সালে রেগায় বরাদ্দ ছিল ১ লক্ষ ১১ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। ২০২১-২২ সালে কমিয়ে বরাদ্দ করা হলো ৭৩ হাজার কোটি টাকা তবে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ হয়েছিল ৯৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২২- ২৩ সালে ফের কমে হয়েছে ৮৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এবারে ২০২৩ সালে ফের কমে হলো ৬০ হাজার কোটি টাকা গত পাঁচ বছরে সর্বাধিক কমছে রেগায় বরাদ্দ।
বেগার শ্রমিক বাড়ছে
বিনা মজুরির শ্রমিক বাড়ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট বলছে, ২০২০-২১ সালে বিনা মজুরি শ্রমিক ছিলেন মোট শ্রমিকের ১৭.৩ শতাংশ, ২০২১-২২ সালে তা বেড়ে হয় ১৭.৫ শতাংশ, ২০২২-২৩ সালে তা ফের বেড়ে হয় ১৮.৩ শতাংশ।
মোদীর নির্দেশে ২০১৭ সাল থেকে বেকারি নিয়ে তথ্য প্রকাশে চালু হয় পিএলএফএস সমীক্ষা রিপোর্ট। অক্টোবরে প্রকাশিত পিএফএফএস সমীক্ষার শেষ ষষ্ঠ রিপোর্টে (জুলাই-২২থেকে জুলাই-২৩) দেখা গিয়েছে দেশে স্বনির্ভর কর্মীর সংখ্যা বিপুল হারে বেড়েছে। এই স্বনির্ভর কর্মীরা হলেন মোদী বা মমতার কথায় পকোরা বা চপ বিক্রির দোকানি এবং মুটে মজদুর, হকার, ঠেলা চালক রিকশা চালক,দর্জি, ক্ষৌরকার সহ বিভিন্ন পেশার কর্মী। এই সব কাজের কর্মী গত একবছরে বিপুল হারে বেড়েছে। ২০১৭-১৮ সালে দেশে মোট কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে এমন শ্রমজীবীর হার ছিল ৫২ শতাংশ। তা এক বছরে বেড়ে হয়েছে ৫৮ শতাংশ। সমীক্ষা জানাচ্ছে, মোট কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৫০ কোটি তার মধ্যে এই স্বনির্ভর কর্মীর সংখ্যা বেড়ে ৬০ শতাংশের দিকে চলেছে।
এই সমীক্ষাতে এই স্বনির্ভর কর্মীকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি ভাগে রাখা হয়েছে পরিবারের ছোট দোকান, ব্যবসা ও পরিবারের কৃষির নানা কাজে যুক্ত শ্রমিককে, তাদের কাজে কোনও মজুরি মেলে না। আরেকটি ভাগে থাকছে সেই সব শ্রমিক, যাদের বেতন রয়েছে নিজেদের, রয়েছে নিজস্ব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। এদিকে বিনা মজুরির এই শ্রমিকের সংখ্যা হবে মোট স্বনির্ভর কর্মীর এক তৃতীয়াংশ। গত এক বছরে স্বনির্ভর কর্মীর সংখ্যা বেড়ে চলায় এটা পরিষ্কার বিনা মজুরির শ্রমিক গত এক বছরে বিপুল হারে বেড়ে চলেছে। প্রসঙ্গত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন (আইএলও) বিনা মজুরির স্বনির্ভর শ্রমিকদের কোনও শ্রমিক বলে গণ্য করে না, ভারতে এই বিনা মজুরির শ্রমিকদের স্বনির্ভর শ্রমিক হিসাবে দেখিয়ে কর্মরত শ্রমিকের হার বাড়িয়ে দেখানো হয়। যেটা বেকারির তথ্যে সরকারের নিতান্ত কারচুপি বলে মনে করেন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন।
মূল্যবৃদ্ধি চড়া
জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর (এনএসও) তার রিপোর্টে জানিয়েছে, তিন মাসে ফের মূল্যবৃদ্ধির সর্বাধিক হারে বেড়ে নভেম্বরে দাঁড়িয়েছে ৫.৫৫ শতাংশ। আগস্ট মাসে মূল্যবৃদ্ধি চড়া হারে বেড়ে হয়েছিল ৬.৮৩ শতাংশ। পরের এক মাস তার গতি নিম্নমুখী হলে অক্টোবর থেকে ফের দাম ঊর্ধ্বগতি নিয়েছে। এনএসও তথ্য জানাচ্ছে, দেশে প্রধানত খাদ্য পণ্যের দাম চড়া হারে বেড়ে চলাতেই মূল্যবৃদ্ধির হার বেড়ে চলেছে। গত এক মাসে চাল, গম, ময়দার দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ হারে। মশলা ২১.৫৫, ডাল ২০.২৩,সবজি ১৭.৭ এবং ফল মূলের ১০.৮৫ শতাংশ হারে দাম বেড়েছে। মাছ, মাংস, ডিমের দাম বেড়েছে। এনএসও জানাচ্ছে খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির হার অক্টোবরে ছিল ৬.৬১ শতাংশ তা নভেম্বরে বেড়ে হয়েছে ৮.৭ শতাংশ। প্রসঙ্গত গত বছর অক্টোবরে খাদ্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৪.৭ শতাংশ। এবছর তা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।এদিকে মূল্যবৃদ্ধির চাপে বিপর্যস্ত গ্রাম ভারত। কারণ শহরের তুলনায় গ্রামেই মূল্যবৃদ্ধির হার বেশি। এনএসও জানাচ্ছে, গ্রাম ভারতে মূল্যবৃদ্ধির হার হলো ৫.৮৫ শতাংশ। সেখানে শহরে এই হার হলো ৫.২৬ শতাংশ।
বিভিন্ন রাজ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার প্রকাশ করেছে এনএসও। এতে দেখা গেছে, সব থেকে চড়া হারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে ওডিশায়। সেখানে মূল্যবৃদ্ধির হার হলো ৭.৬৫ শতাংশ। এর পরেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। তার মূল্যবৃদ্ধির হার হলো ৭.১ শতাংশ । দুই রাজ্যের মূলবৃদ্ধির হার জাতীয় গড়ের থেকে অনেক উপরেই রয়েছে। ৬ শতাংশ হারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে বিহার, গুজরাট, হরিয়ানা, কর্নাটক, পাঞ্জাব, তেলেঙ্গানা ও রাজস্থানে।
অনাদায়ী ঋণ-কর্পোরেট মকুব
মোদী জমানায় গত ৫ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক মোট ১০.৬লক্ষ কোটি টাকার উপর অনাদায়ী ঋণ মকুব করেছে। মোট মকুব ঋণের ৫০ শতাংশ বা ৫.৫লক্ষ কোটি টাকার উপর ঋণ মকুব হয়েছে বড় বড় কর্পোরেট সংস্থার। সোমবার লোকসভায় প্রশ্নের লিখিত জবাবে একথা জানান অর্থ দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী ভগবত কারাড। এদিকে গত দশ বছরে ঋণ মকুবের হার দেখলে দেখা যাবে মোদী জমানাতে বড় কর্পোরেটের ঋণ মকুবের পরিমাণ বেড়েই চলছে। শুধু গত বছরে(২০২২-২৩) দেখা যাচ্ছে ২.০৯লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব হয়েছে।এর মধ্যে বড় কর্পোরেটের ঋণ মকুবের পরিমাণ হলো ১.৯লক্ষ কোটি টাকা।
গত ৫ বছরে ১০.৫ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব করা হয়েছে। ২০১২-১৩সাল থেকে ধরলে ঋণ মকুবের পরিমাণ হবে ১৫.২৩ লক্ষ কোটি টাকা। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য জানাচ্ছে গত ৩বছরে মোট মকুব হওয়া ঋণের মাত্র ১৮.৬শতাংশ আদায় করা গেছে। অর্থাৎ ঋণের ৮২ শতাংশ অর্থ বরবাদ হয়ে গেছে। যার বড় অংশ হলো কর্পোরেটের অনাদায়ী ঋণ।
গত পাঁচ বছরে মোট ২৩০০ বড় কর্পোরেট যাদের ৫ কোটি টাকার উপর অনাদায়ী ঋণ রয়েছে তাদের ঋণ মকুব করা হয়েছে। এদের মধ্যে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপীর ঋণের অঙ্ক হবে ২লক্ষ কোটি টাকা। উল্লেখ্য ২০১৭-১৮ সালে ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ছিল ১০.২৭ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ সালে সরকারি ভাবে অনাদায়ী ঋণ কমে হয় ৫.৫৫ লক্ষ কোটি টাকা। অনাদায়ী ঋণ মকুবের ফলে তা সরকারি ভাবে অনাদায়ী ঋণের হার অর্ধেক কমে গেছে।
গত তিন বছরে জরিমানা বাবদ আদায় হয়েছে ৫হাজার ৩০৯ কোটি টাকা।
৯ বছরে ৯টি সরকার
কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর তারা দেশে ৯ বছরে ৯টি সরকার ভেঙে দিয়েছে। ‘পার্টি উইদ দ্য ডিফারেন্স’ বিজেপি এরকমই একটি ব্যতিক্রমী দল। মঙ্গলবার লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাবের উপর আলোচনায় একথা বলেন এনসিপি নেত্রী সাংসদ সুপ্রিয়া সুলে। তিনি বলেন, গত ৯ বছরে দেশের বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে মোদী সরকার। এর ফলে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে। দেশে বছর বছর বিরোধী দলের একটি করে সরকার ভেঙে ক্ষমতা দখল করেছে শাসক দল বিজেপি। ৯বছরে ৯টি রাজ্য সরকার ভেঙে দিয়েছে তারা। এই রাজ্য সরকারগুলি হলো, অরুণাচল, উত্তরাখণ্ড,মণিপুর, মেঘালয়, কর্নাটক, গোয়া,মধ্য প্রদেশ,পুদুচেরি এবং মহারাষ্ট্র সরকার ভাঙা হয়েছে দুই বার। সুলে বলেন, বিজেপি নিজেদের ব্যতিক্রমী পার্টি বলে দাবি করে থাকে। তার প্রশ্ন, ৯বছরে ৯টি রাজ্যসরকার ভেঙে তারা কিসের ব্যতিক্রনী পার্টি হয়ে উঠেছে? প্রসঙ্গত গত বছর মহারাষ্ট্রে শিবসেনা এনসিপি ও কংগ্রেসের জোট সরকার ভেঙে বিজেপি শিবসেনা বিধায়ক কিনে তাদের জোট সরকার গঠন করেছে। মহারাষ্ট্র বিজেপি জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে বলে জানান সুলে। মণিপুরে জাতি সংঘর্ষের জন্য বিজেপি’র ডবল ইঞ্জিনের সরকার দায়ী বলে তিনি জানান। অবিলম্বে মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন তিনি।
তফসিলি জাতি, আদিবাসী ছাত্রদের অবস্থা
কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান সম্প্রতি সংসদে জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছরে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি এবং আইআইএমের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে আদিবাসী, তফসিলি জাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়ের ১৩ হাজার ৬২৫ জন পড়ুয়া মাঝপথে তাঁদের পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছেন। পাশাপাশি কেন্দ্রের সামাজিক ন্যায় দপ্তরের মন্ত্রী অভয় নারায়ণ স্বামী সংসদে জানান, গত তিন বছরে এদেশে মোট ৩৬ হাজার ৯৫০ জন দলিত পড়ুয়া আত্মঘাতী হয়েছেন। কেন্দ্রের নয়া উদারবাদী নীতির জেরে চরম আর্থিক সঙ্কট কিভাবে এদেশের পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে, সংসদে দুই মন্ত্রীর তথ্যেই তার প্রমাণ মিলেছে। বোঝাই যাচ্ছে, মোদী সরকারের ‘আচ্ছে দিন’ আমলে প্রান্তিক সীমায় বসবাসকারী দলিত মানুষগুলির বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে উঠেছে। ক্রমবর্ধমান বেকারি, কর্মক্ষেত্রে চরম অনিশ্চয়তা, পরিবারের আয় ক্রমাগত কমতে থাকা ইত্যাদি ঘটনায় এই সময়ে পড়ুয়াদের মনে চরম হতাশা তৈরি করেছে। এতেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। দ্য ওয়্যার’র প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ২০১১ সালে পড়ুয়াদের মধ্যে আত্মহত্যার হার ছিল ২.৩ শতাংশ। ২০২১ সালে এই হার বেড়ে হয়েছে ৮ শতাংশ। প্রায় চারগুণ বেড়েছে আত্মহত্যার হার। এর মধ্যে দলিত পড়ুয়াদের মধ্যেই আত্মহত্যার হার বেশি।
খনির দখল কর্পোরেটের
বিনা আলোচনায় সম্প্রতি খনি বেসরকারিকরণ বিল পাশ করিয়েছে বিজেপি। ‘অফসোর এরিয়াজ মিনারেলস ডেভেলপমেন্ট বিল’-র উদ্দেশ্য উপকূলবর্তী খনিজ সম্পদ ভাণ্ডার পাকাপাকিভাবে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া। কয়েকদিন আগেই দুষ্প্রাপ্য খনিজ সম্পদ কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার বিল বিনা বিতর্কে লোকসভায় পাশ করিয়ে নিয়েছে মোদী সরকার। এবারে প্রস্তাবিত নয়া আইনে উপকূলের খনিজ সম্পদ অবাধ করে দেওয়া হলো কর্পোরেটের কাছে। আগে উপকূলবর্তী খনি কর্পোরেটকে লিজ চুক্তিতে দেওয়া হলেও প্রতি বছর রিনিউ বা পুনর্নবীকরণ করার বাধ্যতা ছিল। এবারে সংশোধনী এনে সেই বালাই তুলে দেওয়া হলো। দীর্ঘ ৫০ বছরের জন্য উপকূল খনিজ সম্পদ লিজে কম্পোজিট লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেটকে।
সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার দিন,গত ২৬ জুলাই পাশ হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল আইন সংশোধনী বিল। বনাঞ্চলে খনিজ সম্পদ উত্তোলনে কর্পোরেটের প্রবেশ অবাধ করতেই আনা হয়েছে এই বিল। এতে বনাঞ্চলের আদিবাসী জনজাতি সমাজের জীবন জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়বে। তাঁরা জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার হারাবেন। বিরোধীরা এই বিলের বিরোধিতা করে এসেছে। অশান্ত মণিপুর নিয়ে সরব বিরোধীদের আপত্তি উপেক্ষা করেই ধ্বনি ভোটে মাত্র ২০ মিনিটে পেশ ও পাশ হয়ে গিয়েছে এই বিল। একইভাবে কর্পোরেটের হাতে দেশের দুষ্প্রাপ্য খনিজ সম্পদ তুলে দিতে হট্টগোলে পাশ হয়েছে খনি সংশোধনী বিল।
Comments :0