Argentina world cup celebration

উৎসবে মাতোয়ারা আর্জেন্টিনা

খেলা

অবিকল একই দৃশ্য ফিরে এল ৩৬ বছর পরে। ১৯৮৬’র ফাইনালের পরে লকার রুমে মারাদোনাকে মধ্যমণি রেখে গান গাইছিলেন, নাচছিলেন বুরুচাগা, ভালদানোরা। রবিবার আর্জেন্টিনার লকার রুমে ফেরার পরে স্বভাব-লাজুক লিওনেল মেসিও উঠে পড়লেন টেবিলে। শুরু হয় নাচ, গান। এর আগেই মাঠে একপ্রস্থ বাঁধনহারা আনন্দ। ডি পল, দিবালা, ফার্নান্ডেজরা উঠে পড়েছেন গোলপোস্টের ওপরে। যে প্রান্তে টাইব্রেকার হয়েছে, সেই গোলপোস্টের জাল ছিঁড়ে নিয়েছেন স্মারক হিসাবে। গ্যালারি থেকে আগুয়েরো লাফিয়ে নেমে পড়েছেন মাঠে। প্রাণের বন্ধুর ঘাড়ে চেপেছেন মেসি। নেমেছেন আত্মীয় স্বজনরা। মেসি তাঁর স্ত্রী-পুত্রদের নিয়ে বসেছেন কিছুক্ষণ। মাতিও, থিয়েগোরাও চুম্বন করেছেন গোল্ডেন বলকে। ডি মারিয়া মেয়েকে কোলে তুলে নাচতে লেগেছেন। যে গোলপোস্টে দাঁড়িয়ে রুখে দিয়েছেন পেনাল্টি, সেখানেই স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে বসে পড়েছে মার্টিনেজ। কেঁদে ফেলেছেন কোচ স্কালোনিও। 
মেসি সাংবাদিকদের মাঠেই বলে এসেছেন, ‘আমি তৃপ্ত কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে আরও কয়েকটি ম্যাচ খেলতে চাই। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলে খেলব এবার।’ বিশ্বকাপে আর না খেললেও অন্য প্রতিযোগিতায় জাতীয় দলের জার্সিতে দেখা যাবে তাঁকে। তবে অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস না দেখিয়েই মেসি বলেছেন, ‘আমি জানতাম, আমি জানতাম’। সৌদি আরবের কাছে প্রথম ম্যাচেই হারার পরে মেসি দেশের মানুষকে ভরসা দিয়েছিলেন, আমাদের ওপরে আস্থা রাখুন, আমরা আশাহত করব না। রডরিগো ডি পল বলেছেন, আমরা যন্ত্রণা পাওয়ার জন্যই জন্মেছি। 
ততক্ষণে আর্জেন্টিনায় শুরু হয়ে গেছে উৎসব। রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সের প্রাণকেন্দ্র অবলিস্কে ডি বুয়েনস আয়ার্সে সমবেত হতে শুরু করেছেন হাজার হাজার মানুষ। সংবাদমাধ্যমের হিসাবে শেষ পর্যন্ত ২০ লক্ষ মানুষের জমায়েত হয়ে গিয়েছিল। কেউ নাচছেন, কেউ ড্রাম বাজাচ্ছেন, কেউ গাইছেন। সমবেত কণ্ঠেই গান হচ্ছে: ‘ সয় আর্জেন্টিনো, আমি আর্জেন্টিনীয়, এ এমন অনুভূতি যা আমি সংযত রাখতে পারি না।’ কেউ উঠে পড়েছেৃন বাসস্ট্যান্ডের মাথায়, কেউ উঁচু বাড়িতে। আতশবাজির আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছে আকাশ। চলছে আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের এবারে কার্যত জাতীয় সঙ্গীত ‘মুচাচোস’। সেই আশার গান, যা আকাঙ্ক্ষা থেকে বাস্তবের মাটিতে মূর্ত হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। এই গান যে ব্যান্ডের মূল গান থেকে তৈরি সেই লা মোস্কা রাতেই শুরু করে এক খোলা কনসার্ট। স্টেডিয়ামে যে কথা বসিয়ে গাওয়া হচ্ছিল, সেই কথাতেই গেয়েছেন জনপ্রিয় এই ব্যান্ডের শিল্পীরা। 
জাতীয় পতাকায় ঢেকে গিয়েছে মূল রাস্তার চারপাশ, কিন্তু জনতার হাতে নীল-সাদা পতাকায় লেখা ‘১০’। মেসির জন্য কিন্তু মারাদোনার জন্যও। দিয়েগোকে এক মূহূর্তের জন্যও ভুলতে পারে না আর্জেন্টিনা। সাড়ে তিন দশকের অপেক্ষার পরে দু’জনই মিলে গিয়েছেন এক বিন্দুতে। দোহার লুসাইল স্টেডিয়ামের মাইক্রোফোনে মেসি একবার বলেছেন,‘ আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’। শুধু লুসাইলে নয়, গর্জনে ফেটে পড়েছে বুয়েনস আয়ার্স। 
সান্তা ফে অ্যাভিনিউর ফ্ল্যাট থেকে নেমে এসেছেন ৮০ বছরের বৃদ্ধ মারিও গুয়ারেল্লা। ‘ অবিশ্বাস্য এই জোশ, বিশুদ্ধ এক আনন্দ‘, বলছেন তিনি। মারিও বললেন, ‘অনেক ত্যাগ ও চেষ্টার ফল এই বিশ্বকাপ। আমাদের সমাজের বিভাজনকে কাটিয়ে এনে দিতে পারে ঐক্য’। ৪৩ বছরের মারিয়া জোসে জেনি বললেন, ‘আমি প্রায় পুরো ম্যাচের সময়েই কেঁদেছি। সব সময়ে আমাদের লড়াই করেই জিততে হয়। পরিশেষে এই আনন্দ।’ রডরিগো রনচেত্তির বয়স ৪০। এক বছরও হয়নি শিশুকন্যা আমান্দার। তাঁকে নিয়েই বেরিয়ে পড়েছেন। অবেলিস্ক পর্যন্ত যেতে পারবেন না, বুঝতেই পারছেন। আর্জেন্টিনার জার্সি পরা কন্যাকে দেখিয়ে বলেছেন, ‘ওর জীবনের সেরা দিন’। 
মানুষের মুখে শুধু মেসি। রুবেন ব্যারিওনুয়েভো বলেছেন, ‘ওর মতো আর কাউকে কোনোদিন দেখতে পাব না বলেই মনে হয়। তবে পরের প্রজন্ম উঠে আসছে। পাড়ার মাঠে অনেক ছেলেই ভালো খেলছে। তাদের কেউই এভাবে উঠে আসবে হয়ত।’  
মেসির শহর রোজারিওতে শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। অনেকেই চলে গেছেন সেই বাড়িতে যেখানে মেসির জন্ম। তাঁর আত্মীয়স্বজনদের বাড়ির সামনে রবিবার সারা রাত ধরে চলেছে ড্রাম বাজানো। মেসির মতো ডি মারিয়াও এই শহরের ছেলে। ‘ওরা যদি একবার আসে তাহলে সারা জীবনের সাধ পূরণ হবে’, বলছেন মাইসেলা লাউদ্রেস। 
দেশের রাষ্ট্রপতি আলবার্তো ফার্নান্ডেজ বলেছেন, আনন্দ প্রকাশের কোনও ভাষা নেই। শুধু এইটুকু বলার সবসময় একসঙ্গে, সমসময়ে ঐক্যবদ্ধ। চিলির রাষ্ট্রপতি গ্যাব্রিয়েল বোরিক টুইটারে লিখেছেন,‘ তোমাদের আনন্দ আন্দেস পেরিয়ে গেছে’। লাতিন আমেরিকার জয়  হিসাবে মহাদেশের মানুষের বড় অংশই দেখেছেন মেসিদের জয়কে। 
ভারতীয় সময় সোমবার গভীর রাতে বিশ্বজয়ীরা ফিরবেন স্বদেশে। সরকারিভাবেই উৎসব হবে তাদের নিয়ে। তবে, স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে জানানো হচ্ছে টিমকে অবেলিস্কে নিয়ে যাওয়া হবে না, নিরাপত্তার কারণে। এত মানুষ জড়ো হবেন যে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। 
আর্জেন্টিনার মানুষের সঙ্গে ফুটবলের সংযোগ নেহাত একটি খেলার পরিধিতে সীমায়িত নেই। ছিল না কখনও। এখন এই জয় এক নতুন আশার জন্ম দিয়েছে, আশা সংক্রামক। দেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জটিল। রাজনৈতিক ভাবেও অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চলছে অবিরত। বামমুখী উপ রাষ্ট্রপতিকে ভুয়ো মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই সঙ্কটকালে ফুটবলে বিশ্বজয় স্বস্তির ঝরনাধারা বিয়ে দিলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছেই।

 

Comments :0

Login to leave a comment