উত্তর প্রদেশের রামসেনাই ঘাটে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন জনতা দল নেতা বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, সিপিআই(এম) নেতা প্রকাশ কারাত, পার্টির তৎকালীন সাংসদ, ডিওয়াইএফআই’র সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ সেলিম প্রমুখ। ধৃতদের মধ্যে আরও ছিলেন সিপিআই নেতা চতুরানন মিশ্র, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা চিত্ত বসুও।
দিনটি ছিল ৫ডিসেম্বর, ১৯৯২!
কেন? তিরিশ বছর আগের সেই দিনগুলির কথা তুলে ধরতে গিয়ে বর্তমানে পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদক মহম্মদ সেলিম সোমবার বলেন,‘‘৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় করসেবার দিন ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াচ্ছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরএসএস, বিজেপি’র নেতারাও। আমরা তার বিরুদ্ধে, সম্প্রীতির আহ্বান নিয়ে লক্ষ্ণৌ থেকে অযোধ্যা যাচ্ছিলাম মিছিল করে। পুলিশ আমাদের পথ আটকায়। নয়াদিল্লিতে কৃষক সমাবেশ আটকাতে আমরা যেমন ব্যারিকেডের ব্যবস্থা দেখেছিলাম, তেমনই ব্যারিকেড করেছিল উত্তর প্রদেশ পুলিশ। আমাদের বলা হলো যাওয়া যাবে না।’’
গ্রেপ্তার হওয়ার আগে একটি সভা হয়েছিল সেখানে। আশপাশের গ্রামগুলি থেকে অনেকে, তাঁদের মধ্যে অনেকে কৃষক ছিলেন, তাঁরা চলে এসেছিলেন সেখানে। মহম্মদ সেলিম তিরিশ বছর আগের একটি ছবি সামনে নিয়ে এলেন। বললেন,‘‘সভা চলছিল। আমি গ্রামবাসীদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম একুট দূরে গিয়ে। বক্তৃতার সময় কোনও একজন বলেছিলেন, ‘সব কো এক রহেনা পড়েগা।’ ভিড়ের মাঝ থেকে এক গ্রামবাসী প্রশ্ন করে উঠেছিলেন,‘‘হাম জনতা এক রহেঙ্গে। আপ নেতা লোগ এক রহেঙ্গে কেয়া?’’
তার কয়েকদিন আগেই জনতার একতার আকাঙ্ক্ষা, এক অন্য ভারত উঠে এসেছিল।
দিনটি ছিল ২৫ নভেম্বর, ১৯৯২।
নয়াদিল্লিতে সেদিন লক্ষাধিক শ্রমজীবী সমবেত হয়েছিলেন। সিআইটিইউ সহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনগুলির স্টিয়ারিং কমিটির ডাকে হয়েছিল সংসদ অভিযান। ছিলেন ছাত্র, যুব, মহিলারাও। সেই সমাবেশ থেকে শ্রমিক, কর্মচারী আন্দোলনের নেতৃত্ব ঘোষণা করেন— সর্বনাশা আর্থিক নীতি বদল করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। নাহলে আন্দোলন ধাপে ধাপে তীব্র হবে। ডাকা হবে ভারত বন্ধ।
তার তিনদিন পর, ২৯ নভেম্বর তৎকালীন ভারতে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি পশ্চিমবঙ্গ দেখেছিল বৃহত্তম সমাবেশ। ব্রিগেডে। বামফ্রন্টের ডাকা সেই সমাবেশ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া আর্থিক নীতি এবং ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িকতার বিপদের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ ঘোষিত হয়েছিল।
রাজ্যে তখনই বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে মূলত মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে নানা বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছিল। ততদিনে ‘করসেবা’র নামে গোলমালের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সেই পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারকে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানানোর বদলে ‘বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে ৩৫৬নং ধারা’ প্রয়োগের দাবি জানিয়ে ২৫ নভেম্বর ব্রিগেডে প্রদেশ কংগ্রেসের নামে ডাকা সভা থেকে ‘কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করছি’ বলে ঘোষণা করেন আজকের তৃণমূল নেত্রী। যদিও সেই পদত্যাগ পত্র কখনও পৌঁছায়নি।
এমন অবস্থায় আসে ৬ ডিসেম্বর। বাবরি মসজিদের কাঠামো ভেঙে ফেলে উন্মত্ত বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরএসএস। দেশের প্রায় ৩৬০টি শহরে, বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে দাঙ্গা হয়। অনেকের মৃত্যু হয়। স্বাধীনোত্তর ভারতের অন্যতম জঘন্য ঘটনার রেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও ভারতের মাথা হেঁট করে দেয়।
মসজিদ ভাঙার দিন তো বটেই, আগের দিনও প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওকে ফোন করেছিলেন রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কমরেড জ্যোতি বসু। বারবার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গেও কিছু জায়গায় ৬ ডিসেম্বরের দিন এবং পরের কয়েকদিন দাঙ্গা হাঙ্গামা বাঁধানোর চেষ্টা করে দুষ্কৃতীরা। তার আগে পরে কয়েকদিন বামপন্থী আন্দোলনের কর্মীরা সভা, মিছিল, বাড়ি বাড়ি প্রচার চালিয়েছিলেন। মানুষকে ভরসা দিতে। সাহস জোগাতে।
পরিস্থিতি কড়া হাতে মোকাবিলা করেছিল বামফ্রন্ট সরকারও। মহম্মদ সেলিমের কথায়,‘‘৬ ডিসেম্বর আমি নয়াদিল্লিতে ছিলাম। সেদিন রবিবার ছিল। রাজ্য থেকে অনেকে ফোন করছিলেন। কিন্তু পার্টি আমাকে জানায়, আমাকে দিল্লিতে থাকতে হবে। কারণ সংসদ চলছে। সোম, মঙ্গল, বুধবার আমি দিল্লিতে থাকলাম। দিল্লিতেই দাঙ্গাপীড়িত মানুষের দুর্দশার খবর আসতে লাগল। আমরা নানা ভাবে তাঁদের পাশে দাঁড়ালাম।’’
বুধবার মাঝারাতে রাজ্যের বাসিন্দা বিমানকর্মীদের কয়েকজন পশ্চিমবঙ্গে একটি আনসিডিউলড ফ্লাইটে ফিরবেন বলে ঠিক ছিল। তাঁরা মহম্মদ সেলিমকে জানান। সেলিমের কথায়,‘‘আমি তাঁদের সঙ্গে ফিরলাম। কলকাতায় নেমে আমি দেখলাম রাস্তায় প্রচার হচ্ছে কার্ফু নিয়ে। আমি পার্টি অফিসে চলে এলাম। সেদিনই সকালে, ৯টা নাগাদ শ্যামলদা, মানব বলল চলো রাইটার্স যাবো। মানব একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করল। সেই ট্যাক্সিতে আমরা রাইটার্স গেলাম। বুদ্ধদার ঘরে গেলাম। কিছুক্ষণ পর খবর এল জ্যোতি বসু এসেছেন। সেদিন অন্য জ্যোতি বসুকে দেখলাম। ‘আবিষ্কার’ করলাম বলাই ভালো। আমাকে দেখেই বললেন,‘তুমি এখানে?’ বললাম আনসিডিউল্ড ফ্লাইটে চলে এসেছি। সঙ্গে সঙ্গে বললেন,‘তাহলে তো কিছু খাওয়া হয়নি। কিছু খেয়ে নাও।’ আমি বুঝলাম এই সঙ্কটের মুহূর্তেও যিনি এত খুঁটিনাটি নজর রাখছেন, পরিস্থিতি তাঁর নিয়ন্ত্রণে। কয়েকদিন পরে দূরদর্শনে তাঁর একটি আহ্বান রেকর্ড হলো। সেদিন দূরদর্শনের সাংবাদিককে বলেছিলেন সেলিমও বলবে। ওর কথাও নাও। সেই প্রথম আমার টিভির পর্দায় কিছু বলা। আমি তখন একজন সাংসদ শুধু। পার্টির পক্ষ থেকে কিছু বলার দায়িত্বও আমার নয়। অনেক পরে বুঝেছিলাম কেন সেদিন কমরেড জ্যোতি বসু আমাকেও কিছু কথা বলতে বলেছিলেন।’’
পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গাবাজরা মাথা তুলতে পারেনি সেই দিনগুলিতে। দাঙ্গাকারীদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হয় বাজার এলাকাগুলি। সেদিন সরকার সব দিকে নজর রেখে ব্যবস্থা নিয়েছিল। বামপন্থী আন্দোলনের কর্মীরা আক্রান্ত হয়েছিলেন। যেমন জগদ্দলে দাঙ্গার অপচেষ্টা রুখে দিতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন সিপিআই(এম) নেতা নেপালদেব ভট্টাচার্য সহ অনেকে।
‘‘আমরা গোটা কলকাতা চষে ফেলেছিলাম। আমি আর মানব। একটি গাড়িতে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় আমরা ছুটে বেরিয়েছি শান্তি, সম্প্রীতি রক্ষার জন্য। সাহস জোগাতে। কারণ ভয় থাকলেই দাঙ্গা মাথা চাড়া দিতে পারে।’’
Comments :0