দীপাঞ্জনা দাশগুপ্ত দে
২ মে রাজ্য সরকারি ও সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে ছুটি পড়বে তা এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়েই জানিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। শিক্ষা মন্ত্রী একজন আছেন, নামেই মাত্র, কিন্তু সমস্ত সিদ্ধান্ত মমতা ব্যনার্জিরই।
এপ্রিলের ১৭ থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত অতিরিক্ত গরমের জন্য এক সপ্তাহ ছুটি দিলেও তারপর মাত্র এক সপ্তাহের জন্য স্কুল খোলে। ফের ২ মে থেকে পড়ে যায় গরমের ছুটি। যদিও সে অর্থে আপাতত গরম নেই রাজ্যে।
এর আগে করোনা অতিমারীর সময় টানা দু’বছর সমস্ত স্কুল বন্ধ রেখেছিলেন তিনি। ২০২২’র শুরু থেকে অভিভাবক এবং ছাত্র আন্দোলনের চাপে অবশেষে স্কুল খুলতে বাধ্য হলেও সপ্তাহে তিনদিন করে চলত স্কুল। এদিকে সারা দেশে ততদিনে চলছে স্কুল কলেজ। কিছুদিন কোনও মতে স্কুল খোলার পর ফের গরমের নামে টানা দু’মাসের বেশি বন্ধ থাকে স্কুল ও কলেজ। গরমের ছুটি দেওয়ার জন্য যেন মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
সরকারি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দাবি স্কুল ছুটি থাকলে শুধু পড়াশোনারই ক্ষতি হয় তা নয়, মিড-ডে মিল রান্না করা গরম গরম সুষম আহার থেকে বঞ্চিত হয় পড়ুয়ারা। উলুবেড়িয়ার বীণাপানি বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহম্মদ জাহাঙ্গির হোসেন বলছেন, ‘‘এবছর রাজ্য সরকার হঠাৎই ‘অতিরিক্ত পুষ্টি প্রকল্প’ (অ্যাডিশনাল নিউট্রিশন প্রোজেক্ট) নামে একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। তাতে প্রতি ছাত্র-ছাত্রী পিছু ২০ টাকা করে বরাদ্দ করেছিল সরকার। কিন্তু এই প্রকল্প ছিল জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। অর্থাৎ মে থেকে কোনও বরাদ্দ ছিল না। সরকার এক প্রকার নিশ্চিত করেই ফেলেছিল যে মে’মাস থেকে ছুটি দেবে। এবার স্কুল খুললে এই প্রকল্পের কি হবে তা জানা নেই।’’
হোসেন বলছেন, ‘‘বিশেষ এই পুষ্টি প্রকল্পে শিশুদের অতিরিক্ত ডিম, ফল এবং সপ্তাহে একদিন করে মাংস দেওয়া হত। এমনি মিড-ডে মিল প্রকল্পে শিশু প্রতি প্রাথমিকে সাড়ে ৬ টাকা ও উচ্চ প্রাথমিকে অর্থাৎ ক্লাস ফাইভ থেকে এইট পর্যন্ত ৮ টাকা করে বরাদ্দ। সেখানে পড়ুয়াদের সপ্তাহে একদিন হয়তো ডিম দেওয়া হয়। আর মাসে একদিন মাংস। তবে গরমের ছুটি পড়ে যাওয়ায় বাচ্চারা কোনও আহারই পাবে না। গত বছর শুকনো খাবার শিশুদের দেওয়া হলেও এবার সেই রকম কোনও নির্দেশ নেই। তারপরেও স্কুল কবে খুলবে তাও বলেনি শিক্ষা দপ্তর।’’ এই প্রথম এরকম অনির্দিষ্ট কালের জন্য গরমের ছুটির নির্দেশ এসেছে বলেও জানাচ্ছেন হোসেন।
নিখিল বঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহন দাস পন্ডিত বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনকে সামনে রেখেই মে‘মাস পর্যন্ত এই প্রকল্প রাখা হয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে। তবে শুধু মাত্র ১৬ সপ্তাহের জন্যই, তারপর একটি শিশুর পুষ্টির দরকার আর নেই!’’ এমন প্রকল্প চালু করার পেছনে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে, বলছেন মোহন দাস পন্ডিত। তিনি আরও জানান যে স্কুল বন্ধ রাখলে সরকারের মিড-ডে মিলের খরচ অনেকটাই বেঁচে যায়। প্রাথমিকে ৭২ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী ও উচ্চ প্রাথমিকে ১১ লক্ষ পড়ুয়ার মিড-ডে মিলের খরচ বেঁচে যাওয়া কম কথা নয়। সেই সঙ্গে ৮ লক্ষ পড়ুয়া সরকারি শিক্ষা মাধ্যম ছেড়ে গেছে। এই ভাবে ছুটি চলতে থাকলে আরও পড়ুয়া বেসরকারি স্কুলের প্রতি আকৃষ্ট হবে। তাহলে সরকার স্কুল শিকেয় তুলে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করতে পারবে।
পণ্ডিত বলছেন, ‘‘শুকনো খাবারের নামে যদি শিশুদের এক প্যাকেট যদি কেবল ডাল-চাল দিয়ে দেওয়া যায় তাহলে মিড-ডে মিলের টাকায় আরও উৎসব, মুখ্যমন্ত্রীর স্টেজের জন্য খরচ করা সম্ভব। করোনা অতিমারীর সময় স্কুল বন্ধ রেখে শুধু ডিমের খরচ থেকে ৭২০ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছে মমতা ব্যনার্জির সরকার।’’
শিক্ষকরাই বলছেন, এভাবে কথায় কথায় স্কুল ছুটি রাখার পেছনে মুখ্যমন্ত্রীর দুরভিসন্ধি গভীর। একদিকে রাজ্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ নষ্ট করে ফেলা, আরেকদিকে ছলে বলে কৌশলে ছাত্র সংখ্যা কমিয়ে স্কুল গুলোকে বন্ধ করে দেওয়া। সর্বপরি মিড-ডে মিলের খরচ কমিয়ে অপুষ্টির মুখে ফেলা হচ্ছে শিশু-কিশোরদের।
Comments :0