কর্ণাটকের রামনগর জেলায় এক পশু ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে মারলো স্বঘোষিত গোরক্ষকরা। তাদের যদিও ‘গো রক্ষা’ নিয়ে উদ্বেগ কম, উদ্দেশ্য ছিল ২ লক্ষ টাকা আদায়। লাইসেন্সধারী ওই ব্যবসায়ী গোরক্ষকদের টাকা দিতে অস্বীকার করায় তাঁকে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে। রামনগর জেলার সাথানুর গ্রামে রাস্তার ধারে ব্যবসায়ী ইদ্রিশ পাশার দেহ উদ্ধার হয়েছে। তাঁর দুই সঙ্গীও জখম হয়েছেন। এদিকে বিধানসভা ভোটের নির্বাচনী প্রচারে হিন্দুত্ববাদীরা এই ঘটনাকে মেরুকরণের কাজে লাগাচ্ছে। টাকা আদায়ের আসল ঘটনাকে চেপে দিয়ে গোরক্ষার ‘মহৎ’ কাজকে সামনে তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ডি কে শিবকুমারের বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে ওই এলাকা।
জানা গেছে, শুক্রবার রাতে ইদ্রিশ পাশা তাঁর দুই সঙ্গী ইরফান ও সৈয়দ জাহির গবাদি পশু নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদের কন্টেনারে ১৬টি পশু ছিল। গোরক্ষক দলের প্রধান পুনীত কেথেরাল্লি তার দলবল নিয়ে তাদের আটকায় সাথনুর গ্রামে। ঘটনাস্থল বেঙ্গালুরু থেকে ২০ কিমি দূরে। অভিযোগ করে, বেআইনিভাবে গোরু পাচার করা হচ্ছে জবাই করার জন্য। ইদ্রিশ পাশা তাদের গবাদি পশু পরিবহণের কাগজপত্র দেখান। গবাদি পশু কেনা এবং বিক্রি করার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যে তাঁর কাছে রয়েছে তা দেখান ইদ্রিশ পাশা। গবাদি পশুর কেনাবেচার বাজারের কাগজও দেখান তিনি। গবাদি পশু কেনার বিলও দেখান। কোনোভাবেই যে তারা বেআইনিভাবে পশু কেনাবেচা বা জবাই করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে না, তার সব তথ্য প্রমাণই দেন গোরক্ষক বাহিনীর কাছে। কিন্তু সেকথা মানতে নারাজ পুনীত কেথেরাল্লি আর তার দলবল। তারা পাশাকে হুমকি দিয়ে বলে এইসব ব্যবসা পাকিস্তানে গিয়ে করো। ভারতের হিন্দুপ্রধান এলাকায় এইসব করা চলবে না।
হিন্দু, গোরক্ষা, পাকিস্তান এইসব ছিল কথার কথা। গোরক্ষাও বাহানা। গোরক্ষক বাহিনীর আসল মতলব ছিল ইদ্রিশ পাশার থেকে মোটা টাকা আদায় করা। তারা ইদ্রিশের থেকে ২লক্ষ টাকা দাবি করে। ইদ্রিশ তা দিতে অস্বীকার করেন। এই নিয়ে বচসা শুরু হয়। পুনীত কেথেরাল্লির গোরক্ষা বাহিনীকে বাধা দেন ইদ্রিশ। তখনই তাঁকে আক্রমণ করে প্রচণ্ড মারধর করে স্বঘোষিত ওই গোরক্ষকরা। রক্তাক্ত ও গুরুতর আহত অবস্থায় রাস্তার ধারে ইদ্রিশকে ফেলে রাখে পুনীত আর তার বাহিনী। তারাই ইদ্রিশের সঙ্গী ইরফান এবং জাহিরকেও মারধর করে ধরে নিয়ে যায় সাথনুর থানায়। গোরক্ষকদের অভিযোগের ভিত্তিতে দুই জনের বিরুদ্ধে নানাবিধ ধারায় অভিযোগ দায়ের করে দিয়েছে কর্ণাটকের বিজেপি সরকারের পুলিশ।
এদিকে শনিবার সকালে রাস্তার ধার থেকে উদ্ধার হয় ইদ্রিশ পাশার দেহ। কর্ণাটকের মান্ড্য জেলার বাসিন্দা ওই ব্যবসায়ী। ইরফান এবং জাহির এক পুলিশ কনস্টেবলের থেকে জানতে পারেন যে, ইদ্রিশের দেহ মিলেছে। হত্যার খবরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন তাঁর পরিজন এবং প্রতিবেশীরা। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের দাবিতে তাঁরা বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। এরপরে পুলিশ এসে আশ্বাস্ত করলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। পুলিশ পুনীত কেথেরাল্লি এবং তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে হত্যা সহ বিভিন্ন ধারায় মামলা দায়ের করেছে। কিন্তু রবিবার রাত পর্যন্ত কেউই ধরা পড়েনি।
হিন্দুত্ববাদীদের দক্ষিণ ভারতের গবেষণাগার হিসাবে কর্ণাটক পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়েও সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং হিংসার ঘটনা লাগাতার সামনে এসেছে কর্ণাটকে। কখনও হিজাব, কখনও টিপু সুলতান, কখনও ধর্মান্তরণ রোখার নামে দমনমূলক আইন, অথবা সংরক্ষণ নিয়ে মেরুকরণের চেষ্টা লাগাতার হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক হিংসা এবং হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। রামনবমী উদ্যাপনের নামে হিংসা হয়েছে সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপরে আবার বড়দিনের সময়ে হামলা চলেছে খ্রিস্টানদের উপরে। আক্রান্ত হয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষ-অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবীরা। বিজেপি’র নেতা, মন্ত্রী, সাংসদরা পাল্লা দিয়ে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়িয়েছেন। বিশেষ করে কংগ্রেস-জেডি (এস) সরকার ভেঙে রাজ্যে সরকারের দখল নেওয়ার পর থেকে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। সরাসরি প্রশাসনের মদত পেয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা। ভোটের সময়েও এই মেরুকরণের লক্ষ্যেই গোরক্ষার নামে ইদ্রিশকে হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
Comments :0