Post Editorial

‘করেন ক্যানে গুলি। দেখং তোমরা, বন্দুক আগত যায় না মোর তির আগত যায়’।

উত্তর সম্পাদকীয়​


অশোক ভট্টাচার্য 

আলিপুরদুয়ার জেলার কুমার গ্রাম দুয়ার। এক সময় এই অঞ্চলটি ছিল জলপাইগুড়ি জেলার ডুয়ার্স অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। তারও আগে ১৮৬৪ থেকে ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত তিস্তা থেকে সংকোশ নদীর পূর্বপার পর্যন্ত ১২৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এলাকাটি ছিল পশ্চিম ডুয়ার্স জেলার অন্তর্ভুক্ত। ১৮৬৯ সালে গঠিত হয় জলপাইগুড়ি জেলা এবং পশ্চিম ডুয়ার্স জেলাটি অন্তর্ভুক্ত হয় জলপাইগুড়ি জেলার মধ্যে। এরপর আত্মপ্রকাশ করে জলপাইগুড়ি জেলার অধীন আলিপুরদুয়ার মহকুমা। ২০১৪ সালে আলিপুরদুয়ার মহকুমা পরিণত হয় আলিপুরদুয়ার জেলায়। এক সময় এই সমগ্র ডুয়ার্স অঞ্চলটি ছিল ভুটানরাজের অথবা কোচবিহার করদ রাজ্যের সাথে। ১৮৬৫ সালের ১১ নভেম্বর স্বাক্ষরিত হয় ব্রিটিশ ভারত ও ভুটান রাজের মধ্যে সিঞ্চুলা চুক্তি। তারপর থেকে সমগ্র ডুয়ার্স অঞ্চল ব্রিটিশ ভারতের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। ভারত-ভুটানের মধ্যে ১৮টি দুয়ার বা ডুয়ার্স রয়েছে। তিস্তা নদীর পূর্বপার থেকে সঙ্কোশ নদী পর্যন্ত যুক্ত হয় অবিভক্ত বাংলা প্রদেশের সাথে। যাকে বলা হয় বাংলা ডুয়ার্স বা ভুটান ডুয়ার্স। বাকি ৭টি দুয়ার, ধানসিড়ি নদীর পশ্চিমপাড় পর্যন্ত যুক্ত হয় আসাম প্রদেশের সাথে। কালিম্পং মহকুমা ভুটান থেকে বিযুক্ত হয়ে যুক্ত হয় দার্জিলিঙ জেলার সাথে। 
কুমার গ্রাম দুয়ার নাম হলেও কুমার গ্রামে সেই অর্থে কোনও দুয়ার নেই। কুমার গ্রাম একটি ব্লক। তার পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে রায়ডাক নদী, পূর্ব প্রান্তে রয়েছে সঙ্কোশ নদী। সঙ্কোশ নদীর পূর্ব পারেই আসামের শ্রীরামপুর, গোয়ালপাড়া জেলা। উত্তরদিকে রয়েছে হিমালয়ান ভুটান পাহাড়। তার গায়েই অবস্থিত ঐতিহাসিক বক্সা দুর্গ। এই অঞ্চলে রয়েছে শতাধিক চা বাগান। 
জলপাইগুড়ি জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক ইতিহাসের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে কুমার গ্রাম দুয়ারের রয়েছে একটি বিশেষ ভূমিকা। কুমার গ্রামে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করছে বিভিন্ন ধরনের আদিবাসী বা উপজাতি ও আদি অধিবাসী। ভুটান পাহাড় ঘেঁষা অঞ্চলে মূলত বসবাস করে ডুকপা, টোটো, ভুটিয়া, শেরপা, লেপচা ইত্যাদি পাহাড়ী উপজাতিরা। দীর্ঘকাল ধরে কুমার গ্রাম বা ডুয়ার্সের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করে আসছে রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষ। তারাই এই অঞ্চলের আদি অধিবাসী। বসবাস করে মেচ, রাভা, গারো, তামাং, টোটো, লিম্বু ইত্যাদি ইন্ডিজিনাস উপজাতি মানুষরা। ১৮৭৬ সালে ডুয়ার্স অঞ্চলে চা বাগানের পত্তন হয়। চা বাগিচায় কর্মসংস্থানের আশায় ছোটনাগপুর, পূর্ব ও মধ্য ভারত থেকে হাজার হাজার আদিবাসী শ্রমজীবী মানুষদের সংগঠিত ভাবে ডুয়ার্স, তরাই ও আসামে নিয়ে আসা হয়। এই সমস্ত আদিবাসীদের মধ্যে রয়ছে ওঁরাও, মুণ্ডা, সাঁওতাল, মালপাহাড়িয়া, বরাইক, চিক বরাইক, লোহাড়, নাগেশিয়া, খড়িয়া, মহলি ইত্যাদি প্রায় ৪১টি উপজাতি অংশের মানুষ। তারা বর্তমানে এই সমস্ত অঞ্চলের বিভিন্ন চা বাগানে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছে। এদের ৯০ শতাংশ মানুষ হিন্দু। এছাড়াও দেশ ভাগের পরে লক্ষাধিক মানুষ ছিন্নমূল উদ্বাস্তু হয়ে এপার বাংলায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে ডুয়ার্স বা তরাই এলাকায়। বর্তমান ডুয়ার্সের চা-বাগান ও গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের মধ্যে ৫২ শতাংশের বেশি ওঁরাও আদিবাসী মানুষ। 
এই নিবন্ধের চর্চার বিষয় রাজবংশী, রাভা, মেচ, গারো, নেপালি এবং চা বাগানের আদিবাসী, বিশেষ করে ওঁরাও আদিবাসীদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও ইংরেজ প্ল্যান্টার্স বা চা বাগানের মালিকদের বিরুদ্ধে লড়াই, সংগ্রাম ও প্রতিবাদী আন্দোলনের ইতিহাসকে গভীরভাবে জানা বা বোঝা। 
ডুয়ার্সের চা বাগানের শ্রমিকদের বিশেষ করে ওঁরাও শ্রমিকদের টানা ভগৎ আন্দোলনের কথা অনেকেরই জানা নেই। বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী রণজিৎ দাশগুপ্তের লেখা ওঁরাও লেবার এজিটেশন, ডুয়ার্স, ইন্ জলপাইগুড়ি ডিস্ট্রিক্ট ১৯১৫-১৬ এবং এমবিগুইটিস অব ক্লাস ফর্মেশন: ইন দা ডুয়ার্স ১৮৯০-১৯৪৭, লেখা দুটি প্রণিধানযোগ্য। এছাড়াও আরও কিছু জানা যায় ১৯১৭ সালে প্রকাশিত ডুয়ার্স প্ল্যানটার্স অ্যাসোসিয়েশন রিপোর্ট থেকে (DPA Report) |
কুমার গ্রামের দলদলি গ্রামের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ মঘা দেওয়ানী (দাস)-র বাড়ি। এই-বাড়িতে এখন থাকেন তাঁর প্রপৌত্র করুণা কান্ত দাস ও তার পরিবার। তাঁরা দুটো আন্দোলনের কথা বলেছিলেন। প্রথমত কুলকুলি হাট বন্দু আন্দোলন (১৯২১ সালে)। তখন দেশে চলছিল অসহযোগ আন্দোলন। কুমার গ্রামের কুলকুলি হাটে ইংরেজ ও তার অধস্তনরা, বিশেষ করে কুমার গ্রাম চা বাগানের ইংরেজ ম্যানেজার ও তার কর্মচারীরা জোরজবস্তি করে অর্থ আদায় করতো। জোর করে কর চাপিয়ে দিত। এর প্রতিবাদে মঘা দেওয়ানি ও পশুপতি কুঁয়ার কুলকুলি হাটে একটি জনসভা আহ্বান করেন। তাঁরা হাটে ইংরেজদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করেন ও হাট অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাবার দাবি করেন। মঘা দেওয়ানি ছিলেন একজন গান্ধীবাদী ও রাজবংশী কৃষক। পশুপতি কুঁয়ার ছিলেন একজন রাভা কৃষক। মঘা দেওয়ানি এবং পশুপতি কুঁয়ারকে এই আন্দোলনের জন্যে ইংরেজ পুলিশ গ্রেপ্তার করে আলিপুরদুয়ার আদালতে নিয়ে যায়। গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হাজার হাজার মানুষ আদালত প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। তারা মঘা দেওয়ানির নিঃশর্তে মুক্তি ও হাটে ইংরেজদের অত্যাচার বন্ধ করার দাবি জানায়। এই আন্দোলনের ফলে ম্যাজিস্ট্রেট দু’জনকেই মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং হাট স্থানান্তরের দাবি মেনে নেয়। হাজার হাজার আন্দোলনকারী এই দুই জয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তারা মনে করেন হাটের স্থান পরিবর্তন ও মঘা দেওয়ানির নিঃশর্ত মুক্তি আদায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের দুটি বড় জয়। এইভাবেই ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ডুয়ার্সের বিভিন্ন হাটে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। 
মঘা দেওয়ানির প্রপৌত্র করুণা দাস ১৯৪২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরে কুমার গ্রামে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের দিনটির কথাও সবিস্তারে বলেছিলেন। সেই আন্দোলনের পরিকল্পনা হয়েছিল ঐ বছর ৮ সেপ্টেম্বর মঘা দেওয়ানির ছোট দলদলির বাড়িতে। সেই সভায় ছিলেন মঘা দেওয়ানি। আজও সেই বাড়ির সভা গৃহটি সুরক্ষিত রয়েছে। ডুয়ার্স এলাকায় বিভিন্ন হাটে হাটে ইংরেজদের অত্যাচার, জোর করে অর্থ আদায় ইত্যাদির বিরুদ্ধে গ্রামবাসী ও চা বাগানের শ্রমিকদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। অন্য অনেক হাটে রাজস্ব প্রদান বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯২৭ সালে হয় সাইমন কমিশন বর্জন আন্দোলন। অসহযোগ আন্দোলন সবচাইতে বেশি ছড়িয়ে পড়ে কুমার গ্রাম এলাকায়। যদিও সেই সময় চা বাগান ও গ্রামাঞ্চলে কোনও সংগঠিত বা রাজনৈতিক ও ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বেও কোন আন্দোলন হয়নি। তা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। অবশ্য গ্রাম ও চা বাগানের আদিবাসীদের মধ্যে গান্ধীজীর কিছু প্রভাব ছিল। 
১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ব্যাপক প্রস্তুতিসভা শুরু হয় কুমার গ্রামের গ্রামে গ্রামে। রাতে এর জন্য প্রস্তুতি সভাগুলি হত। ৮ সেপ্টেম্বর মঘা দেওয়ানির বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় এক গোপন সভা। সেখান থেকে স্থির হয় ২৬ সেপ্টেম্বর হবে কুমার গ্রাম থানা দখল। হাজার হাজার মানুষ তিন দিক দিয়ে থানা ঘেরাও করে। তারা বন্দে মাতরম স্লোগান দিতে থাকে। ব্রিটিশ পতাকা ফেলে দিয়ে থানায় লাগিয়ে দেওয়া হয় ত্রিবর্ণ রঞ্জিত ভারতীয় পতাকা। থানার ওসি সহ সমস্ত পুলিশরা আত্মসমর্পণ করে। বাইরে থেকে যাতে পুলিশ বা সেনা বাহিনী আসতে না পারে, সেই জন্যে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। রায়ডাক নদীতে সমস্ত নৌকাগুলি ডুবিয়ে দেওয়া হয়। 
মঘা দেওয়ানি ছিলেন একজন গান্ধীভক্ত। ১৯৪৮ সালে গান্ধী হত্যার পর থেকে আজ পর্যন্ত ঐ বাড়িতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় একটি প্রদীপ জ্বালানো হয় মহাত্মা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, যা অন্য কোনও স্থানে হয় বলে আমার জানা নেই। 
পশ্চিম ডুয়ার্স এলাকায় সবচাইতে বড় আন্দোলন ছিল ওঁরাও আদিবাসীদের বিভিন্ন চা বাগানে টানা ভগৎ আন্দোলন। এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯১৪ সালে। প্রথমে রাঁচীর গ্রামে গ্রামে। তখন তা ছিল সমাজ ও ধর্মসংস্কার মূলক আন্দোলন। যদিও উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ মুক্ত গ্রাম গঠন। পরে কয়েক লক্ষ ওঁরাও অভিবাসী হয়ে আসে ডুয়ার্স, তরাই ও আসামের চা বাগানে। ডুয়ার্সে ১৯১৫-১৬ সাল থেকে টানা ভগৎ আন্দোলন প্রসারিত হয়। ওঁরাও শ্রমিক লাইনে শুরু হয় রাতে রাতে ওঁরাও শ্রমিকদের সভা। ক্রমেই এই সমস্ত সভাগুলি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, ইংরেজ চা বাগান মালিক বিরোধী, ইংরেজ মুক্ত দেশের দাবিতে আন্দোলনে পরিণত হয়। ওরাও শ্রমিকরা নিজেদের ভাষায় গান বাঁধে। তাদের লক্ষ্য ছিল দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানো, ইংরেজ প্ল্যান্টার্সদের অত্যাচার বন্ধ করা। ক্রমেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকে নাগরাকাটা, মাল, বীরপাড়া, মাদারিহাট ইত্যাদি ব্লক এলাকায়। বিভিন্ন চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে টানা ভগৎ আন্দোলনের দু’জনের নাম পাওয়া যায়। একজন মঙ্গল দাস ভগৎ, অন্যজন শালহা মণ্ডল, দু’জনই চা বাগানের আদিবাসী শ্রমিক। 
ওঁরাও শ্রমিকদের গানের মূল কথা ছিল জার্মান বাবা আসছে শীঘ্রই। জার্মান বাবা এসে ইংরেজ মুক্ত ভারত তৈরি করবে। তারা ইংরেজদের তাড়াবে। ওঁরাওদের চাষ ও বসবাসের জমির ব্যবস্থা করবে। আতঙ্কিত হয়ে ওঠে ইংরেজ চা বাগানের মালিকরা। ওঁরাও শ্রমিকদের ওপর শুরু হয় ছাঁটাই, বহিষ্কার ইত্যাদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। অন্যদিকে অত্যাচার যত বাড়তে থাকে, ততই শুধু ওঁরাও শ্রমিক নয়, যারা অ-ওঁরাও আদিবাসী শ্রমিক তারাও এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে শুরু করল। একের পর এক চা বাগানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও ইংরেজ মালিকদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। আওয়াজ উঠতে শুরু করল ইংরেজ জমানার দিন শেষ হতে চলেছে। জার্মান বাবা এল বলে। শ্রমিকরা চা বাগানে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধেও তুলেছিল আওয়াজ। 
ডুয়ার্স প্ল্যানটার্স এসোসিয়েশন (DPA) আতঙ্কিত হয়ে সমস্ত চা বাগান মালিকদের হুঁশিয়ার করে দিল। পুলিশ, প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হলো, যাতে তারা ভগৎ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তারা এই আন্দোলনে ওঁরাও ভাষায় গানের মর্মার্থ বুঝতে চেষ্টা করতে থাকলো। প্রথম প্রথম তারা বুঝেছিলেন এই আন্দোলন ধর্মীয়। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। ক্রমেই তারা বুঝলো এই আন্দোলন শুধু ইংরেজ চা বাগানের মালিক বিরোধী নয়, এই আন্দোলন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, প্ল্যানটেশন পুঁজিবাদ বিরোধী ও ইংরেজ মুক্ত ভারতের পক্ষে। কিন্তু জলপাইগুড়ি জেলার ভদ্রলোক বা উচ্চ বর্ণের হিন্দু মধ্যবিত্তদের থেকে এই আদিবাসী শ্রমজীবী মানুষরা বিচ্ছিন্ন ছিল। 
যদিও একই সময়ে জলপাইগুড়ি জেলার ভদ্রলোকদের নেতৃত্বে চলছিল স্বাধীনতা আন্দোলন। কিন্তু তারা টানা ভগৎ আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী ছিলেন না। রণজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন, এই আন্দোলনকে সমর্থন করে অমৃত বাজার পত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল। এজন্যে ইংরেজরা ব্যবস্থা নিয়েছিল অমৃতবাজার পত্রিকা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। তাঁর মতে, এই আন্দোলন ছিল একটি শ্রেণিভিত্তিক প্ল্যান্টেশন পুঁজিবাদ বিরোধী, শ্রমিকদের একটি সম্মিলিত ও সংঘবদ্ধ আন্দোলন। যদিও এই আন্দোলন ইতিহাসে একটি সাব অলটার্ন আন্দোলন হিসাবেই রয়ে গেছে। ১৯১৬ সাল থেকে জলপাইগুড়ি জেলার ডুয়ার্স অঞ্চলে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা ওরাও শ্রমিকদের টানা ভগৎ আন্দোলন হতে পারে, হাট দখল, রাজস্ব বয়কট, অসহযোগ, থানা দখল ইত্যাদি আন্দোলন হতে পারে, তবে তা ছিল দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত। ডুয়ার্স এলাকায় তাতে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের প্রায় সকলেই ছিলেন ওড়াও, মেচ, রাভা, মুন্ডা, রাজবংশী ইত্যাদি জনজাতির মানুষ। কুমার গ্রাম থানা দখলের আন্দোলনকারিদের লক্ষ করে পুলিশ যখন গুলি ছুঁড়বার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন একজন রাজবংশী কৃষক চিৎকার করে পুলিশকে লক্ষ্য করে বলেছিল তার নিজস্ব ভাষায় "করেন ক্যান গুলি। দেখং তোমরা, বন্দুক আগত যায়, না মোর তির আগত যায়।" আন্দোলনকারীদের রণং দেহী মূর্তি দেখে কুমার গ্রাম থানার পুলিশ সরে যেতে বাধ্য হয়। যদিও ডুয়ার্সের জনজাতিদের ঐ আন্দোলন কোনও সংগঠিত আন্দোলন ছিল না। সেই সময় চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে কোনও ট্রেড ইউনিয়ন বা কৃষক সংগঠনও গড়ে ওঠেনি। ডুয়ার্স এলাকার মধ্যে কুমার গ্রামই ছিল অগ্রণী। পরবর্তীকালে জলপাইগুড়ি জেলার ডুয়ার্স ও তরাই এলাকায় যেমন চা বাগান শ্রমিকদের বহু আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল আবার কৃষকদের আন্দোলন হয়েছিল তেভাগার দাবিতেও। চা বাগানের শ্রমিকরা দাঁড়িয়েছিল কৃষকদের তেভাগার দাবিতে আন্দোলনের পাশে। এই সমস্ত আন্দোলনে বিএ রেলওয়ের শ্রমিক-কর্মচারীরা ছিল শ্রমিক কৃষকদের পাশে। তখন জ্যোতি বসু ছিলেন রেল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। ডুয়ার্সে চা বাগানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে আদিবাসীরা পুলিশের গুলিতে নিহত হয়ে শহীদ হয়েছিলেন। কয়েকজনকে ফাঁসি বা দ্বীপান্তরের শাস্তিও দেওয়া হয়েছিল। 
১৯৪৫ সালে গঠিত হয় দার্জিলিঙ-জলপাইগুড়ি জেলার চা শ্রমিক ইউনিয়ন। যার সভাপতি হয়েছিলেন রতনলাল ব্রাহ্মণ। ডুয়ার্সে চা বাগান শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনে বহু কৃষক ও চা বাগানের শ্রমিক পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল। এদের বেশির ভাগই ছিলেন আদিবাসী। সবচাইতে বেশি শ্রমিক পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন জলপাইগুড়িতে জেলার ওদলাবাড়ি চা বাগানের আদিবাসী চা শ্রমিক ও গ্রামের কৃষকরা। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি ও ইংরেজ চা বাগান মালিকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে শ্রমিকরা পরিণত করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে। শ্রমিকরা আওয়াজ তোলে, ‘বিলেতি মালিক লন্ডন ভাগো’। 
দার্জিলিঙ পার্বত্য এলাকাতেও গোর্খা চা শ্রমিকরাও ইংরেজ চা বাগান মালিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলকে পরিণত করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে। এভাবেই জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিঙ জেলার চা বাগান শ্রমিকদের শ্রেণি আন্দোলন রূপান্তরিত হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে। ইতিমধ্যে এই দুই জেলাতেই লাল ঝান্ডার নেতৃত্বে চা বাগান শ্রমিকদের নিয়ে পৃথক পৃথক ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয়। তৈরি হয় গ্রামে কৃষকসভার সংগঠনও। ক্রমেই চা বাগানের আদিবাসী ও গ্রামের কৃষকদের আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। 
ডুয়ার্সে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এই এলাকার চা বাগানের আদিবাসী শ্রমিক ও গ্রামের রাজবংশী কৃষক ও দোমোহনির রেল শ্রমিক কর্মচারীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে শ্রেণি আন্দোলন শুরু করেছিল সেই আন্দোলনই পরিণত হয়েছিল দেশকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ মুক্ত করার আন্দোলনে।

Comments :0

Login to leave a comment