Lunching

দুই যুবককে পিটিয়ে মেরেই ‘স্বাগতম’ মোদী ৩.০

জাতীয়

ফের শুরু হয়ে গেল। নতুন মেয়াদ, পুরানো গল্প। পিটিয়ে মানুষ মেরেই স্বাগত জানানো হলো ‘মোদী ৩.০’-কে।

ছত্তিশগড়ে শুক্রবার রাতে উত্তর প্রদেশ থেকে আসা দুই মুসলিম শ্রমিককে কিছু লোক পিটিয়ে মেরে ফেললো। অপরাধ, ওরা মুসলিম, ওরা ট্রাকে করে গোরু-মোষ নিয়ে যাচ্ছিল। তাই চটজলদি শাস্তির বিধান— ‘গোরক্ষার নামে’ পিটিয়ে মারো মানুষকে। যে দেশে থাপ্পড় ‘সন্ত্রাসবাদ’, সেখানে দল বেঁধে পিটিয়ে মারাকে তো ‘জাতীয়তাবাদ’-এর তকমা দিতেই হবে। ‘ওয়েলকাম টু হিন্দুরাষ্ট্র’ সাইনবোর্ডটা লাগানো আপাতত থমকে গেলেও মোদী ৩.০-কে এভাবেই স্বাগত জানানা হলো।

মহম্মদ আখলাক, পেহলু খানদের স্মৃতি উসকে গল্প কাহিনি সেই একই।

‘ভাইয়া পানি পিলা দো এক ঘুট। মারো মাত, বাস পানি পিলা দো...’ সাদ্দামের করুণ আরজি ফোনের ওপারে শুনছিলেন মহসিন। কিন্তু বন্ধুকে বাঁচাতে কিছু করার উপায় নেই। উত্তর প্রদেশ থেকে ছত্তিশগড়, দূরত্ব অনেকটাই। বিজেপি’র পুলিশে ফোন করেও কোনও লাভ হয়নি, বুঝে গিয়েছিলেন মহসিন। পরে সাদ্দাম কোনোরকমে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। চাঁদ মিয়া, গুড্ডু খানকে ততক্ষণে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে স্বঘোষিত গোরক্ষকরা। ছত্তিশগড়ের মহাসমুন্দ-আরঙ সড়কের উপর শুক্রবার মাঝ রাতের এই বর্বরোচিত ঘটনা স্বাভাবিকভাবে বিজেপি সরকারের পুলিশ আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। 

লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশ হয়েছে সদ্য। ছত্তিশগড়ের ১১ আসনের মধ্যে ১০টি’তেই জিতেছে বিজেপি, একটি পেয়েছে কংগ্রেস। তৃতীয়বারের জন্য নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিতে চলেছেন রবিবার সন্ধ্যায়। তার আগেই স্বঘোষিত গোরক্ষক বাহিনী বুঝিয়ে দিল, যেমন চলেছে তেমনটাই চলবে। গত আড়াই মাসের ভোট প্রচারে খোদ মোদীই তার আবহ তৈরি করে চলেছিলেন। ভোট চাইতে মুসলিম, মাটন, মছলি, মঙ্গলসূত্র, বেশি বাচ্চা যাদের—  কী না বেরিয়েছে তাঁর মুখ দিয়ে! সেই মোদী গদি ফিরে পাচ্ছেন, তাই আবার সেই পুরানো ঘটনার রিপিট টেলিকাস্ট নয়, বারে বারে নতুন নতুন কায়দায় দেখার জন্য তৈরি থাকতেই হবে দেশের মানুষকে। 

গত রাতের ঘটনায় ছত্তিশগড়ের বিজেপি সরকারের পুলিশের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগও উঠেছে। গুড্ডুদের ট্রাক আটকে তাণ্ডব চালানো হচ্ছে, এই খবর পেয়েও পুলিশ ঘটনাস্থলে এক ঘণ্টা দেরিতে পৌঁছায়। তার মধ্যে গুড্ডু এবং চাঁদকে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ওই বাহিনী বেধড়ক পিটিয়ে খুন করে দেহ মহানদীতে ফেলেও দেয়। মহানদীর উপরের সড়কেই ইচ্ছা করে ট্রাকটি আটকে রাখা হয়। আর পুলিশ শনিবারও দাবি করেছে, ‘ময়নাতদন্তের রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত পিটিয়ে খুনের তত্ত্ব প্রমাণিত নয়। খতিয়ে দেখা হবে ওই সড়কের সিসিটিভি ফুটেজও’।

উত্তর প্রদেশের শামলির বাসিন্দা বছর তিরিশের গুড্ডু খান, সাহারানপুরের চাঁদ মিয়া (২৩) এবং তাঁর তুতো ভাই সাদ্দাম কুরেশি পেটের তাগিদে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে চলে আসেন ছত্তিশগড়ে। হাটে-বাজারে ট্রাকে বোঝাই করে গোরু-মোষ নিয়ে যাওয়াই ছিল তাঁদের কাজ। ওই দিনও সেই কাজেই বেরোন তাঁরা। পাটেয়া থেকে আসছিল ট্রাকটি। যাওয়ার কথা মহাসমুন্দ। পরিকল্পনা করেই যে চাঁদ, গুড্ডুদের উপর হামলা চালানো হয়েছে, তা ঘটনার গতি-প্রকৃতিতেই প্রমাণিত। প্রায় ১৫-২০ জনের একটি দল অনেকক্ষণ ধরেই ট্রাকটির উপর নজর রাখছিল। মহানদীর উপর উড়ালপুলে ট্রাকটি উঠতেই তার একটি চাকা ফেটে যায়। তখন বাইক বাহিনী ঘিরে ফেলে ট্রাকটিকে। তিন জনকেই ট্রাক থেকে নামিয়ে শুরু হয় হেনস্তা। অশ্রাব্য গালিগালাজের সঙ্গেই গোরু পাচারে ভুয়ো অভিযোগ তুলে বেধড়ক মারতে শুরু করে ওই স্বঘোষিত গোরক্ষকদের বাহিনী। চাঁদ, গুড্ডু, সাদ্দামের কোনও কথাই তারা কানে তোলেনি। সাদ্দাম ছিলেন ট্রাকের খালাসি। তিনি কোনোভাবে বন্ধু মহসিনকে ফোন করেন এবং মোবাইল ঢুকিয়ে রাখেন প্যান্টের পকেটে। উলটোদিক থেকে মহসিন শুনতে পাচ্ছিলেন, তাঁর বন্ধুর কাতর কণ্ঠ। সাদ্দাম চেঁচিয়ে বলছিলেন, তাঁর হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। মহসিন, সাদ্দাম-গুড্ডুদের বাড়ির লোকজন পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পুলিশ ইচ্ছা করেই ঘটনাস্থলে দেরিতে পৌঁছেছে বলে অভিযোগ তাঁদের। সাদ্দামের আরেক আত্মীয় শোয়েব সংবাদমাধ্যমে জানান, শুক্রবার রাত দু’টো নাগাদ চাঁদদের ট্রাক আটকে দেওয়া হয়। তারপরই শুরু হয় হেনস্তা। তখনই সাদ্দাম ফোন করে মহসিনকে। কিছুক্ষণ পর কেটে যায়। পরে তিনটে নাগাদ কুরেশি আবারও ফোন করে। অন্তত ৪৭ মিনিট ধরে শোনা গিয়েছে ওদিকে কী হচ্ছে। কারণ সাদ্দামের ফোন ছিল ওর প্যান্টের পকেটে। ফলে কী ঘটনা ঘটেছে ওদের সঙ্গে তা জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে গিয়েছে। তারপর আবার ফোন কেটে যায়। চাঁদের নম্বরে টানা দু’ঘণ্টা ধরে ফোন করা হয়। ওর ফোনই শুধু বাজছিল। পাঁচটা নাগাদ একজন পুলিশ কর্মী ফোন ধরে জানিয়ে দিলেন, চাঁদ আর নেই। ও, গুড্ডু দু’জনেই মারা গিয়েছে। 

পরে সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা গিয়েছে, দু’জনের দেহ নদী থেকে তোলা হয়েছে। দু’জনেরই পায়ের মাঝখান দিয়ে চিরে দিয়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। তাঁদের শরীরের প্রায় সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেই ছিল ভাঙা। সাদ্দামের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। 

নিন্দা-সমালোচনা থেকে বাঁচতে এবং নিহতদের পরিবারের চাপে ১৪ সদস্যের বিশেষ তদন্তকারী দল তৈরি করেছে রায়পুর গ্রামীণ পুলিশ। চাঁদদের পরিজনদের কথা থেকে জানা গিয়েছে, উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা তাঁদের মারার সময় চিৎকার করে বলছিল, ‘কাঁহা সে লায়ে হো, ছোড়েগা নেহি’। গোরুগুলি কোথা থেকে নিয়ে এসেছে এই প্রশ্নই করছিল ওরা। ট্রাকে থাকা তিন যুবকই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হওয়ায় গোহত্যার জন্যই গোরু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বা পাচার করা হচ্ছে এরকম গুজব ছড়িয়ে এই তাণ্ডব চালিয়েছে স্বঘোষিত গোরক্ষকরা। মোদী-রাজে সংখ্যালঘুদের হেনস্তা, ভুয়ো গুজবে পিটিয়ে খুন কোনও নতুন ঘটনা নয়। এসব ঘটনায় অভিযুক্তরা কেউ কোনও শাস্তি পায় না। ফলে মহম্মদ আখলাক, পেহলু খান, নাসির-জুনেইদদের মতোই চাঁদ-গুড্ডুর খুনের ঘটনাও ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টাই চলবে সংবিধানে মেকি প্রণামের ছবি দেখিয়ে।


 

Comments :0

Login to leave a comment