রেমালের দাপট শেষ। রবিবার রাত থেকে রেমালের পরোক্ষ আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো পশ্চিমবঙ্গ উপকূল। লোকসভা ভোটের আগে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণায় যা ক্ষতি হলো, তা সামলাতে সময় লাগবে। সুন্দরবনের উপকূলবর্তী এলাকায় বাড়িঘর তছনছের সঙ্গে যেভাবে বাঁধের ক্ষতি হয়েছে তা সারাতেও সময় লাগবে। রেমালের তাণ্ডবে গত ২৪ ঘন্টায় কলকাতাসহ দক্ষিণবঙ্গে ৬ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে।
কলকাতায় গাছ উপড়ে, রাস্তায় জল জমে একাকার অবস্থা। এসপ্লানেড ও পার্ক স্ট্রিট মেট্রো স্টেশনের ভিতর এদিন জল থৈ থৈ। মেট্রোর লাইন জলের নীচে চলে যাওয়া এদিন চার ঘন্টা বন্ধ থাকে মেট্রো পরিষেবা। সোমবার সকাল নয়টা পর শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখা ও শিয়ালদহ উত্তর শাখায় ট্রেন স্বাভাবিক হয়েছে বলে রেল দাবি করলেও সোমবার দিনভর টাইম মেনে চলেনি শহরতলীর ট্রেন।
শক্তি খুইয়ে সোমবার রাতে রেমাল পরিণত হয়েছে গভীর নিম্নচাপে। সেজন্যই মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে দক্ষিণবঙ্গের আবহাওয়ার উন্নতি ঘটবে। তবে রেমালের জেরে ঘোর জৈষ্ঠ্যে শহরতলীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রির নীচে নেমে গেছে। শিরশিরে ঠান্ডা অনুভূত হয়েছে দিনভর। সেই সঙ্গে চলেছে লাগাতার বৃষ্টি। রবিবার রাতে মাটি স্পর্শ করার পরেও সোমবার দুপুরের আগ পর্যন্ত রেমাল বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ উপকূলের মধ্যে থমকে থাকায় হাওয়ার দাপট এদিন সকালেও দেখা গেছে।
সোমবার সকালে কলকাতা ও ক্যানিং থেকে রেমালের দূরত্ব ছিলো ৯০ কিলোমিটার। আর তার জেরেই সকাল থেকে ফের দমকা হাওয়া বইতে দেখা গেছে দুই ২৪ পরগণা ও কলকাতায়। রেমালের ল্যাজের ঝাপটায় রবিবার রাতে বৃষ্টি-ঝড়ের জেরে কলকাতার ত্রাহি ত্রাহি দশা। রেমালের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে দুই ২৪পরগণা, পূর্ব মেদিনীপুর ও কলকাতায়। বিশাল বপু নিয়ে সাগরদ্বীপ থেকে মুখ ঘুরিয়ে বাংলাদেশের খুলনার দিকে যেতে গিয়ে ল্যাজের ধাক্কায় বিপর্যস্ত হয়েছে সুন্দরবনের ব্যপক এলাকা।
কলকাতায় অতিভারী বৃষ্টি হতে দেখা গেছে। রবিবার সকাল সাড়ে আটটা থেকে সোমবার ওই সময় পর্যন্ত কলকাতায় বৃষ্টি হয়েছে ১৫০ মিলিমিটার। গ্রীষ্মের মরশুমে এধরণের বৃষ্টি একটা রেকর্ড। কলকাতার পাশাপাশি সল্টলেকে বৃষ্টি হয়েছে ১১০ মিলিমিটার। রেমালের জেরে দক্ষিণবঙ্গে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে হুগলীর তারকেশ্বরে। সেখানে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে দেখা গেছে। কলকাতার পাশাপাশি হলদিয়া ১১০ মিলিমিটার, তমলুকে ৭০ মিলিমিটার, নিমপীঠে ৭০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলবর্তী এলাকায় রেমালের ধাক্কায় কমপক্ষে ১৫ হাজার বাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। রাজ্য প্রশাসন জানিয়েছে, ২৪টি ব্লক আর ৭৯ মিউনিসিপালিটি ওয়ার্ড মিলিয়ে মোট ক্ষতিগ্রস্থ বাড়ির সংখ্যা ১৪,৯৪১। এর মধ্যে ১৩,৯৩৮ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আর বাকি ১০০৩ বাড়ি পুরোপুরি ভেঙে শেষ হয়েছে। রাজ্যে কমপক্ষে ২১৪০টি গাছ উপড়ে পড়তে দেখা গেছে, উলটে গেছে ৩৩৭টি ইলেকট্রিক পোল। বৈদ্যুতিক লাইন ছিঁড়ে যাওয়ার জন্য রবিবার রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ এলাকায় দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকে।
রেমালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কাকদ্বীপ, নামখানা, সাগরদ্বীপ, ডায়ামন্ডহারবার, ফ্রেজারগঞ্জ, বকখালি আর মন্দারমণি। ক্ষতি হয়েছে হিঙ্গলগঞ্জের। নামখানার মৌসুনীদ্বীপে রবিবার রাতের খাবার খাওয়ার সময় টিনের ছাউনির রান্নাঘরে গাছ পড়ে এক বয়স্ক মহিলার মৃত্যু হয়েছে। নিহত ওই মহিলার নাম রেণুকা মণ্ডল (৮০)। কলকাতায় এন্টালির বিবিবাগান লেনে দোতলার বারান্দা ভেঙে মহম্মদ শাহিদ (৫১) এক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে। সোদপুরের পাণিহাটিতে রাস্তার পোস্টে বিদ্যুৎ আহিত হয়ে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যুর খবর মিলেছে।
কলকাতায় একাধিক এলাকায় দেওয়াল পড়ার ঘটনা ঘটেছে। শেকসপীয়র সরণির ক্যামাক স্ট্রিটে রবিরার রাতে একটি গ্যারেজের দেওয়াল ভেঙে পড়ে। রেমালের যখন ল্যান্ডফল শুরু হয়েছে তখন কলকাতায় ৮০ কিলোমিটার বেগে জোরালো বাতাস বইতে দেখা যায়। রাতে ওই সময় ইকবালপুরের ময়ূরভঞ্জ রোডের একটি বাড়ির সানশেড উড়ে যায়। কলকাতায় ৬৮টি গাছ উপড়ে গেছে বলে জানিয়েছে কলকাতা পুলিশ। কলকাতার পাশাপাশি সল্টলেক আর রাজাহাটেও রবিবার রাতের প্রবল ঝড়ে ৭৫টি গাছ উপড়ে গেছে।
রেকর্ড বৃষ্টির জন্য কলকাতার একাধিক এলাকায় সোমবার বিকাল পর্যন্ত জল জমে থাকতে দেখা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে উত্তরের হাতিবাগান, কলেজ স্ট্রিট, দক্ষিণের সাদার্ন এভিনিউ, লেক প্লেস, বেহালা, যাদবপুর, গোলপার্ক, বালিগঞ্জ, ঢাকুরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা। সোমবার দীর্ঘ সময় জল জমে থাকতে দেখা যায় মেটিয়াবুরুজ, খিদিরপুর ও বেহালায়।
পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ ও বাংলাদেশের খেপুপাড়ার মধ্যে দিয়ে খুলনা জেলার মোংলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে রবিবার রাত সাড়ে বারোটায় ঘূর্ণিঝড় রেমালের মাটি ছোঁয়া (ল্যান্ডফল) শেষ হয়েছে বলে হাওয়া অফিস জানিয়েছে। চার ঘন্টা ধরে চলেছে ওই প্রক্রিয়া। রেমালের মাথা মাটি ছুঁলেও ঘূর্ণিঝড়ের অক্ষি দীর্ঘসময় উপকূলবর্তী এলাকায় ওপরে থাকায় সোমবার সকাল থেকে কলকাতাসহ দক্ষিণবঙ্গে টানা বৃষ্টির সঙ্গে দামকা হাওয়া বইতে দেখা গেছে।
রেমালের জেরে দুরসঞ্চারণ পরিষেবা এমনকি ইন্টারনেট পরিষেবা সোমবার সকাল থেকে ব্যহত হতে দেখা গেছে। দিল্লির মৌসম ভবনের শেষ বুলেটিনে জানিয়েছে, সোমবার বিকাল সাড়ে পাঁচটার পর রেমাল দুর্বল হয়ে পড়েছে। দক্ষিণ ২৪পরগণার ক্যানিং থেকে উত্তর-পূর্ব মুখো ৭০কিলোমিটার দরে আর মোংলার ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে থাকার সময় সে দুর্বলতর হয়ে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। সোমবার রাতে রেমালের ক্ষয়িষ্ণু দেহ শুধু একটি নিম্নচাপ হিসাবে রয়ে যাবে।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের জেরে দক্ষিণবঙ্গে ৪৮টা বুথ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা মিলিয়ে এই পরিসংখ্যান সামনে এসেছে। অনেক বুথে জল ঢুকে বিপত্তি। দুই ২৪ পরগনার জেলাশাসককে ফোন করে জল নামানো এবং বুথের মেরামতির কাজ যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দ্রুত সম্পন্ন করার নির্দেশ রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক আরিজ আফতাব। ঘূর্ণিঝড়ের জেরে স্ট্রং রুমে কোন ক্ষতি হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হয়েছে সোমবার। স্ট্রং-রুমের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে কমিশন কর্তাদের ফিল্ডে নামার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের মধ্যে ভারতের মূল ভূখণ্ডে বর্ষা প্রবেশের বিষয়ে সুখবর দিল ভারতীয় মৌসম ভবন। আগামী পাঁচদিনের মধ্যে কেরলে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু প্রবেশের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হতে চলেছে। মে’র শেষ কিংবা জুনের প্রথমেই কেরলে মরশুমী বর্ষা প্রবেশ করবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এমনিতে ৩১ মে কেরলে বর্ষা প্রবেশ করে। মৌসম ভবন পূর্বাভাস দিয়েছিল যে ২৭ মে থেকে ৪ জুনের মধ্যে ভারতের মূল ভূখণ্ডে বর্ষা প্রবেশ করে যাবে।
রেমাল ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে এখনও পর্যন্ত রাজ্যে ছয় জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। কারো মাথায় গাছ পড়ে, তো কারও মাথায় বাড়ির কার্নিস ভেঙে, কেউ আবার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ঝড়ের তাণ্ডবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও প্রচুর। রেমালের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে রাজ্য প্রশাসনের তরফে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। নির্বাচনের বিধি মেনেই সেই টাকা মৃতদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেবে প্রশাসন বলে জানা গেছে।
সোমবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে চলাকালীন দক্ষিণ ২৪ পরগণার মহেশতলার নুঙ্গিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন এক মহিলা। মহেশতলা পৌরসভার ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের নুঙ্গি মেটেপাড়ার বাসিন্দা ওই মহিলার নাম তাপসী দাস (৫৩)। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, নিজের বাড়িতে তড়িতাহত হয়ে ওই মহিলার মৃত্যু ঘটেছে। প্রবল টানা বৃষ্টিতে মহেশতলা পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা সোমবার বিকাল পর্যন্ত ছিলো জলমগ্ন। দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করতে হয়েছে এলাকার বাসিন্দাদের।
পূর্ব বর্ধমানে মেমারিতে ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে পড়া কলা গাছ সরাতে গিয়ে সোমবার সকালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হলো বাবা-ছেলের। মেমারীর কলা নবগ্রাম এলাকায় এদিন সকাল আটটা নাগাদ এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে। নিহতদের নাম ফড়ে সিং (৬০) ও তরুণ সিং (২৯)। কলা নবগ্রামের কুমোর পাড়ার বাসিন্দা ফড়ে সিং বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে উলটে যাওয়া কলা গাছ সরাতে যান। কলা গাছের সাথে বিদ্যুতের তার জড়িয়ে থাকায় তিনি সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠহন। বাবা’র ওই অবস্থা দেখে ছুটে আসেন ছেলে তরুণ সিং। তিনিও একইভাবে তড়িতাহিত হন। এই ঘটনায় গোটা এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
Remal Casualty
রেমাল দক্ষিণবঙ্গে প্রাণ কাড়লো ছয় জনের, দাপট শেষ রেমালের, আজ কাটবে দুর্যোগ
×
Comments :0