মধুসূদন চ্যাটার্জি: বাঁকুড়া
যে কোন দিন মারা যাবেন ৩০ বছরের খেতমজুর মহিলা দীপালি বাউরি। শরীরে দুরারোগ্য অসুখ। কারণ একটাই, ন্যূনতম পুষ্টিকর খাবার তো দূরের কথা, একবেলাও পেটভরে খেতে পান না।
তাঁর পরিবারে স্বামী, এক ছেলে, এক মেয়ে। মাসের পর মাস রেশন পাননি। রেশন কার্ড একসময় ছিল। এখন আধার কার্ডের সঙ্গে লিঙ্ক না হওয়ায় রেশন বন্ধ হয়ে আছে। বাড়িতে আধার কার্ডও নেই। জরাজীর্ণ বাড়ি ভেঙে পড়ায় সেই আধার কার্ডও হারিয়েছেন। একবেলা কোনোমতে চারজনের খাবারের জন্য ছেলেমেয়েকে এর ওর বাড়িতে চাল চাইতে পাঠান। স্বামী বিদ্যুৎ বাউরি ওরফে আকালেরও কোন কাজ নেই।
এই মর্মান্তিক অবস্থা বাঁকুড়া-২ ব্লকের মানকানালী অঞ্চলের করনজোড়া গ্রামে। তিন বছর আগে এই অঞ্চলেরই করনজোড়ার পাশের গ্রাম কেন্দবনীতে এক লোহার কারিগর থেকে খেতমজুরের রূপান্তরিত হওয়া রঞ্জিত কর্মকারের অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এই ছায়াই পড়েছে করনজোড়া বাউরি পাড়ায়। একের পর এক পরিবার অর্ধাহারে দিন যাপন করছেন। বাকিদের অবস্থা এখনও পর্যন্ত দীপালি, আকালের মতো না হলেও যেকোন দিন পুরো বাউরিপাড়া জুড়ে এই ঘটনা ঘটতে চলেছে।
ঘটনা হল বাঁকুড়া শহর থেকে ২৪কিলোমিটার দূরে। মানকানালীর এই করনজোড়া গ্রামের বাউরিপাড়ার বেশিরভাগ মানুষই জনমজুরের কাজ করে পেট চালাতেন। একমাত্র ভরসা ছিল রেগার কাজ। ২০২১ সালে রাজ্যজুড়ে রেগার কাজ বন্ধ হলেও ২০১৫ সালেই এই গ্রামে রেগার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বহুবার বাঁকুড়া ২নং ব্লকের বিডিও কে স্থানীয় বিজেপি, পরে তৃণমূলের পঞ্চায়েতকে জানানো সত্বেও কোন নতুন কাজ এখানকার মানুষ পাননি। বাইরে যে জনমজুরের কাজ করবেন তারও উপায় নেই। কোথায় কাজ। চরম দুর্দশা নেমে আসে প্রায় ১৫০টি পরিবারের উপর। কোনক্রমে তাঁরা অর্ধাহারে থেকে দিন চালাচ্ছিলেন।
শনিবার সকালে করনজোড়া গ্রামের বাউরি পাড়ায় গিয়ে দেখা গেল নিঃস্তব্ধতা সেখানে গ্রাস করে আছে। রক্তশূন্য অপুষ্টিভোগা মানুষগুলো যেন কথা বলতে ভুলে গেছেন। বিদ্যুৎ বাউরি বাড়ি জরাজীর্ণ। পঞ্চায়েতকে বলেও কোন ঘর পাননি। বাড়িতে গিয়ে দেখা মিলল না দিপালী ও বিদ্যুৎ বাউরির। ঘরে ঢোকার মুখেই পাড়ার বাসিন্দা কল্যানী বাউরি বললেন, ‘‘ আকালের বাড়ি যাবেন তো, চলুন নিয়ে যাচ্ছি, ওর বউ বিছানা থেকে উঠতে পারে না, ঘরে খাবারও নেই। ছেলে মেয়ে নিয়ে কিভাবে দিন কাটছে ওদের দেখবেন একবার।’’
বাড়িতে ছিলেন বিদ্যুৎ বাউরির ছেলে রাজ বাউরি ও বৃদ্ধা মা ফকিরদাসী বাউরি।
রাজ বাউরি স্থানীয় স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। সে জানায় ‘‘ আমার মায়ের খুব শরীর খারাপ, খালি হাঁপায়, কিছুই খেতে পারে না, বাড়িতে খাবারও থাকে না। কাল রাত থেকে খুব কষ্ট পাচ্ছিল, আজ সকালে বাবা ও দিদি একটা টোটো ভাড়া করে সরবড়িয়া হাসপাতালে নিয়ে গেছে। জানি না বাঁচবে কিনা’’ কল্যানী বাউরি জানান, তিনিও রেশন পান না, তাঁর ছেলে ২৪ বছরের জয়গোপালকেও হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। শরীর দুর্বল। খাবার কোথায় যে শরীর চলবে? জানান তিনি। গ্রামের এই বাউরি পাড়ার প্রতিটি পরিবারই ধুঁকছেন।
করনজোড়া থেকে ৬কিলোমিটার দুরে ছাতনার সরবড়িয়া সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালে গিয়ে বিদ্যুৎ ও দিপালী বাউরি দেখা মিলল। ‘‘গ্রামের মানুষজনের কাছে ১০, ২০ টাকা করে চেয়ে মেগে আজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছি, জরুরী বিভাগে ভর্তির জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম, ডাক্তাররা বলল, ভর্তি হবে না। আউটডোরে দেখাতে হবে, সেখানে বলল রক্ত পরীক্ষা করতে হবে এখানে কোন চিকিৎসা হল না, আবার ৩০০ টাকা টোটো ভাড়া করে গ্রামে যেতে হবে। কোথায় পাব টাকা।’’ কান্নায় ভেঙে পড়লেন কাজ হারা বাংলার এই খেতমজুর। জরাজীর্ন চেহারা নিয়ে হাসপাতালে দাঁড়িয়ে আছেন দীপালি বাউরি, বোকা কান্নার জল গড়িয়ে পড়ছে দু’গাল দিয়ে। মেয়ে মায়া বাউরি দেখছে তার মা, বাবার অবস্থা। দিপালী বাউরি জানান, ভাল করে শ্বাস নিতে পারেন না। কিছু খেলেই বমি হয়ে যাচ্ছে। আমি আর বাঁচব না। তিনি জানান, রেশন নেই, ঘরে চাল থাকেনা, সকালে হলেই একদিন ছেলে একদিন মেয়েকে পাঠাই চেয়ে মেগে কিছু চাল জোগাড় করে আনতে। যা পায় তাই’ই ফুটিয়ে খাই। আর আমার শরীর খারাপের জন্য স্বামীও কোথাও কাজ খুঁজতে যেতে পারছেনা। এক মুঠো ভাতও প্রতিদিন জোটেনা। বিদ্যুৎ বাউরি জানান, আগে রেশন পেতাম। ঝড়ে ঘর পড়ে যাওয়ার পর আধারকার্ড, ভোটার কার্ড সব নষ্ট হয়ে গেল। এখন বলছে আধারকার্ড না থাকলে রেশন পাওয়া যাবেনা। তাই আমরা রেশন পাচ্ছি না। বারে বারে মানকানালী পঞ্চায়েতে গেছি, ওরা বলছে এখন কিছুই করা যাবে না, ভোটের পর দেখব। আমরা বাঁচব এতদিন?
তাঁর বক্তব্য, ‘‘বাঁকুড়া হাসাপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর মতো পয়সা কোথায় আমাদের? কত আর লোকের কাছে মাগব? অনাহারে পরিবারের সবাইকে হয়ত মরতে হবে।’’ দীপালি ও বিদ্যুতের একটাই আবেদন আমরা যাতে পেট ভরে দুবেলা ভাতটা খেতে পাই তার ব্যবস্থা হোক। দেওয়া হোক রেশন।
Comments :0