Water crisis series

জল চেয়ে মমতার হাতে চিঠি, ‘কাজ হয়নি’ বলছে তৃণমূলই

রাজ্য

জল যন্ত্রণা ৩

বাড়ি বাড়ি পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল তৃণমূল সরকারের। বাড়ি তো দূরের কথা, অনেক গ্রামেই সেই জল পৌঁছায়নি। তীব্র জলকষ্ট রাজ্যের প্রতিটি জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। সেই দুর্দশাই তুলে ধরতে ধারাবাহিক প্রতিবেদন।
 

দীপশুভ্র সান্যাল: জলপাইগুড়ি
 

বৃদ্ধ রাজেন রায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির হাতে চিঠিটি দিয়েছিলেন প্রায় আড়াই বছর আগে। ঘটনাটি ঘটেছিল জলপাইগুড়ির গোসালা মোড়ে। মমতা ব্যানার্জির গাড়ি জাতীয় সড়ক দিয়ে যাচ্ছিল। তখন তাঁর গাড়ি থামিয়ে গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে দুর্বিষহ পানীয় জলের সমস্যা জানিয়েছিলেন সেই বৃদ্ধ।
তারপর? 
জলপাইগুড়ি সদরের পাহাড়পুর পঞ্চায়েতের উপপ্রধান বেণুরঞ্জন সরকার বুধবার বললেন,‘‘আমরা আশা করেছিলাম দিদির হাতে চিঠি দেওয়ার পর কিছু কাজ হবে। কিন্তু ১% কাজ হয়নি। জলের সঙ্কট যেমন ছিল তেমনই আছে। বৃদ্ধ রাজেনবাবু এখন তাঁর আত্মীয়ের রেশন দোকানে বসে থাকেন।’’
‘দিদিকে বলো’, ‘দিদির দূত’— কত কর্মসূচি হলো। এখন অভিষেক ব্যানার্জি বেরিয়েছেন ‘সংযোগ যাত্রায়।’সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। সেই পাহাড়পুরের অবস্থা কী?
দেখে মনে হতেই পারে যেন গুড় গোলানো রয়েছে কোনও পাত্রে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। এই দৃশ্য জলপাইগুড়ি শহর সংলগ্ন সদর ব্লকে পাহাড়পুর পঞ্চায়েতের অধীন ঘাসিপাড়া, বালাপাড়া, বরুয়াপাড়া সহ বিস্তীর্ণ এলাকায়। জলে এতটাই ‘আয়রন’ সেখানে। পেট্রোল পাম্পে একটি মাত্র পানীয় জলের কল আছে। দূর দূরান্তের মানুষ সেই কল থেকেই পানীয় জল নিতে আসেন লম্বা লাইন দিয়ে, অপেক্ষা করেন। বাসিন্দাদের দাবি শীঘ্রই পানীয় জলের ব্যবস্থা করুক প্রশাসন। সেখানকার বাসিন্দা রনি মালাকার বলেন, বহু বছর ধরে এই জলের সমস্যায় ভুগছি। ঠিকমতো খনন না করলে জলে আয়রন দেখা দেয়। বাসনপত্র, জামা কাপড় অল্পতেই লাল আকার ধারণ করে। গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় রাজ্য সরকারের প্রকল্প শুরু হয়ে গেলেও এই এলাকায় নামগন্ধটুকুও নেই।


এতো পাহাড়পুরের যন্ত্রণা। মাঝিয়ালির সুভাষ রায় কী বলছেন?
‘‘অভিষেকের সঙ্গে দেখা কী আর হবে? আমি কী আর সুযোগ পাবো? সুযোগ পেলে প্রথম পানীয় জলের সমস্যার কথাই বলব,’’ সুভাষ রায় সাফ জানালেন।
আগামী ২৯এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর আসার কথা রাজগঞ্জে। সেখানে যাবেন সুভাষ রায়। তিনি তৃণমূলের মাঝিয়ালি পঞ্চায়েতের সদস্য। সুভাষ রায় যে সংসদ থেকে জিতেছিলেন ২০১৮-তে, সেই বাদলাগাছ এলাকার গ্রামবাসীরা অভিযোগ তুলেছেন তাঁদের ডোবার নোংরা জল খেতে হচ্ছে। ছুটে গিয়েছিলেন বিডিও। প্রধান খুকুমণি রায়ও বুধবার জানালেন,‘‘আমিও গেছিলাম। গ্রামবাসীদের জলের রিজার্ভার তৈরির জমি দেখে দিতে বলেছি। কিন্তু ওরা জমি দিতে পারছে না। কী আর করা যাবে।’’ তবে তাঁর দাবি,‘‘ডোবার জল খাওয়ার অপপ্রচারটি আমাদের দলেরই একাংশের চক্রান্ত।’’


তৃণমূলের চক্রান্তের তত্ত্বের মাঝে সেই সংসদের পঞ্চায়েত সদস্য সুভাষ রায় এদিন জানালেন,‘‘আমার বাড়ির লোককেই কুয়োর জল খেতে হয়। ৩০ ফুটের কুয়ো। আমার এলাকায় প্রায় ৫০০ জনের বাস। ওই কুয়োর জল খেতে হয়। কেউ কেউ জল কিনে খায়। সেই কুয়োতে মিশছে নিকাশি খালের জল। বুঝতেই পারছেন দূষিত জল। কিছু করার নেই। তাই ঠিক করেছি অভিষেককে কিছু বলার সুযোগ পেলে জলের এই কষ্টের কথাই বলব।’’
নিজে পঞ্চায়েত সদস্য। দেদার চুরির অভিযোগ এলাকায়। দশ বছরের বেশি পঞ্চায়েত চালাচ্ছে তৃণমূল। তবু পানীয় জলের দুর্দশা মেটাতে পারেননি সুভাষ রায়রা। এখন হাতড়াচ্ছেন— খুঁজছেন ‘অভিষেক’কে!
তৃণমূলের একটি অংশ এই সুযোগে মানুষকে ভুল বোঝাতে নেমেছেন। মানুষ যাতে বামফ্রন্টের দিকে না যান, সেই উদ্দেশ্য তাঁরা নিজেদের ‘অন্য তৃণমূল, ভালো তৃণমূল’ বোঝাতে নেমেছেন। যেমন মাঝিয়ালির জলসঙ্কট নিয়ে তৃণমূলের এসসিএসটি সেলের অঞ্চল সভাপতি মানিক রায় বলেন,‘‘এই এলাকায় জঙ্গল রাজ চলছে। মানুষ পানীয় জল না পেয়ে পুকুরের জল খাচ্ছে। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা। তবুও কোনও উন্নয়ন হয়নি।’’ তাঁদের সরকার তাহলে এতদিন করল কী? মানুষ এই প্রশ্ন করছেন।  
জলপাইগুড়ির অনেক জায়গাতেই এমন দুর্দশা। কল আছে,জল নেই। 


বানারহাট ব্লকের দুরামারি এলাকায় সম্প্রতি গ্রামবাসীরা রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণী কল্যাণ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী বুলু চিকবড়াইককে ঘিরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। জলপাইগুড়ি সদরের অরবিন্দ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত সেবাগ্রাম সহ আশেপাশের অনেক এলাকার মানুষ পানীয় জলের সমস্যায় ভুগছেন। জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদের সভাধিপতি উত্তরা বর্মণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন,‘‘এর সমাধান আমরা খুব তাড়াতাড়ি করব।’’ গ্রামবাসী শিলা রাজপুতের অভিযোগ, ‘‘আমাদের গ্রামে অনেক সমস্যা। আমাদের টিউবওয়েল খারাপ হয়ে গেছে। আমরা পানীয় জল পাচ্ছি না। অনেকের বাড়িতে শৌচালয় নেই। এদের জানিয়ে কোনও লাভ হয় না। জনপ্রতিনিধি গ্রামে আসেন না।’’
 

Comments :0

Login to leave a comment