বছরের বেশিরভাগ সময় দিনমজুরির কাজে দিল্লিতেই থাকেন। কিন্তু যা হয়ে যাক রমজানের সময়ে আজমগড়ের গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। ওই এক মাস বাড়িতেই থাকেন। পাঁচ দশকের পারিবারিক পরম্পরায় যাতে ছেদ না পড়ে তাই দিনমজুরির কাজ ছেড়েও চলে আসেন বাড়িতে, এমনও হয়েছে বেশ কয়েকবার।
সেই সময়ে রোজ মাঝ রাতে উঠে বাড়িতে বাড়িতে কড়া নেড়ে প্রতিবেশীদের জাগিয়ে তোলার কাজ করেন। যাতে রোজা রাখা উপবাসীদের ‘সেহরি’ বাদ না পড়ে যায়। রমজানের এই এক মাসে কোনোদিনও নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না। এই কাজের জন্য এক গরিব দিনমজুর দিল্লির থেকে কাজ ছেড়ে চলে আসেন পূর্ব-উত্তর প্রদেশের আজমগড়ের ছোট্ট গড়েরুয়া গ্রামে। একটা গোটা মাস কোনও উপাজর্নও হয় না। সংসার চালাতেও কষ্ট হয়। তবুও আসেন। ধার্মিক বিশ্বাসে নয়, পারিবারিক প্রথা অক্ষুণ্ণ রাখতেই তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা।
বছর পঁয়তাল্লিশের গুলাব যাদবের পরিবার এই কাজ করছেন গত ৫০ বছর ধরে। রমজানের সময়ে প্রতিবেশী মুসলিমদের ভোরবেলায় ডেকে তোলেন গুলাব যাদব। সঙ্গে থাকে ১২ বছরের ছেলে অভিষেক। গুলাবের বাবা চিরকিত যাদব ১৯৭৫ সালে এই কাজ শুরু করেছিলেন। গ্রামের পুরানোরা বলেন, স্ত্রী দুলারী দেবীর প্রেরণাতেই নাকি গ্রামের মুসলিমদের সেহরির জন্য জাগানোর কাজ শুরু করেছিলেন চিরকিত যাদব। বাবার সেই ঐতিহ্যকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন গুলাব। রমজানের উপবাস শুরুর আগে ভোর রাতে যাতে রোজেদাররা ঠিক সময়ে খাবার খেয়ে নেন। ঘুমের জন্য যাতে বাদ না পড়ে সেহরি বা ভোররাতের সেই খাবার, তার জন্য একটি হিন্দু পরিবার পঞ্চাশ বছর ধরে প্রতিবেশী মুসলিমদের জাগিয়ে তুলছে।
রোজ রাত ১টা নাগাদ উঠে পড়েন গুলাব যাদব, ছেলে অভিষেককে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন গ্রামের পথে। হাতে একটা টর্চ আর একটা লাঠি। রাস্তার কুকুরের উপদ্রব থেকে বাঁচতে লাঠি নেওয়া। প্রতিটি মুসলিম পরিবারের ঘরের সামনে গিয়ে হাঁক পাড়েন। ততক্ষণ ডাকাডাকি চলতে থাকে, যতক্ষণ না ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ আসে ‘গুলাব ভাই উঠে পড়েছি’। মসজিদ থেকে মাইকেই সেহরির জন্য রোজেদারদের জন্য ঘোষণা হয়ে থাকে। কিন্তু সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট শব্দ দূষণ নিয়ে নির্দেশ দেওয়ার সুযোগে উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় মসজিদে মাইক বাজানোর উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ফলে এখন বেশিরভাগ জায়গায় পুরানো প্রথাগত পথে ঢোল, ড্রাম বাজিয়ে সেহরির জন্য ডেকে তোলা চলছে মুসলিম নিবিড় জনপদে। কিন্তু গুলাবের ডাকে আন্তরিকতা অন্যমাত্রা এনে দেয়।
ছোটবেলার কথা মনে করে গুলাব যাদব বলেছেন, ‘‘অল্প বয়সে বুঝতাম না গভীর রাতে উঠে বাবা কেন বেরিয়ে যায়। কেন বাড়ি বাড়ি সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। যখন বড় হলাম বুঝলাম বাবা কত গভীর একটা কাজ করতেন। এখন এই কাজ করে আমিও ভীষণ শান্তি পাই। সেই কারণেই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যাই, ওর মধ্যেও যাতে এখন থেকেই পরিবারের পবিত্র ঐতিহ্য সম্পর্কে বোধ তৈরি হয়। যেমন বাবা আমাকে নিয়ে যেত। বাবা যে কাজ শুরু করেছিল, এখন আমি করছি। ইচ্ছা আমার ছেলে এরপর এই পরম্পরা, ঐতিহ্য এগিয়ে নিয়ে যাক। তাই ওকেও আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাই।’’ চিরকিত যাদবের মৃত্যুর পরে তাঁর বড় ছেলে বিক্রম যাদব এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ‘‘কিন্তু দাদার বয়স হয়ে গেছে, চোখেও কম দেখে। দাদা আর পারে না রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে এই কাজ করতে। তারপর থেকে আমি এই কাজ করছি। যতদিন বেঁচে আছি, কাজের জন্য যেখানেই থাকি না কেন, আমি প্রতিবার রমজানের সময়ে গ্রামে চলে আসব সেহরির জন্য ডাক দিতে।’’
স্বাভাবিকভাবে গ্রামে গুলাব এবং তাঁর পরিবারের জন্য গভীর শ্রদ্ধাবোধ প্রতিবেশীদের। শুধু মুসলিমদের নয়, হিন্দুদেরও। যাদবের প্রতিবেশী শাফিক যেমন বললেন, ‘‘সেহরির জন্য গ্রামবাসীদের ডেকে তোলার মতো মহৎ কাজ করেন গুলাব ভাই। তিনি গোটা গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখেন যাতে কেউ বাদ না পড়েন। গোটা গ্রাম ঘুরতে ওঁর দু’ ঘণ্টা লেগে যায়। প্রথমে একবার ডেকে তোলেন, তারপর আবার প্রতি বাড়ি ঘুরে দেখেন সবার খাওয়া হয়েছে কিনা। এর থেকে বেশি পবিত্র কী হতে পারে?’’ সঙ্গে জুড়লেন, যখন গীতা-কোরান ভালোবাসার উপদেশই দেয়, তখন হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে কেন অনৈক্য থাকবে? গ্রামবাসীদের কথায় গুলাব যাদব সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছেন। যাদবের পরিবারের সম্প্রীতি আর সহাবস্থানের এই ঐতিহ্য শুধু অতীত চর্চা নয়, দুনিয়ার কাছে শিক্ষার।
ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়ার বিপুল তরঙ্গের এই সময়ে রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন-কাইফি আজমির আজমগড়ের ছোট্ট এক গ্রামে গুলাব-শাফিকদের জন্যেই প্রকৃত অর্থেই জেগে আছে ‘ভারত-আত্মা’।
Azamgarh Ramzan
ভোররাতে ঘরে ঘরে সেহরির ডাক দিনমজুর গুলাবের আজমগড়

×
Comments :0