ASSAM

বিজেপি’র ‘বাঙালি-নীতি’ জানাচ্ছে আসাম

জাতীয় ফিচার পাতা

বিশ্বজিৎ দাস

এবছরের দুর্গাপুজোয় আসামে উগ্র প্রাদেশিকতাবাদী ছাত্র সংগঠন আসু ও লাচিত সেনা নামের আরেকটি উগ্র সংগঠন উজান আসামের বিভিন্ন পুজো মণ্ডপে টাঙানো বাংলায় লেখা ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। তাদের দাবি, ‘আসাম শুধু অসমিয়াদের। তাই এই রাজ্যে অসমিয়া ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় ব্যানার, পোস্টার টাঙানো যাবে না।’ যদিও, পুজো মণ্ডপের সামনে টাঙানো বহুজাতিক সংস্থার হিন্দি, ইংরেজিতে লেখা পণ্যসামগ্রীর বিজ্ঞাপনের ব্যানার, পোস্টার,ভিনাইলে হাত দেয়নি তাঁরা। 
স্পষ্ট যে তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য বাংলা ও বাঙালি। সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে  রাজ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বাঙালিরা তো বটেই, অসমিয়া ভাষী মানুষরাও এই ঘটনার প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। পুজো মণ্ডপে ব্যানার ছেঁড়া,  হামলা হুজ্জতির ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থাই নেয়নি রাজ্যের বিজেপি সরকার। 
শারদোৎসবের পরে বাঙালি নিবিড় বরাক উপত্যকায় সরকারি সফরে আসেন রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী রঞ্জিত কুমার দাস। তাঁর মতে, উজান আসামে বাংলা ব্যানার টাঙানো উচিত হয়নি। রাজ্যে ১৯৬০ সালের ভাষা আইন মতে, বরাক উপত্যকায় সরকারি ভাষা বাংলা। বোড়োল্যান্ডে সরকারি ভাষা বোড়ো। আর বাকি এলাকায় সরকারি ভাষা অসমিয়া। সরকারি কাজকর্মে এই নিয়ম প্রযোজ্য। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পারিবারিক অনুষ্ঠান কিংবা বেসরকারি অনুষ্ঠানে প্রতিটি ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় কথা বলা কিংবা ব্যানার, পোস্টার টাঙাতে পারবে না। 


ব্যানার ছেঁড়ার ঘটনা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মার নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে গুয়াহাটিতে এক সাংবাদিক বৈঠকে প্রসঙ্গক্রমে মুখ্যমন্ত্রী বলেন,‘লাচিত সেনা নামে রাজ্যের একটি সংগঠন আছে। এদের কাজ ব্যানার ছেঁড়া, আর চাঁদা তোলা।’ ব্যানার ছেঁড়ার ঘটনার নিন্দাও করেননি তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের পরদিনই লাচিত সেনার প্রধান শৃঙ্খল চালিহা পাল্টা সাংবাদিক বৈঠক করে হুমকি দিয়ে বলে,‘আসামে বাংলায় লেখা ব্যানার,পোস্টার টাঙাতে দেওয়া হবে না'। চালিহার হুমকির পরও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিজেপি সরকার। 
এবছর পুজোর কুড়ি-বাইশদিন আগে দূর্গাপুজো করতে হলে সরকারকে কর দিতে হবে, এমন নির্দেশিকা জারি করে সরকার। রাজ্যে কোনোদিন পুজো-কর চাপায়নি কোনো সরকার। পুজো-করের বিরুদ্ধে বাঙালিরা সোচ্চার হওয়ায় পুলিশকে দিয়ে করের নির্দেশিকা প্রত্যাহার করে সরকার। এরপর পুজোর সপ্তাহ খানেক আগে রাজ্যের বাঙালিদের হুমকি দিয়ে প্রকাশ্যে চিঠি দেয় নিষিদ্ধ সংগঠন আলফা। চিঠিতে আলফা সেনাধ্যক্ষ পরেশ বরুয়া লেখেন, পৃথক  বরাক উপত্যকা গঠন নিয়ে রাজ্যের বাঙালিরা ৬০ দিনের মধ্যে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। চিঠিতে আলফা সেনাধ্যক্ষ এও উল্লেখ করেন, বরাক উপত্যকা কোনোদিন বাঙালিদের ছিল না। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বরাক বাঙালিরা দখল করেছে। আলফার চিঠিতে বাঙালিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালিদের হুমকি ও দখলদার বলে আলফার চিঠি নিয়েও মুখ খোলেননি মুখ্যমন্ত্রী কিংবা তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যরা। এরপরই বাংলা ব্যানার ছেঁড়া শুরু করে আসু, লাচিত সেনা। 
পুজো-কর চাপানো,পুজোর আগে বাঙালিদের উদ্দেশ্য আলফার হুমকি কিংবা পুজো মণ্ডপে বাংলা ব্যানার ছেঁড়া  কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিজেপি রাজ্যের ক্ষমতায় আসার পর আসামের ভাষিক সংখ্যালঘু বাঙালিদের বিরুদ্ধে নতুন করে  ধারাবাহিক আক্রমণ শুরু হয়েছে। এসব ঘটনা তারই অঙ্গ। আগামী লোকসভা নির্বাচনে আসামে অন্তত ৫টি আসনে লড়াই করতে চাওয়া তৃণমূলও এই বিষয়ে নীরব। 
বিজেপি আসামের ক্ষমতায় আসার পরই গরিব মানুষদের উচ্ছেদ করা তাদের প্রধান কর্মসূচি হিসেবে বেছে নেয়। উচ্ছেদের মূল লক্ষ্য গরিব বাঙালিরা। বাঙালিদের বাংলাদেশি আখ্যা দিয়ে উচ্ছেদ শুরু করে। একইসঙ্গে এনআরসি অর্থাৎ নাগরিকপঞ্জি নবায়নকে হাতিয়ার করে বাঙালিদের তাড়ানোর অভিযান শুরু করে বিজেপি সরকার। এনআরসির সময় বাঙালিদের বারবার ভারতীয় হিসেবে প্রমাণ দিতে হয়। এরপর যখন নাগরিক পঞ্জির খসড়া তালিকা প্রকাশ হয়, তখন ৪০ লক্ষের নাম বাদ যায়। এরমধ্যে নব্বই শতাংশই বাংলাভাষী। সেদিন খসড়া তালিকা প্রকাশের পরপর বাদপড়াদের ‘উইপোকা’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন অমিত শাহ। শাহ সেদিন হুমকি দিয়ে  বলেছিলেন, উইপোকারা দেশকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে। এদেরকে ভারত থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হবে। এরপর যখন এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হয়, তাতে দেখা যায় বাদপড়া ৪০ লক্ষের মধ্যে ২১ লক্ষের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাদ পড়েছেন ১৯ লক্ষাধিক। তারমানে শাহ যাদেরকে উইপোকা বলেছিলেন, তাদের অর্ধেক ভারতীয় বলে চিহ্নিত হয়েছেন। 


এনআরসি থেকে বাদপড়া ১৯ লক্ষকে ফের আবেদন করার দেশের নাগরিক আইন মতে সুযোগ দিতে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয় আসাম সরকারকে। বাদপড়াদের নাগরিকত্ব প্রমাণের সমস্যার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে অতিরিক্ত ট্রাইবুনাল গঠনেরও নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত। আদালতের নির্দেশ মতো অতিরিক্ত একশোটি ট্রাইবুনাল গঠন করলেও বাদপড়াদের ট্রাইবুনালে গিয়ে নাগরিকত্ব  প্রমাণ করার সুযোগ দেয়নি রাজ্য সরকার। ট্রাইবুনালে আবেদন করতে হলে একটি রিজেকশন স্লিপ প্রয়োজন। এই স্লিপ সরকার থেকে দেওয়ার কথা। কিন্তু এনআরসি তালিকা প্রকাশের সাড়ে চার বছর কেটে গেলেও রিজেকশন স্লিপ দেওয়ার সময় হয়নি বিজেপি সরকারের। ফলে এই বিপুল সংখ্যক নাগরিক এখন ‘না ঘরের, না ঘাটের’। তাদের কোনো সরকারি সুবিধা মিলছে না। তাদের রেশন কার্ডও কেড়ে নিয়েছে। তবে ভোটের অধিকার রেখেছে। তাঁরা শুধু ভোট দেবেন। কিন্তু সরকারি সুবিধা পাবেন না। এককথায় এঁরা এখন 'রাষ্ট্রহীন ভোটার'। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এই ১৯ লক্ষের মধ্যে ১৪ লক্ষ হচ্ছেন হিন্দু বাঙালি। উপরন্তু এনআরসি তালিকা প্রস্তুতির সময় বেছে বেছে ২৭ লক্ষের বায়োমেট্রিক লক করে রেখে দিয়েছে সরকার। ফলে এখন তাদের আধার কার্ড হচ্ছে না। আধার কার্ড না থাকায় কিছুই জুটছে না তাদের। এমনকি তাদের  রেশনও বন্ধ করে দিয়েছে।  এদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্টই বাঙালি।    
নিম্ন আসামের গোয়ালপাড়া জেলার মাটিয়া ব্লক এলাকার  গভীর জঙ্গলে বাঙালিদের বন্দিশালা তৈরি করেছে মোদী সরকার। তীব্র প্রতিবাদের মধ্যে  গত ২৫ জানুয়ারি গোপনে এই বন্দিশালা চালু করে দিয়েছে। এই বন্দিশালায় অন্তত তিন হাজার বন্দিকে আটকে রাখার বন্দোবস্ত করেছে। এখন প্রায় প্রতিমাসে বেছে বেছে বাঙালিদের বিদেশি তকমা সেঁটে বন্দিশালায় ঢোকানো হচ্ছে। অত্যাচারে, অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় বিজেপি আমলে ডিটেনশন ক্যাম্পে অন্তত ৩৫ জন বন্দির করুণ মৃত্যু ঘটেছে। এখনও রাজ্যে ১ লক্ষ ২৫ হাজারের বেশি ‘ডি’ ভোটার অর্থাৎ সন্দেহভাজন ভোটার রয়েছেন। তাঁদের ভোটার তালিকায় নাম থাকলেও ভোটাধিকার নেই। সরকারি সুবিধাও জোটেনা। ভোটার তালিকায়  নাম থাকা, হাতে জমির দলিল থাকা, ভারতীয় নাগরিকের নথি থাকা বাঙালিদেরও সন্দেহভাজন বিদেশি তকমা সেঁটে  প্রতিদিন সমন ধরিয়ে দিচ্ছে সীমান্ত পুলিশ। এই সমন পেয়ে ট্রাইবুনাল কিংবা আদালতে গিয়ে  নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করতে ঘটিবাটি বেচে  অগণিত পরিবার পথে বসছে। অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। 


সম্প্রতি আসন পুনর্বিন্যাসের নামে রাজ্যের ভাষিক সংখ্যালঘু বাঙালিদের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে বিজেপি সরকার। নির্বাচন কমিশন এক্ষেত্রে বিজেপির হাতে নিজের স্বতন্ত্রতা বিসর্জন দিয়ে সম্পূর্ণ  অনৈতিক পথ অবলম্বন করে রাজ্যের আসন পুনর্বিন্যাসের করেছে। আসন পুনর্বিন্যাসে রাজ্যে বিধানসভার আসন কম-বেশি হয়নি। ১৯৭৬ সালে আসন পুনর্বিন্যাসের সময় ১২৬ টি আসন গঠন করা হয়েছিল। তা একই রয়েছে। শুধু মাত্র বাঙালি নিবিড় বরাক উপত্যকায় বিধানসভা আসন হ্রাস করে দিয়ে দিয়েছে। বরাকে আসন সংখ্যা ছিল ১৫ টি। তা হ্রাস করে এখন ১৩ টি করে দিয়েছে। ১৯৭৬ সালে বরাকের জনসংখ্যা ছিল ১৭ লক্ষ। তখন বিধানসভার আসন করা হয় ১৫ টি। আর এখন বরাকের জনসংখ্যা ৪২ লক্ষ। আসন করা হলো ১৩ টি। বিধানসভায় বরাকবাসীর কন্ঠ দুর্বল করা ও বিধায়ক তহবিল কমানোর উদ্দেশ্যেই নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে  আসন হ্রাস করে দিয়েছে বিজেপি। 
বরাক উপত্যকার স্কুলগুলি বন্ধ করে দিচ্ছে। উজান আসামে বাংলা মাধ্যমের স্কুল ক্ষমতায় এসেই তালা ঝুলিয়েছে। ১৯ মে ভাষা শহীদ দিবসের স্থানীয় ছুটি বাতিল করেছে। রবীন্দ্র জয়ন্তীর ছুটি বাতিল করেছে। শিলচর দূররদর্শন কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। বরাকের একমাত্র ভারী শিল্প কাগজকলে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে মোদী সরকার। মজুরি নিয়ে বরাক ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকারা চা বাগানের শ্রমিকদের সঙ্গে বৈষম্য করছে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার শ্রমিকদের তুলনায় বরাক উপত্যকার শ্রমিকদের মজুরি ২৫-৩০ টাকা কম। বরাকে ভাষা আইন লঙ্ঘন করে জোর করে অসমিয়া চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। নিপীড়ন, বঞ্চনার পাশাপাশি সুকৌশলে আসাম থেকে বরাক উপত্যকাকে পৃথক করার উসকানিও দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা। দুই মাস আগে শিলচরে দাঁড়িয়ে তিনি বলে গেছেন ‘পৃথক বরাক হলে তাঁর কোনো আপত্তি নেই’। আসামের সম্প্রীতির লক্ষ্যে, বিজেপি’র বিভাজনের চেষ্টার বিরুদ্ধে, এনআরসি’র নামে নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে সিপিআই(এম)।

 

Comments :0

Login to leave a comment