‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের লজ্জা’। র্যাগিংয়ের বিরোধিতার নামে ডাকা বিজেপি অনুগামী ছাত্র সংগঠনের মিছিলে এমনও বলতে শোনা গেল নেতাদের কয়েকজনকে। উঠল সেই ‘গোলি মারো’ স্লোগানও।
শুক্রবার ঢাকুরিয়া থেকে ছিল এই মিছিল। পুলিশের অনুমতি ছিল না। পুলিশ বাধা দিলে ধস্তাধস্তি হয়। কলকাতা হাইকোর্টের অনুমতি নিয়ে মিছিল করছে, বলে বিজেপি।
এর আগে একাধিক ঘটনায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রমণের কেন্দ্র করেছে বিজেপি। ঠিক একই সুরে কথা বলে চলেছে রাজ্যের সরকারে আসীন তৃণমূল কংগ্রেসও। ক্যাম্পাসে ঢুকে ভাঙচুর চালাতেও দেখা গিয়েছে। শুক্রবার যাদবপুরের ক্যাম্পাসের ভেতরে সে কারণে সতর্কতা ছিল ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষা মহলের বড় অংশেরই।
এদিন গোলপার্ক থেকে ৮বি পর্যন্ত ‘যাদবপুর অভিযান’এর ডাক দিয়েছে বিজেপি’র যুব সংগঠন এবং ছাত্র সংগঠন এবিভিপি। মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিজেপি’র বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী, অগ্নিমিত্রা পাল। রয়েছে দলের অন্যতম নেতা ইন্দ্রনীল খানও। তাঁরা স্লোগান তুলছেন, ‘লাল মুক্ত যাদবপুর চাই’।
এদিন বিজেপি-আরএসএস’র অনুগামী এবিভিপি’র ব্যানারে মিছিল থেকে উঠল ‘গোলি মারো’ স্লোগান। ২০২০’তে শাহিনবাগে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ চলছিল সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে। যে আইনে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। দিল্লিতে সেই বিক্ষোভকে আক্রমণ করে ‘দেশ কি গদ্দারো কো, গোলি মারো শালো কো’ স্লোগান তুলেছিলেন বিজেপি নেতা এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর। বিরোধিতাকে দেশদ্রোহিতা বলে দাগিয়ে দেওয়ার উগ্র মনোভাব স্পষ্ট করেছে এদিনের মিছিলও।
গত ৯ আগস্ট যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন হোস্টেলে মৃত্যু হয়েছে প্রথম বর্ষের এক পড়ুয়ার। র্যাগিংয়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে বাংলা। যাদবপুরের ক্যাম্পাসের ভেতরেও বড় অংশ সোচ্চার। ঘটনার তদন্তে নেমে ১৩জনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তদন্ত চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকারিক, ছাত্রদের বয়ান নেওয়া হচ্ছে।
তথাকথিত ‘স্বাধীন’ এবং সংগঠিত বাম আন্দোলনের বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলিকে হস্টেলে কর্তৃত্ব ফলানো এবং র্যাাগিংয়ের জন্য দায়ী করেছে বিশ্ববিদ্যালয়েরই বিভিন্ন অংশ। তৃণমূল নেত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিজে ঘটনা ঘিরে বামপন্থীদের আক্রমণ শুরু করেছেন। তবে তাঁর পুলিশের তদন্তে মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে বক্তব্যের প্রমাণ মেলেনি। তবে শুভেন্দু অধিকারী এবং মুখ্যমন্ত্রী সুর এক।
বিজেপি এবং তৃণমূল এক যোগে দাবি করে আসছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অনৈতিক কাজ হয়। কি কাজ হয় তা তারা প্রমান করতে পারেনি এখনও।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় রাজ্যের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তবে সেখানে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ নেই। এবিভিপিও নেই। এসএফআই রয়েছে কলা বিভাগের ছাত্র সংসদে। বাকি দুটি বিভাগে এসএফআই বিরোধী শক্তি সেখানে ছাত্র সংসদ চালায়। তৃণমূল বিজেপি ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ উঠেছে এই সংগঠনগুলিকে ঘিরে। তারাই র্যাগিংয়ে অভিযুক্ত। তদন্ত অন্যদিকে ঘোরানোর প্রয়াস কিনা সে প্রশ্ন উঠেছে বিজেপি এবং তৃণমূলের বক্তব্য ঘিরে।
২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবিভিপির একটি অনুষ্ঠানে আসেন তৎকালীন বিজেপি সাংসদ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। সেখানে তার অনুষ্ঠানের পর এবিভিপির সদস্যদের হাতে আক্রান্ত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। মারধর করা হয় তাদের। এখন সেই বাবুল সুপ্রিয় তৃণমূল মন্ত্রীসভার সদস্য। রাজ্যের পর্যটন মন্ত্রী।
বলা হচ্ছে যাদবপুরে দেশ বিরোধী কার্যকলাপ চলে। ঠিক যেমন ভাবে জেএনইউ, জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে লক্ষ্য করা হচ্ছে।
প্রাক্তন এসএফআই নেতা, বর্তমানে সিপিআই(এম) এমপি ভি শিবদাসন ক’দিন আগে কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষামন্ত্রকের কাছে আরটিআই করে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর খতিয়ান জানতে চেয়েছিলেন। বিজেপি'র সরকারের রিপোর্ট বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২৩-এর মধ্যে ৯৮ জন ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আইআইটি-গুলিতে ৩৯ জন, এনআইটি-গুলিতে ২৫ জন, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ২৩ জন, এবং আইআইএম বা আইসার ধরলে আরো ৯জন। শুধু ২০২০ থেকে এইমস-গুলিতে ১৩ জন ছাত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর অন্যতম কারণ র্যাগিং।
যাদবপুরে তথাকঠিত স্বাধীন কলা বিভাগে ‘ফ্যাস’ ভেঙে টিএমসিপি তৈরি হয় ২০১২ সালে। তার আগে অবধি টিএমসিপির রাজ্য সভাপতিরা ‘ফ্যাস’-র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আসতেন। ২০১৭-তে ডিএসএফ ভেঙে তৈরি হয় যাদবপুরের এবিভিপি। এই সেদিন, ২০২১ সালে, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনই ‘স্বাধীন সংগঠন’ আইসি ভেঙে তৈরি হয় টিএমসিপি’র প্রেসিডেন্সি শাখা।
ফলে শুক্রবার যাদবপুর ঘিরে বিজেপি’র ধুন্ধুমার কর্মসূচির উদ্দেশ্য ঘিরে প্রশ্ন রয়েছে।
Comments :0