Balu

আরও ৪ দিন জেলা হেপাজতে প্রাক্তন খাদ্য মন্ত্রী

রাজ্য

পার্থ চ্যাটার্জি, অনুব্রতর পথেই মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। মানি লন্ডারিং টাকা নয়ছয়ের অভিন্ন কৌশল। এমনকী নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে ধৃত আরেক তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যের সঙ্গেও মিল রয়েছে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের রেশন দুর্নীতির টাকা পাচারের কৌশলের।
সেই অভিন্ন কৌশলের একটাই ছবি— ভুয়ো সংস্থা তৈরি করা। তারপর সেখানে নিজের পরিবারের সদস্যদের ও ঘনিষ্ঠদের ডিরেক্টর করা এবং স্রেফ কাগজে-কলমে অস্তিত্ব থাকা সেই সংস্থাগুলির অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ টাকা অন্যত্র পাচার করা। পার্থ চ্যাটার্জি যেমন জামাই ও ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অর্পিতা মুখার্জি, অনুব্রত যেমন তাঁর বাড়ির পরিচারক ও নিজের কন্যা, মানিক ভট্টাচার্য যেমন নিজের স্ত্রী ও পুত্রকে ভুয়ো সংস্থার ডিরেক্টর পদে বসিয়ে টাকা পাচার করেছেন, তেমনই প্রায় একই কৌশলে প্রাক্তন খাদ্য মন্ত্রী ও বর্তমান বন মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক তাঁর স্ত্রী, কন্যা, এমনকী বাড়ির পরিচারককে ভুয়ো সংস্থার ডিরেক্টর বানিয়ে সেই কোম্পানির মাধ্যমে রেশনের চাল, আটা খোলা বাজারে বিক্রির বিপুল পরিমাণ কালো টাকা সাদা করেছেন।
প্রথমে জেরায় অসহযোগিতা করলেও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার লাগাতার জেরার মুখে ধীরে ধীরে মুখ খুলতে শুরু করেছেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। ইডি সূত্রের দাবি, জেরায় প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে তিনি জানিয়েছেন, তাঁরই নির্দেশে তাঁর স্ত্রী ও কন্যা তিনটি সংস্থার ডিরেক্টর হয়েছিলেন। সেই সংস্থায় এখনও ডিরেক্টর রয়েছেন তাঁর বাড়ির পরিচারক। বালুর নির্দেশেই তাঁর স্ত্রী মণিদীপা মল্লিক ও কন্যা প্রিয়দর্শনী মল্লিক চেকবইয়ে সই করে কোম্পানি থেকে বিপুল টাকাও তুলতেন। ইতিমধ্যেই মেয়ের সঙ্গে কথাও বলেছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী আধিকারিকরা। তিনিও স্বীকার করেছেন তিনটি কোম্পানির ডিরেক্টর থাকার কথা। বালু খাদ্য মন্ত্রী হওয়ার পরেই তিনটি কোম্পানিতে তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে ডিরেক্টর হয়ে যান।
রবিবার ছুটির দিনে আদালতেও সেকথা জানিয়েছেন ইডি’র আইনজীবীরা। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে দু’দফায় ১৪ দিনের ইডি’র হেপাজত শেষে সোমবার আদালতে তোলার কথা ছিল। এদিন সকালে সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বের করে রুটিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার পরে তাঁকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তোলা হয়। আদালতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তরফে আইনজীবী বিচারককে জানান, ধৃত মন্ত্রী অত্যন্ত প্রভাবশালী। গ্রেপ্তার হওয়ার পরেও তিনি রাজ্য মন্ত্রীসভার সদস্য রয়েছেন, দলীয় পদেও বহাল আছেন। ইতিমধ্যে তাঁরা একাধিক নতুন তথ্য পেয়েছেন তদন্তে। তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী, তাই আদালতে প্রকাশ্য শুনানিতে সব তথ্য তাঁরা জানাচ্ছেন না, তাতে তদন্ত ব্যাহত হতে পারে।
এরপরেই বিচারক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে ৪ দিনের জেল হেপাজতের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে ইডি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে জেলে গিয়ে জেরা করার যে আবেদন জানিয়েছিল, তাও মঞ্জুর করেছে আদালত। তবে বালুর তরফে এদিন জামিনের আবেদন জানানো হয়নি। ধৃত মন্ত্রীর তরফে আইনজীবীরা তাঁর অসুস্থতার কথা জানিয়ে বলেন, এর আগে যেদিন আদালতে তোলা হয়েছিল, তার থেকেও মন্ত্রীর শরীরের অবস্থা খারাপ হয়েছে। তাঁকে জেলে না পাঠিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হোক। ইডি’র আইনজীবীরা তখন বলেন, ইতিমধ্যে কম্যান্ড হাসপাতালে তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছে। সেখানে তাঁকে স্থিতিশীল বলেই জানানো হয়েছে। এরপরে বিচারক জানান, বেসরকারি হাসপাতাল থেকে যে ডায়েট চার্ট দেওয়া হয়েছে, সেই অনুযায়ী খাবার জেলে মিলবে, সেই সংক্রান্ত রিপোর্ট আদালতে দিতে হবে জেল কর্তৃপক্ষকে। এর আগে এদিন সকালেই জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক সাংবাদিকদের সামনে নিজের অসুস্থ দাবি করে বলেন যে, ‘‘আমি মরে যাবো।’’ আবার তিনি যে ই্ডি’র হেপাজত থেকে মুক্ত, তাও জানান সাংবাদিকদের।
কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার জেরার মুখে ইতিমধ্যে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের বাড়ির পরিচারক রামস্বরূপ শর্মা জানিয়েছেন, তাঁকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে মন্ত্রীর লোকরা সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি জানতেনই না যে, তিনটি কোম্পানির ডিরেক্টর বানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। সেই তিনটি কোম্পানি হলো, শ্রী হনুমান রিয়েলকন প্রাইভেট লিমিটেড, গ্রেসিয়াস ইনোভেটিভ প্রাইভেট লিমিটেড, গ্রেসিয়াস ক্রিয়েশান প্রাইভেট লিমিটেড। এই তিনটি সংস্থাতেই ২০২১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি একই দিনে ডিরেক্টর হয়ে যান একসময়ে স্যালোন চালানো, পরবর্তীতে মন্ত্রীর বাড়ির পরিচারকের কাজ করা এবং কৃষি দপ্তরে চুক্তিভিত্তিক কর্মী রামস্বরূপ শর্মা। এই তিনটি সংস্থাতেই ২০২১’র আগে পর্যন্ত ডিরেক্টর ছিলেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের স্ত্রী মণিদীপা মল্লিক ও কন্যা প্রিয়দর্শিনী মল্লিক। ২০২১’র ভোটে তৃণমূল ফের সরকারের আসার পরেই বালুর দশ বছরের খাদ্য মন্ত্রীর ইনিংস শেষ হয়। বালুকে মুখ্যমন্ত্রী বন দপ্তরে পাঠান। একুশ সালের ভোটের আগেই ওই তিনটি কোম্পানি থেকে খাতায়-কলমে সরে যান বালুর স্ত্রী ও মেয়ে। তিনটি কোম্পানির একই ঠিকানা— ১০০/৭৫, ভগবতী কলোনি, যশোর রোড, ফ্ল্যাট নম্বর— বি, দমদম, কলকাতা ৭০০০৭৪। তিনটির মধ্যে দু’টি কোম্পানিকে ইতিমধ্যেই লিকুইডেশন দেখানো হয়েছে। তিনটি আসলে শিখণ্ডী সংস্থা। মূলত মানি লন্ডারিংয়ের জন্যই ব্যবহার করা হতো।
মন্ত্রীর স্ত্রী শুধু এই তিনটি নয়, মোট ন’টি সংস্থার ডিরেক্ট্রর। ন’টি সংস্থাতেই জ্যোতিপ্রিয় যখন খাদ্য মন্ত্রী হয়ে রেশন দুর্নীতি চক্র খুলেছেন, সেই সময়েই তাঁর স্ত্রী ডিরেক্টর হিসাবে যোগ দিয়েছেন। এর মধ্যে আবার পিকাসো রিসর্ট হোটেল প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিও রয়েছে, যেখানে ধৃত মন্ত্রীর স্ত্রীর সঙ্গে ডিরেক্টর ছিলেন অভিজিৎ দাস। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক খাদ্য মন্ত্রী থাকার সময়ে প্রথম তিন বছর তিনি ছিলেন আপ্ত সহায়ক। তাঁর বাড়ি থেকেই তল্লাশিতে একটি মেরুন ডায়েরি উদ্ধার হয়, যাতে একাধিক তথ্য মিলেছে বলে দাবি কেন্দ্রীয় তদন্তাকারী সংস্থার।

Comments :0

Login to leave a comment