Buxa

ছবির মতো বক্সাদুয়ারে চক্রান্তের মেঘ

ফিচার পাতা

Buxa

পার্থপ্রতিম নাগ
 

তখনো গত মাসের শেষ সপ্তাহ অতিক্রম করেনি। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রতিবেশী রাজ্য মেঘালয় এবং ত্রিপুরায় গিয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেত্রী একটার পর একটা জনসভায় নানান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দেবার সময় তাঁর রাজ্যে মানে পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়ন ক্ষেত্রে কতো কাজ তিনি করেছেন তার ফিরিস্তি শুনিয়ে এসেছেন। আদিবাসী ও পাহাড়ের মানুষের জন্য তাঁর দরদের কথাও বলেছেন লম্বা লম্বা করে। যথারীতিই ভিত্তিহীন সব তথ্য হাজির করে বলে এসেছেন,পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যালয় শিক্ষা ক্ষেত্রে তিনি জোয়ার এনে দিয়েছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের বর্তমান ও ভবিষ্যত তিনি গড়ে দিয়েছেন।অথচ বাস্তবে দেখা গেল এক্ষেত্রেও তিনি যা দাবি করলেন ফল হলো তার ঠিক উল্টো। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহের একেবারে শেষ ভাগে  এক ফরমানে রাজ্য থেকে ৮,০০০ এরও বেশি সরকার পোষিত বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এই মর্মে ঘোষণা হয়ে গেল।এখানে উল্লেখ্য,সংবিধান বলছে বিদ্যালয় শিক্ষা থেকে শৈশবকে কখনই কোনো যুক্তিতেই বাদ দিতে পারে না জনকল্যাণকামী গণতান্ত্রিক সরকার।এসত্ত্বেও রাজ্যে সরকারি বিদ্যালয়গুলি  বন্ধ করে দিতে রাজ্য সরকারের পক্ষে ধারাবাহিক নির্দেশিকা পৌঁছে গেছে সর্বত্রই।সরকারের সেই নির্দেশিকা পৌঁছেছে অবিভক্ত জলপাইগুলি জেলার প্রাকৃতিক ঐতিহ্য তথা একাধিক আদিবাসী জনজাতি অধ্যুষিত বক্সা পাহাড় এলাকায়।তাতেই বিক্ষোভ ছড়াচ্ছে।প্রাথমিক স্তর থেকেই বিদ্যালয় শিক্ষা খর্ব করার চক্রান্ত রুখতে দেশের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে এলাকাবাসীর প্রতিবাদ পত্র পাঠানোর তোড়জের চলছে।


বনাঞ্চল ঘেরা বক্সা পাহাড়ে রয়েছে অতি দুর্গম এলাকায় দূরে দূরে ৩টি প্রাথমিক এবং ১টি জুনিয়র হাই স্কুল। জঙ্গল এলাকায় খুব ছোটো ছোটো গ্রামগুলিতে খুবই স্বল্প সংখ্যক মানুষের বসবাস। তাঁরা বাঁচেন এই পাহাড় ও অরণ্যকে ঘিরে।শিক্ষা সহ জীবন মানের সব দিকেই এই ভুটিয়া, শেরপা, টোটো, ডুকপা, তিব্বতী এবং ইয়েলনো জনগোষ্ঠীর পরিবারের মানুষগুলিই এখনকার বাসিন্দা।ডুকপা পরিবারের সংখাটা কিছুটা তুলনায় বেশি। যদিও এঁরা অনেকটাই পিছিয়ে।বন বিভাগে দিনের পর দিন সঠিক নিয়োগ বন্ধ থাকায় বন সহায়ক কর্মী হিসাবে পরিবারের বড়রা কাজও পাচ্ছেন না অনেকেই এই জমানায়।রয়েছে রাজ্যের শাসক দলের হুমকি।কাজ পেলেও তোলা দেবার অঘোষিত নিয়ম-কানুন এক্ষেত্রেও রয়েছে।জীবন এঁদের কাছে সব দিক থেকেই ওষ্ঠাগত।এই পাহাড়ি ছাদ বক্সা থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরে কলকাতায় বসে তাই এই এলাকার উন্নয়নের প্রকৃত ছবিটা দেখা অসম্ভব।তবু বিদ্যালয় শিক্ষা বন্ধের এই ফরমান মানতেই হবে।এমন হুমকিতে বক্সা পাহাড়বাসী সহজলপাইগুড়ি,আলিপুরদুয়ার জেলার অরণ্যাঞ্চল, এবং উত্তরবঙ্গের সমস্ত পার্বত্য ও বনাঞ্চলে একই আতঙ্ক এখন দাবানলের মতো ছড়িয়েছে।এর প্রেক্ষিতে উত্তরবঙ্গ জুড়ে ‘উদ্যান বাঁচাও সমিতি’ সহ অন্যান্য অংশের জনগণ এবং বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠন ও সংস্থাগুলি ইতিমধ্যেই জনগণের মধ্যে প্রচারে নেমেছে।তাদের বক্তব্য, এলাকার প্রকৃত উন্নয়ন ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষায় রাজ্য সরকারকে তার বিদ্যালয় শিক্ষা বন্ধের ধ্বংসাত্মক ফরমান অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নিতে হবে।প্রতিবাদীরা বলছেন, রাজ্য সরকারের জন-উন্নয়ন পরিপন্থী এই হুমকি দক্ষিণবঙ্গেও সুন্দরবনের বড় মোল্লাখালি,ছোট মোল্লাখালি,মাতলার এপার ওপার,সাগর ব্লকের একাধিক গ্রাম  সহ বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় ভয়াবহ এবং সুদূর প্রসারী বিপদকে নিশ্চিত করবে।

 বাঁকুড়া,পুরুলিয়া,বীরভূম,পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম জেলার অরণ্য প্রকৃতি ঘেরা এলাকাতেও একই বিপদের ছায়া।সর্বত্রই বুনিয়াদী বিদ্যলায় শিক্ষা ক্ষেত্রে এই হামলার প্রতিবাদ তাই ছড়িয়ে দিতে হবে রাজ্য জুড়ে।বিষয়টি নিয়ে আইন-আদালত তো বটেই দেশের রাষ্ট্রপতির কাছেও যেতে হবে।দেশের সংবিধান এবং সাংবিধানিক সকল সংস্থা ও ব্যবস্থার প্রধান আদিবাসী মহিলা রাষ্ট্রপতি যাঁকে রাজ্যের শাসক  মন্ত্রী-নেতারা নির্বিচারে অপমান করেছেন অতি সম্প্রতি তাঁকেও জানাতে হবে চক্রান্তের বিস্তারিত।বিষয়টি তুলে ধরা হবে রাজ্যপালের কাছেও।এই ধারার প্রতিবাদের প্রাথমিক স্তরে জেলা আধিকারিক,রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষা সচিব সকলের কাছেই যেতে হবে।রাজ্যের শিক্ষা ক্ষেত্রকে আর্থিক ও নানান দিক থেকে কলুষিত করে এখন তার দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত রাজ্যের যে সরকার প্রয়োজনে তার অপসারণের দাবি নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।এই প্রতিরোধে বিদ্যালয় স্তরে ছাত্র সমাজ ও অভিভাবকদেরও শামিল করতে হবে।


উদ্বিগ্ন বক্সা পাহাড়তলি ও পাশের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ জানাচ্ছেন,রাজ্য সরকারের পক্ষে বিদ্যালয় বন্ধ করা বা তা তুলে দেবার ফরমানের মূল বিষয় হলো বক্সায় আর লেখা-পড়া হবে না।এখনকার আলিপুরদুয়ার জেলা তথা পশ্চিমবঙ্গের গর্ব বক্সা পাহাড়ের মাথায় সবকটি সরকারি বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল।
বক্সা পাহাড়ে পৌঁছানো এখনও অনেকটাই দুর্গম। যে জায়গায় দিনে একবার  মাত্র সরকারি বাস থামে সেই এলাকা হলো ২৯বস্তি। এখানে বাস থেকে নেমে  বেশ খানিকটা পথ হেঁটেই যেতে হয় সান্তালাবাড়ি।এর পরে রয়েছে আরো একটি ছোট্ট পাড়া বা গ্রাম।সেটা ছাড়ালে সদরবাজার,ডারাগাঁও,বক্সা ফোর্ট,লাল বাংলা,তাসি গাঁও।পূর্ব দিকে খাটালাইন হয়ে লেপচাখা ও ওছলুম। প্রতিটি গ্রামই যেন এক একটা ছবির মতো। পশ্চিমে চুনাভাটি, নামনা,সেওগাঁও আর আদমা।গ্রামগুলো সবকটিই জঙ্গল ঘেরা। সেই যুক্তিতে এখানকার মানুষগুলি রাজ্যের বর্তমান সরকারের নজরে জঙলি। এখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে হত দরিদ্র এইসব জঙলি পরিবার থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা সর্বত্রই স্বাভাবিক নিয়মে ৩০ এর বেশি নেই। তাই রাজ্য সরকার সেই যুক্তিতেই এখানকার প্রথমিক বিদ্যালয়গুলি বন্ধ করে দেবার ‘নোটিস’ দিয়েছে। এখানেই প্রশ্ন এই নোটিস কতোটা যৌক্তিক। যেখানে দেশের সংবিধান বলছে প্রত্যেক শিশুকে বিদ্যালয়মুখী করতে হবে।তারা যাতে মাঝখানে লেখা–পড়া ছেড়ে চলে না যায় তার জন্য তাদের মুখে দিনে অন্তত পক্ষে এক বেলা খাবার ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে সেখানে সরকারি সর্বনশা এই নিষেধাজ্ঞা কেন?

 

 


এই বিষয়ে এলাকাবাসী তথা অরণ্য ও প্রকৃতি প্রেমিরা বলছেন রাজ্যের বর্তমান সরকার বক্সা পাহাড় জঙ্গল ও সংলগ্ন অরণ্য প্রকৃতিকেও বহুজাতিক পুঁজির মালিকদের হাতে তুলে দিতে চাইছে। তার ব্যবস্থা পাকা করতেই অরণ্যাঞ্চলে নতুন কোনো কাজ আর পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাভাবে পাহাড়বাসী এমনিতেই অনেকে নিচে নেমে গেছেন। প্রধানমন্ত্রীর আবাস প্রকল্প,দৈনিক রোজগার প্রকল্প এসবই এখানে গল্প কথা। অরণ্য থেকে কাঠ,মধু সংগ্রহ করার নানা বাধা। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার হাল যা ছিল তাকে এই কয়েকটা বছরে তুলে দেওয়া হয়েছে।এক কথায় বক্সা পাহাড় ও অরণ্য প্রকৃতি শ্রীহীন। থাকার মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ছিল শিশু শিক্ষার সামান্য সংস্থান। এখন তাও তুলে দিচ্ছে এই রাজ্য সরকার। এর অর্থ বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে চিরতরে আঁতে ও ভাতে মারার ছক‌। রাজ্য সরকার চাইছে বক্সা পাহাড় ছেড়ে সব্বাই চলে যাক। তার জন্য প্রচার করা চলছে বছর দুই ধরে এই পাহাড় ও বনাঞ্চলে সরকারি উদ্যোগে বাঘ ছাড়া হবে। হবে ব্যাঘ্র সংরক্ষণ প্রকল্প। গল্প চালু আছে এই বক্সায় নাকি রাতের অন্ধকারে কালো চিতা ঘোরাফেরা করছে। সেইসব বাঘের ছবিও উঠেছে গোপন ক্যামেরায়।এই প্রচার বা অপপ্রচারকে সামনে এনেই চলছে এলাকাবাসীকে পাহাড়,বন ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য করা।সেক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের মধ্যস্ততায় পরিবার পিছু পাওয়া যাবে ১০লক্ষ টাকা এমন প্রচারও ছড়ানো হয়েছে রাজ্যের শাসক দলের শাখা-প্রশাখার পক্ষে।এতেও ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে রাজ্য সরকার এখন বক্সা এলাকাকে জনশূন্য করতে উঠে পড়ে লেগেছে।তাই শিক্ষার ওপর কুঠারাঘাতের পাকাপাকি  ব্যবস্থা হলো সরকারি বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া।রাজ্য সরকারের বোঝাপড়াটা হলো রোজগার সহ বেঁচে থাকার সব ব্যবস্থা রদ করো।সন্তানসন্ততিদের লেখা–পড়াটাও অনিশ্চিত করে দিতে হবে চিরতরে।তাহলেই এলাকা ছাড়তে এখনও দ্বিধাগ্রস্ত যাঁরা তারাও বাধ্য হবেন পরিস্থিতির চাপ মেনে নিতে।


রাজ্যের বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের পক্ষে এই পাহাড় জঙ্গল বহুজাতিকদের কাছে বিক্রি করে দেবার শঠ পরিকল্পনা নিয়ে তাই প্রতিবাদীরা ক্রমেই জোটবদ্ধ হচ্ছেন।তঁদের গরিষ্ঠ অংশের বক্তব্য, প্রকৃতির পাশে সহবাসের সুখী ও তৃপ্তিকর জীবন ছেড়ে তাঁরা যাবেন না।শত প্রলোভন এলেও না।


 

Comments :0

Login to leave a comment