রাজ্যে প্রথম পঞ্চায়েত গড়ে উঠেছিল বামফ্রন্টের উদ্যোগে,‘বাস্তুঘুঘুদের’ তাড়িয়ে।
এবার লুটেরাদের কবল থেকে পঞ্চায়েতকে উদ্ধারের লড়াই। এবারের ‘জনগণের পঞ্চায়েত’ গড়ে তোলার আহ্বানও সেই বামপন্থীদের গলাতে।
শনিবারও সেই ধারাতেই রাজ্যজুড়ে প্রচার চলল বামফ্রন্ট এবং সহযোগীদের— ‘চোর তাড়াও, জনগণের পঞ্চায়েত গড়ো।’ ‘তৃণমূলকে হারাও, বিজেপিকেও রোখো’।
প্রভেদ আছে কিছু। তা সময়ের। এবং অবশ্যই সময়ের কারণে সমাজে, রাজনীতিতে তৈরি হওয়া পরিবর্তনের কারণে। ১৯৭৮-এ যে লড়াই ছিল বামফ্রন্টের, এবার, ৪৫ বছর পরে চোর তাড়িয়ে পঞ্চায়েত উদ্ধার, মানুষের পঞ্চায়েত গড়ে তোলার সংগ্রামে বামফ্রন্টের পাশে কংগ্রেস, আইএসএফ সহ গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ নানা সংগঠন, ব্যক্তি, সংগঠন।
বৃহস্পতিবার ছিল দশম পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারের শেষদিন। এদিন প্রতিটি ব্লকে, এমনকি বেশিরভাগ জায়গায় গ্রামে গ্রামে প্রচার করেছেন বামফ্রন্ট কর্মীরা। সেবার, ১৯৭৮-এ পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে পার্টির রাজ্য কমিটির পর্যালোচনায় প্রমোদ দাশগুপ্ত উল্লেখ করেছিলেন, কীভাবে তরুণ প্রজন্ম এবং মহিলারা অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। এবারও এখনও পর্যন্ত তাই। এবারও গত ১২বছর কাজ, শিক্ষা, নিয়োগের দাবিতে, দুর্নীতি, অত্যাচারের বিরুদ্ধে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় বারবার ঝলসে ওঠা তরুণ প্রজন্ম, মহিলারা পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এদিনও তাঁদের দেখা গেছে কোচবিহারের বাংলাদেশ সীমান্তে, চা বাগান থেকে সুন্দরবনের ব-দ্বীপ অঞ্চলে প্রচারের সামনের সারিতে। এদিন মিছিল হয়েছে হলদিয়া শিল্পাঞ্চল লাগোয়া গ্রামাঞ্চলে। মিছিল হয়েছে ঝাড়গ্রামের শাল, অর্জুন, পলাশে ঘেরা গ্রামগুলিতে। আদপে মিছিল হয়েছে প্রায় সর্বত্র। অনেক জায়গায় হয়েছে সভাও।
গত এক মাসের বেশি সময় রাজ্যের ৩৭,৯৪৫টি গ্রামে বামফ্রন্ট এবং সহযোগী শক্তিগুলির সম্মিলিত প্রচার পৌঁছেছে। এ কথা ঠিক, অভিষেক ব্যানার্জির লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ফলতায় তৃণমূল এবারও দখল নিয়েছে, বিরোধীদের প্রার্থী দিতে দেয়নি। তাঁর এলাকার মধ্যে থাকা বজবজ, ডায়মন্ডহারবারে লাগাতার বামফ্রন্টের কর্মী, সমর্থকদের আক্রমণ করেছে তৃণমূল। রাজ্যের এমন আরও কিছু জায়গা আছে, যেখানে ভোট হবে না শনিবার। কিন্তু বামফ্রন্টের প্রচার সেখানেও গেছে। রয়ে গেছে। আগামী লড়াইয়ের জন্য।
বামফ্রন্ট, কংগ্রেস, আইএসএফ কী চায় প্রথম থেকেই ছিল স্পষ্ট— ‘চোর তাড়াও, জনগণের পঞ্চায়েত গড়ে তোলো।’ যতদিন গেছে তৃণমূল কী চায় স্পষ্ট হয়েছে। তারা ফের দখল চায়। জোর করে কবজা করতে চায় পঞ্চায়েত— আবার লুটের জন্য।
আর বিজেপি? তারা লাগাতার চেষ্টা করেছে বিভাজন তৈরির। কোথাও ধর্মের নামে। কোথাও অন্য কৌশলে। মিডিয়াও তৃণমূল এবং বিজেপি’র লড়াই শুধু হচ্ছে বোঝানোর জন্য প্রচার চালিয়েছে। এমনকি সেই দ্বিমেরু প্রতিষ্ঠা করার জন্য সমীক্ষাও প্রকাশ করেছে— যা তাদের মনগড়া সমীক্ষাতেই স্পষ্ট। মূল লক্ষ্য ছিল বামফ্রন্ট কর্মীদের বিভ্রান্ত, হতোদ্যম করা।
এদিনও, গত একমাসের মতো, শুধু তৃণমূলের বিরুদ্ধেই নয়, বিজেপি’র বিরুদ্ধে প্রচার করেছেন বামফ্রন্ট কর্মীরা। এসেছে মোদী-শাসনে জিনিসপত্রের দামের প্রশ্ন। এসেছে গ্যাসের দামের কথা। এসেছে বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা। আর অবশ্যই তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপি’র বোঝাপড়ার উদাহরণগুলি তুলে ধরেছেন বামফ্রন্টের প্রচারকরা। কীভাবে তৃণমূল-বিজেপি একসঙ্গে পঞ্চায়েত চালিয়েছে, লুট করেছে, তা বলেছেন বামফ্রন্ট কর্মীরা। কেন সারদা, নারদ স্টিং অপারেশন থেকে বিভিন্ন দুর্নীতির তদন্তে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলি ঢিলেমি দিয়েছে, হয়েছে তারও প্রচার।
তৃণমূল লাগাতার প্রচার চালিয়েছে যে, তারা হারলে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলি বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের লক্ষ্য ছিল গরিব মানুষকে এমনভাবে নিজেদের পক্ষে রাখা। এদিনও সভাগুলিতে বামফ্রন্ট কর্মীরা বলেছেন যে, কে সরকারে কিংবা পঞ্চায়েতে আছে, তাতে কিছু যায় আসে না। সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প বন্ধ হয় না। বরং তৃণমূলের হাত থেকে পঞ্চায়েত, সরকার মুক্ত হলে, চুরির টাকা উদ্ধার করে ভাতার পরিমাণ বাড়তে পারে।
এদিনও কিছু জায়গায় বামফ্রন্ট কর্মীদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছে তৃণমূল, বিজেপি। শনিবার নির্বাচন। নির্বাচনের দিন বুথ দখলে, ভোটদাতাদের আটকাতে শেষ মুহূর্তেও হুমকি দিয়েছে দুটি দলই। কিন্তু জবাব দিয়েছেন বামফ্রন্ট কর্মীরা— লড়াই এবার প্রতিটি পর্যায়ে, শেষ পর্যন্ত।
ভরসা কীসের এই লড়াইয়ের? মানুষ। মানুষ তৃণমূলের উপর ক্ষিপ্ত। বুঝতে পেরে কোচবিহারের নির্বাচনী সভায় মমতা ব্যানার্জি বলেই ফেলেছিলেন যে, এই নির্বাচনে হারলেও সরকার যাবে না। মানুষ বিজেপি’র সরকারের উপরও ক্ষুব্ধ। এবার তাঁদের প্রবল আকাঙ্ক্ষা— ‘ভোট দেবো। গতবার ভোট দিতে দেয়নি। এবার দেবোই।’
প্রচারের শেষ দিনেও গ্রামবাসীদের মুখে সেই আকাঙ্ক্ষাই শোনা গেছে।
Comments :0