vinesh phogat

বীনেশকে নিয়ে ঘৃণ্য মন্তব্য বিজেপি নেতার

জাতীয় খেলা

‘‘দু-চারটে কাপড় খুলে ফেললেই তো দু’শো গ্রাম ওজন কমে যেত।’’ এদেশের খ্যাতনামা মহিলা কুস্তিগীর বীনেশ ফোগট সম্পর্কে ঠিক এই কুৎসিত মন্তব্যই করেছে বিজেপি’র এক নেতা। 
চলতি প্যারিস অলিম্পিকে ফাইনালে উঠলেও যৎসামান্য ওজনের অজুহাতে রহস্যময়ভাবে প্রতিযোগিতা থেকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে বীনেশকে। তারপরেই সোশাল মিডিয়ায় এহেন কদর্য মন্তব্য লিখেছে বিশাল বর্সন নামে এই বিজেপি নেতা। নামের আগে ফলাও করে নিজের ‘বিজেপি’ পরিচয় জানাতেও ভোলেনি সে। 
বিজেপি নেতার এই বিকৃত মানসিকতার বিরুদ্ধে ধিক্কারে ফেটে পড়েছেন নেটিজেনরা। দেশের নানা প্রান্তে শুরু হয়েছে বিক্ষোভও। আলিগড়ের কোয়ার্সি থানায় এফআইআর দায়ের হয়েছে। বিক্ষোভ দেখিয়েছেন স্থানীয়রা। হিন্দি লোকসঙ্গীত শিল্পী নেহা সিং রাঠোর বিজেপি নেতার এই মন্তব্য সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করে লিখেছেন, ‘‘ওয়াক থু’’। শাসকদলের জঘন্য মানসিকতার বিরুদ্ধে একরাশ ঘৃণা উগরে দিয়েছেন এই শিল্পী। সাহসী নেহা এর আগেও নরেন্দ্র মোদী সহ বিজেপি’র নেতা-মন্ত্রীদের নানান আপত্তিকর কাজের জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছেন প্রকাশ্যেই। 
সকলেই বলছেন, শুধু বীনেশ নয়, সামগ্রিকভাবে মহিলাদের সম্পর্কেই বিজেপি’র ঘৃণ্য মানসিকতা আরও একবার প্রকাশিত হলো বিশালের এই কুৎসিত মন্তব্যে। বীনেশ ফোগট, সাক্ষী মালিকরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে কুস্তি লড়ে জীবনভর দেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন। একের পর এক পদক এনেছেন দেশের জন্য। কিন্তু একইসঙ্গে কেন্দ্রের শাসকদলের নেতাদের যৌন হেনস্তা থেকে নিজেদের সম্মান-সম্ভ্রম বাঁচাতে রাস্তায় নামতে হয়েছে তাঁদের; ফলে শাসকের চোখে তাঁরা ‘দেশদ্রোহী’ হয়ে গিয়েছেন! 
বিজেপি’র তৎকালীন সাংসদ এবং মোদী-ঘনিষ্ঠ ব্রিজভূষণ শরণ সিং জাতীয় কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান থাকাকালীন যেভাবে মহিলা কুস্তিগীরদের ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছে, তার প্রতিবাদে গতবছর সরাসরি রাজপথে নেমেছিলেন বীনেশরা। কিন্তু অভিযুক্ত সাংসদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, তাকে ঘটা করে নতুন সংসদ ভবনে ডেকে নিয়ে গিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর সেই দিনেই দিল্লির রাজপথে জাতীয় পতাকা বুকে আঁকড়ে রাস্তায় পড়ে পুলিশের মার খেয়েছেন দেশের প্রথম সারির ওই কুস্তিগিররা। মাসের পর মাস বীনেশরা যন্তর মন্তরে ধরনায় বসে থেকেছেন, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করেছেন, ন্যায়বিচার চেয়েছেন। কিন্তু ন্যায়বিচার মেলেনি। উলটে তীব্র হেনস্তা-লাঞ্ছনার মুখে পড়তে হয় বিশ্ব-পদক জয়ী অ্যাথলিটদের। কাঁদতে কাঁদতে পদক জলে ভাসিয়ে দিতেও যান তাঁরা। এসব ঘটনাতেই আরএসএস-বিজেপি অনুগামীদের কুৎসিত  চেহারা স্পষ্ট হয়ে যায় সারা দেশের সামনে।
এর পরেও সেই ব্রিজভূষণকেই আবার লোকসভা ভোটে উত্তর প্রদেশের কায়সেরগঞ্জ থেকে প্রার্থী করার চেষ্টা চালান মোদী-শাহরা! কুস্তি ফেডারেশনের প্রধানের পদেও ছক কষে বসানো হয় ব্রিজভূষণেরই এক ঘনিষ্ঠকে। প্রবল অসন্তোষে মোদীর বাড়ির বাইরে নিজেদের অর্জিত বিশ্ব-পদক রেখে দিয়ে আসেন বজরঙ পুনিয়া এবং বীনেশ ফোগট। দেশের প্রথম সারির ক্রীড়াবিদদের এই নাছোড় আন্দোলনের জেরে প্রবল জনমতের চাপে বিপাকে পড়ে মোদী সরকার। শেষপর্যন্ত চরম ভন্ডামির নজির রেখে ‘সাপও মরল না, লাঠিও ভাঙল না’ কৌশলে ছক কষে যৌন হেনস্তাকারী ব্রিজভূষণের ছেলেকেই সাংসদ বানাতে টিকিট দেন মোদী-শাহরা। 
হাজারো অপমান সহ্য করতে না পেরে সাক্ষী মালিক কুস্তিই ছেড়ে দেন। তবে তাতে কিছু যায় আসেনি মোদীর। বীনেশ তখনও খেলা ছাড়েননি। এবারের প্যারিস অলিম্পিকে বীনেশ গেলেন। যেদিন জিতলেন এবং প্রথম ভারতীয় মহিলা কুস্তিগির হিসাবে চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছলেন, গোটা দেশ সেদিন গর্বের সঙ্গে সোচ্চার হয়েছিল। মোদী বাহিনীর গালে বীনেশ এভাবে কষিয়ে থাপ্পড় দেওয়ায় সেদিন খুশি হয়েছিলেন অধিকাংশ দেশবাসীই। সোনা জেতার স্বপ্ন চোখে যখন দেশ ঘুমোতে গিয়েছে, বীনেশ তখন দেশবাসীর জন্য পদক অর্জনে ঘাম ঝরাচ্ছেন; ওজন কমানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। নিয়মের থেকে মাত্র একশো গ্রাম বেশি ওজন ছিল তাঁর। কেটে ফেলেছিলেন চুলও। জামা ছোট করেছেন। নখ কেটেছেন। কিন্তু তা-ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেননি। শরীর জলশূন্য হয়ে যাওয়ায় পরের দিন বীনেশকে হাসপাতালেও ভর্তি করা হয়। কোটি কোটি ভারতবাসীর স্বপ্নভঙ্গ হয়। বীনেশ ‘বাতিল’ ঘোষিত হন। প্রশ্ন উঠে যায়, বীনেশের কোচিং স্টাফদের বিরুদ্ধে—  কেন তাঁর ওজন আগে থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি? পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বীনেশ সোনা জিতে গেলে মোদী-শাহরা আরও জোরে থাপ্পড় খেতেন; তাই কি ইচ্ছা করেই তাঁকে সঠিক পরামর্শ দেওয়া হয়নি? এমন একাধিক প্রশ্নে সকাল থেকেই ছেয়ে যায় সোশাল মিডিয়া। সেদিনই অবসর ঘোষণা করেন বীনেশ।
অপ্রত্যাশিতভাবে বাতিল হয়ে যাওয়ার ধাক্কা বীনেশ হয়তো নিতে পারেননি। বীনেশ যেদিন জিতলেন, লক্ষ্যণীয়ভাবে সেদিন মোদীর তরফে কোনও শুভেচ্ছাবার্তা দেওয়া হয়নি! অথচ তাঁর ‘বাতিল’ হয়ে যাওয়ার খবরের কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেশের প্রধানমন্ত্রী দুঃখপ্রকাশ (!) করতে এতটুকু দেরি করেননি। বীনেশকে ‘আমাদের মেয়ে’, ‘দেশের মেয়ে’ ইত্যাদি বলে সন্দেহের ঊর্ধ্বে ওঠার চেষ্টা চালান তিনি। অথচ যৌন হেনস্তার বিচার চাওয়ায় তাঁর সাগরেদরা বীনেশকে শুধু ‘দেশদ্রোহী’ বানিয়েই দেয়নি, এখন ‘‘দু-চারটে কাপড় খুলে ফেলার’’ কুৎসিত নিদান দিচ্ছে! এরাই নাকি ভারতীয় সংস্কৃতির স্বঘোষিত ‘‘ধারক-বাহক’’! কটাক্ষ পর্যবেক্ষকদের। 
 

Comments :0

Login to leave a comment