একদম পরিকল্পিত চিত্রনাট্য!
অভিষেক ব্যানার্জির ‘বক্তব্য’ তুলে ধরেই কোটি কোটি টাকার নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত জেলবন্দি তৃণমূল নেতাদের নতুন কৌশল। পরিস্থিতি এমনই যে খোদ বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলি এজলাসেই বললেন, ‘‘এ এক মারাত্মক প্রবণতা। ন্যায় বিচারের স্বার্থে এসব বন্ধ করতে হবে। এই অতি চালাকি বরদাস্ত করা যাবে না।’’
নিয়োগকাণ্ডে ধৃত খাতায় কলমে ‘বহিষ্কৃত’ যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুন্তল ঘোষ যেভাবে অভিষেক ব্যানার্জির সমাবেশের বক্তব্যের সুরে সুর মিলিয়ে তদন্তকারী সংস্থার বিরুদ্ধে আদালতে চিঠি দিয়েছেন, অভিযোগ তুলেছেন তা নিয়েই ক্ষুব্ধ বিচারপতি।
গত ২৯ তারিখ শহীদ মিনারে দলীয় সভা থেকে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব্যানার্জি অভিযোগ করেছিলেন কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলো জেরায় তাঁর নাম বলতে চাপ দিচ্ছে। অভিষেক ব্যানার্জি দাবি করেন, ‘এই তো মদনদা জেলে ছিলেন। কুণাল ঘোষও জেলে ছিলেন। এদের বলা হয়েছিল, আমার নাম নিলেই ছেড়ে দেবে। আমার জন্য আলাদা আইন করার দরকার নেই।’ যদিও কুণাল ঘোষকে গ্রেপ্তার করেছিল রাজ্য পুলিশ, সিবিআই নয়। বরং কুণাল ঘোষ সেসময় সিবিআই’কে সব সত্যি জানাতে চাই, আসল বেনিফিশিয়ারিকে জেরা করা হোক এমন দাবিও বারেবারে আদালতে জানিয়েছিল।
অভিষেক ব্যানার্জির এমন মন্তব্যের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধৃত সরকারি চাকরি বিক্রির এজেন্ট যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল সাংবাদিকদের সামনে তার ‘নেতা অভিষেক ব্যানার্জির’ সুরেই বলেন, তদন্তকারী সংস্থা তাকে চাপ দিচ্ছে প্রভাবশালীদের নাম জানানোর জন্য। যদিও ইডি’র জেরার সময় এমন অভিযোগ করেনি সে। যখন জেল হেপাজত হয়, রাজ্য পুলিশের অধীনে আসে সে সময়তেই এমন ‘অভিযোগ’ তোলা শুরু হয়।
তারপর গত ৬ এপ্রিলও আদালতে ঢোকার মুখে প্রিজন ভ্যান থেকে নামার পরে সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘বিভিন্নভাবে ভয় দেখিয়ে আমাদের থেকে নেতাদের নাম বার করার চেষ্টা করছে এজেন্সি। আমরা মা মাটি মানুষের আদর্শে বিশ্বাসী। অভিষেক ব্যানার্জির নাম বলতে কেন্দ্রীয় এজেন্সি চাপ দিচ্ছে, আমি আদালতে জানাবো!’
এরপরেই কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তে হেনস্থার অভিযোগ এবং অভিষেক ব্যানার্জির নাম বলতে নাকি বাধ্য করা হচ্ছে দাবি করে হেস্টিং থানায় অভিযোগ করে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত এই তৃণমূল যুব নেতা। মঙ্গলবারই প্রেসিডেন্সি জেলের সুপারের মাধ্যমে হেস্টিংস থানায় অভিযোগ দায়ের করে কুন্তল ঘোষ। একইসঙ্গে আলিপুর আদালতের বিচারককেও একই অভিযোগ জানিয়ে চিঠি দেয় জেলবন্দি কুন্তল ঘোষ। স্পষ্টতই বোঝা যায় দলীয় নির্দেশেই এমন পদক্ষেপ জেলবন্দির।
এই ঘটনার পরেই বুধবার কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইডি। তাঁদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ জেলবন্দির তা আদালতের কাছে জানতে চায় ইডি। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তরফে আদালতে জানানো হয় পরিকল্পিতভাবে তদন্তকে বিপথে চালিত করতে, বিভ্রান্ত করতে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এদিন কলকাতা হাইকোর্ট যদিও জানিয়ে দেয় ধৃত কুন্তল ঘোষের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নিতে পারবে না। প্রথমার্ধেই অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশে বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলি বলেন, কুন্তল ঘোষের অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে নিম্ন আদালত ও পুলিশ কোনও পদক্ষেপ নিতে পারবে না। প্রেসিডেন্সি জেল সুপারের মাধ্যমে যে হেস্টিংস থানায় যে অভিযোগ হয়েছে তার ভিত্তিতে কোনও পদক্ষেপ নিতে পারবে না পুলিশ। পুলিশ কমিশনারকে সেই অভিযোগপত্র নিয়ে এসে আদালতে জমা দিতে হবে। একইভাবে দক্ষিণ ২৪পরগনা জেলা বিচারককে হাইকোর্টে জেলবন্দি কুন্তল ঘোষের অভিযোগকে আদালতে জমা দিতে হবে।
বিচারপতি গাঙ্গুলি বলেন, তদন্তকে বিপথে চালানোর জন্য যে সমস্ত পদ্ধতি নেওয়া হচ্ছে তা খুবই মারাত্মক। এর আগে বিচারপতিকে হুমকি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল ( গোরু পাচারকাণ্ডে আসানসোলে সিবিআই আদালতের বিচারককে হুমকি চিঠি)। তদন্তের স্বাভাবিক পথে বাধা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
বুধবার সকাল থেকেই চলে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একের পর এক নাটকীয় মোড়। আদালতের নির্দেশের পরেই দুপুরের মধ্যেই সেই অভিযোগপত্র আদালতে জমা পড়ে। বিচারপতি সেই চিঠি খুঁটিয়ে পড়েন। দু’টি চিঠিই মুখবন্ধ খামে আগামী কাল পর্যন্ত রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার ফের শুনানি।
Comments :0