EDITORIAL BILKIS BANO

জেলই ওদের আসল ঠিকানা

জাতীয় সম্পাদকীয় বিভাগ

বিজেপি’র মডেল রাজ্য নরেন্দ্র মোদীর গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ধর্মীয় মেরুকরণের ফায়দা লোটার পরিকল্পিত উদ্দে‍‌শ্যে অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস বানুর ধর্ষক ও বিলকিসের পরিবারের ১৪ জনের খুনি ১১ জন সংস্কারী ব্রাহ্মণকে জেল সাজার মাঝপথে আগাম মুক্তি দিয়েছিল গুজরাটের বিজেপি সরকার। জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর সঙ্ঘ পরিবারের কর্মী-সমর্থকরা বীরের সম্মানে ধর্ষক-খুনিদের স্বাগত জানায় ফুলের মালা পরিয়ে এবং মিষ্টি বিতরণ করে। পরে সঙ্ঘ পরিবারের এক দপ্তরে জমায়েত করে তাদের সংবর্ধনাও দেওয়া হয়। সেই ঘটনার প্রায় ১৮ মাস পরে দেশের সর্বোচ্চ আদালত হিন্দুত্ববাদী গুজরাট সরকারের গালে বিরাশি শিক্কার থাপ্পড় কষিয়ে জানিয়ে দিয়েছে সম্পূর্ণ অনৈতিক ও অবৈধভাবে গুজরাট সরকার ধর্ষক-খুনিদের সাজা মকুব করেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে, তথ্যকে আড়াল করে অসততার আড়াল করেছে, সত্য গোপন করে সুপ্রিম কোর্টকে বিভ্রান্ত করেছে এবং মহারাষ্ট্র সরকারের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ করেছে। ভাবা যায় কতটা অসৎ হলে একটা নির্বাচিত সরকার এভাবে প্রতারণার আশ্রয় নিতে পারে?
গুজরাটের গোধরা সাব জেল থেকে ইতিহাসে নজিরবিহীন এক নারকীয় গণধর্ষণ ও গণহত্যার ঘৃণ্য অপরাধীরা যখন সাজামুক্ত হ‍‌য়ে বুক ফুলিয়ে বেরিয়ে আসছে তখন দিল্লিতে লালকেল্লায় দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ৭৫তম দিবসে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের সূচনা করছেন। সেখানে তিনি বলেছেন মহিলাদের প্রতি অসম্মান হলে নাকি তাঁর যন্ত্রণা হয়। এটা যে আসলে কুমিরের কান্না, ভণ্ড, প্রতারক, মুখোশধারীর ছলনা তা বলার আপেক্ষা রাখে না।
নারীর অসম্মানে তাঁর যন্ত্রণা হয় বলছেন অথচ দেশজুড়ে প্রতি‍‌দিন অগণিত নারী যখন যৌন হিংসার শিকার তখন তার যন্ত্রণার কোনও প্রকাশ ঘটে না। একটার পর একটা কুৎসিত বর্বর ঘটনা ঘটে চললেও তিনি মুখে রা-ও কাড়েন না। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে যে মহিলা কুস্তিগিররা দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে তাদের উপর নিরন্তর যৌন নির্যাতনে তাঁর কোনও যন্ত্রণা হয় না। যোগী রাজ্যের উন্নাও, হাথরাসে যেসব ভয়াবহ ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা গোটা দেশকে আলোড়িত করেছে তাতেও মোদীর কোনও প্রতিক্রিয়া শোনা যায়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে আরএসএস-বিজেপি চালিত প্রশাসন ধর্ষক-খুনিদের আড়াল করছে। ধর্ষিতা-নির্যাতিতারা দলিত বা নিম্নবর্গের হলে এবং ধর্ষকরা উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ হলে তো কথাই নেই। হিন্দুত্ববাদী শাসকদের চোখে ধর্ষকরা মোটেই অপরাধী নয়। মনুবাদী আদর্শে উচ্চবর্ণের পুরুষ দ্বারা নিম্নবর্ণের মহিলাদের ধর্ষণ ন্যায়সঙ্গত। সম্ভবত সেই জন্য নরেন্দ্র মোদী ধর্ষণের ঘটনায় নীরবতার আশ্রয় নেন।
এই মোদী যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী তখন পুলিশ ও প্রশাসনের পূর্ণ সহযোগিতায় সংঘটিত হয়েছিল গুজরাট দাঙ্গা। সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছিল মুসলিম গণহত্যার অভিযান। সেই সময় প্রাণভয়ে সপরিবারে পালিয়ে বাঁচতে গিয়ে হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজ খুনিদের কবলে পড়েন ২১ বছরের বিলকিস বানুরা। জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে একে একে বিলকিসের সামনে খুন করা হয় পরিবারের ১৪ জন সদস্যকে। বিলকিসের তিন বছরের শিশু কন্যাকেও পাথরে আঁছাড় মেরে খুন করা হয়। অতঃপর ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিলিকিসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রামভক্ত ধর্ষক-খুনিরা।
গুজরাট দাঙ্গার এই অন্যতম বীভৎসতম ঘটনায় ধর্ষক-খুনি হিসাবে যাবজ্জীবন জেল হয় ১১ জনের। কিন্তু তাদের জেলে রাখতে নারাজ গুজরাট সরকার। নানা অজুহাতে তাদের প্যারোলে মুক্তি দিয়ে বেশিরভাগ সময় জেলের বাইরে রাখার ব্যবস্থা করে। জেলেও তাদের রাখা হয় রাজার হালে। অবশেষে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাদের সাজা মকুব করে দেয় বিজেপি সরকার। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে ধরা পড়ে গেছে।

Comments :0

Login to leave a comment