বিজেপি বিরোধিতার প্রশ্নে তৃণমূল কংগ্রেস ঠিক কতটা সৎ এবং দায়বদ্ধ সেটা অস্বচ্ছতা গোড়া থেকেই। জন্মলগ্ন থেকেই বিজেপি’র সঙ্গে ঘর করার দীর্ঘ ইতিহাস আছে তৃণমূলের। কেন্দ্রের জোট সরকারে বিজেপি’র সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছে তারা। রাজ্য বিধানসভা এবং লোকসভায় একাধিকবার বিজেপি’র সঙ্গে জোট গড়ে ভোটে লড়েছে। বিভিন্ন সময় আরএসএস এবং বিজেপি সম্পর্কে নেত্রীর মন্তব্যগুলিও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো যাদের একমাত্র লক্ষ্য সেই আরএসএস’কে তিনি প্রকৃত দেশপ্রেমিক সংগঠন বলে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তেমনি এমন কথাও তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন যে বিজেপি মোটেই অচ্যুৎ নয়। বিজেপি’কে ফ্রন্টে এনে লড়াই করার কথাও একদা তিনি অকপটে ঘোষণা করেছিলেন। মনে রাখা দরকার আরএসএস-বিজেপি সম্পর্কে তাঁর এমন অবস্থান ও মতামত তিনি কখনও প্রত্যাহার করেননি। এমন কথাও তিনি কখনও বলেননি যে আরএসএস-বিজেপি সম্পর্কে তাঁর আগেকার অবস্থান বদল হয়েছে। এখন তিনি পুরোপুরি বিজেপি বিরোধী।
আরও লক্ষণীয় বিষয়, বিজেপি’র বিরুদ্ধে হালে জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেও আজ পর্যন্ত তিনি কখনও আরএসএস’র বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। অর্থাৎ তিনি বিজেপি বিরোধী কিন্তু কোনও অবস্থাতেই আরএসএস বিরোধী নন। একেবারে কাঁঠালের আমসত্ত্ব। সচেতনভাবে আরএসএস ও বিজেপি’র মাঝখানে বিভাজন রেখা টেনে মানুষকে বোকা বানানোর কৌশল নিয়েছেন। তিনি যে মোটেই আরএসএস বিরোধী নন, বরং তলে তলে আরএসএস’র সহযোগী তার অনেক প্রমাণ গত সাড়ে বারো বছরের শাসনে ছড়িয়ে আছে। এই সময়ে তাঁর দল ও সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় রাজ্যজুড়ে আরএসএস’র কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে এবং সব জেলাতেই শাখা বেড়েছে কয়েকগুণ।
এটা সকলেরই জানা বিজেপি হলো আরএসএস’র রাজনৈতিক শাখা। যেমন, ছাত্র শাখা অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, শ্রমিক শাখা বিএমএস। আরএসএস তাদের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক প্রকল্প রূপায়ণের জন্য তৈরি করেছে বিজেপি’কে। বিজেপি নিয়ন্ত্রিত হয় আরএসএস’র রিমোটে। আরএসএস থেকে আসা সঙ্গীরাই বিজেপি’র যাবতীয় শীর্ষপদে নিযুক্ত হন। নীতি নির্ধারণের কেন্দ্রে থাকেন তাঁরাই। মমতা সেই আরএসএস-বিজেপি’কে আলাদা করে আরএসএস তোষণ করছেন আর বিজেপি’র বিরোধিতা করছেন। তিনি ধরে নিয়েছেন মানুষ ঘাসে মুখ দিয়ে চলে কেউ কিছু বোঝে না।
আগামী লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি বিরোধী জোট হিসেবে ‘ইন্ডিয়া’ সংহত হয়ে ওঠার আগেই চতুর্থ বৈঠকে আচমকা সকলকে অবাক করে দিয়ে মমতা জোটের প্রধানমন্ত্রী মুখ হিসাবে কংগ্রেস নেতা খাড়গের নাম প্রস্তাব করে দিলেন। সময় নষ্ট না করে সঙ্গে সঙ্গে তা সমর্থন করেন কেজরিওয়াল। আসন সমঝোতা, মুখ্য নির্বাচনী ইস্যু, রণকৌশল ইত্যাদি গুরুত্বপূণর বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা এগনোর আগেই আগবাড়িয়ে এই মুখ খোঁজার অতি তৎপরতা অনেকটা ছেলে না জন্মাতেই তার অন্নপ্রাশনের আয়োজন করে ফেলার মতো। তাছাড়া জোট বৈঠকের ঠিক আগে কেজরি, উদ্ধব প্রমুখ নেতাদের সঙ্গে আলাদা আলাদা মমতার কথাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। অনেকেই ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন এটা জোটের ভেতর আলাদা একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী তৈরির চেষ্টা নয়তো। জোটের মধ্যে প্রাথমিক আলোচনা না করে এভাবে দুম করে মুখ বাছাইয়ের চেষ্টা মোটেই স্বাভাবিক আচরণ নয়। তাছাড়া যে দলের নেতাকে মুখ করার কথা বলা হচ্ছে সে দলকে পূর্ণ অন্ধকারে রেখে নাম প্রস্তাব অত্যন্ত অসৌজন্যমূলক এবং আপত্তিকর। এতে জোটের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি দৃঢ় হবার বদলে শিথিল হয়ে যায়। জোটের মধ্যে বিতর্ক উসকে দিয়ে ভাগাভাগি ও ভাঙনের সম্ভাবনা তৈরি করে। যা আসলে বিজেপি’র রাস্তা পরিষ্কার করে দেওয়া। মমতার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাই সন্দেহ থেকেই যায়। কয়েকবছর আগেও গোয়ায় বিরোধী জোট চৌপাট করে দিয়ে বিজেপি’কে নিশ্চিত করেছিল তৃণমূল। ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়ে একই কাজ করেছে তারা। কেজরির ট্র্যাক বেকর্ডও অনেকটা একই। এবারও যে ভেতর থেকে তেমন কোনও খেলার সলতে পাকানো হচ্ছে না তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
Editorial India TMC
সন্দেহজনক
×
Comments :0