DAMODAR SANDPIT LOOT

রাত হলেই শ’য়ে শ’য়ে ট্রাক্টর ট্রলি, যেভাবে লুট হচ্ছে দামোদর

রাজ্য জেলা

DAMODAR SANDPIT LOOT

মলয়কান্তি মণ্ডল, রানিগঞ্জ

গত জুন মাসে দুই বন্ধু শুভ দাস ও সৌরভ নন্দী দামোদরে স্নান করতে নেমে আর ফেরেনি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাদের নিথর দেহ বাড়ি ফিরেছিল। পুত্র হারানোর বেদনায় এখনও কেঁদে ওঠে ওই দুই পরিবার। 

মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে মেয়েকে খাবার দিতে এসে নূপুর গ্রামের ঘাটে দামোদরের চোরাগর্তে তলিয়ে গিয়েছিলেন দিনমজুর মরা বাউরি। কোনওক্রমে সাঁতরে বেঁচে যান মরা বাউরির স্ত্রী কুড়ানি বাউরি। স্বামী হারিয়ে এখন অভাব অনটন তাঁকে গ্রাস করেছে। আধপেটা খেয়েপরে কোনক্রমে দিন গুজরান হচ্ছে। 

এরকম অজস্র দুর্ঘটনা রয়েছে। দামোদরে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা প্রতিদিন তৈরি করছে যথেচ্ছ অবৈধ বালি তোলা। বিপন্ন হচ্ছে নদী ও জনপদ। 

সারা পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ দামোদরের উপর নির্ভরশীল। ১৯৪৮ সালের ৭ জুলাই ডিভিসি (দামোদর ভ্যালি করপোরেশন) স্থাপিত হয়। এটি স্বাধীন ভারতের প্রথম বহুমুখী নদী উপত্যকা প্রকল্প। ডিভিসি’র মূল উদ্দেশ্য ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও বনসৃজন। প্রকল্পের আওতায় বসবাসকারী মানুষদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও ছিল লক্ষ্য। 

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের শাসনকালে নদী চুরি হয়ে যাচ্ছে। নদীপাড়ের বাসিন্দারাই জানালেন যে  বিশাল দৈত্যাকার মেশিন ব্যবহার করে প্রতিদিন ব্যাপক পরিমাণ বালি চুরি হচ্ছে। ব্লক ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তর নির্বিকার। অন্ধকার হতেই শয়ে শয়ে ট্রাক্টর ট্রলি, ছয় চাকা, দশ চাকার শতখানেক লরিতে করে পাচার হচ্ছে অবৈধ বালি। চায়ের আড্ডায় ব্যঙ্গ করে মানুষজন বলেন, বালিঘাট থেকে কালিঘাট সবই এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে অবৈধভাবে। প্রশাসন নীরব। অবাধে চলছে ধ্বংসলীলা। 

দামোদরের নদীপাড়ে গেলেই দেখা যাবে বর্যার দিনগুলি ছাড়া অন্য সময় নদী শুকিয়ে কাঠ। নদীর গভীরতা কমছে। সেচখালগুলিতে পর্যাপ্ত জল নেই। কৃষিকাজে ব্যাঘাত ঘটছে। কৃষকরা হা-পিত্যেশ করছেন সেচের জলের জন্য। পানীয়জলের সঙ্কট বাড়ছে পুরো কয়লাঞ্চলে। দামোদরের নিচেও কয়লার স্তর রয়েছে। নদীর মাঝেই অবৈধ খনন করে চলছে কয়লা উত্তোলনের কাজ। নদীর মাঝে বিরাট বিরাট গর্ত তৈরি হচ্ছে। প্রতিদিন দুর্ঘটনা বাড়ছে। 

নদীবক্ষ থেকেই পাম্পের মাধ্যমে কারখানাগুলি মাত্রাতিরিক্ত জল উত্তোলন করছে। জল চুরি হচ্ছে। দামোদর বিপন্ন হওয়ায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে জৈব বৈচিত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব। 

পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ 'রাঢ় বাংলার প্রাণ - দামোদর বাঁচাও' আহ্বান জানিয়ে মানুষকে সচেতন করছে। ২০১৬ সালের কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদের সহযোগিতায় নদীসমূহের প্রবাহমানতা ও দূষণের পরিমাপ করেছে। ১১ টি ড্রেনেজ ও ৩১টি কারখানার বর্জ্য সরাসরি মিশছে দামোদরে। ফলে নদীর জল ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানকর্মীরা দাবি করেন, নদী প্রাকৃতিক সম্পদ।অথচ সরকারের নদী বিষয়ক কোনও মন্ত্রক নেই। নদী বাঁচানোর পরিকল্পনা কারা করবে? ডিভিসি তৈরি হওয়ার পর ১৯৫৬ সালের পর আজ পর্যন্ত দামোদরের পলি উত্তোলন ও নদী সংস্কার হয়নি। 

বামপন্থীরা পরিবেশ এবং জীবিকা বাঁচানোর স্বার্থে দামোদর নদকে রক্ষার দাবি জানাচ্ছে। অবৈধ বালি উত্তোলন রুখতে প্রশাসনের তৎপরতা দাবি উঠছে। দামোদরে দুর্ঘটনায় মৃত্যুমিছিল রোধ করার দাবি উঠছে। এদিকে বিজ্ঞান কর্মীরা মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে জেলাজুড়ে প্রচার চালাচ্ছে। কিন্তু চোরা না শুনে ধর্মের কথা। সুতরাং দামোদরের পাড়ে বালি উত্তোলনের বহর বাড়ছে প্রতিদিন।

Comments :0

Login to leave a comment