মধুসূদন চ্যাটার্জি: বাঁকুড়া,
শনিবার সকালে শালতোড়ার লেদমোড়ে উপস্থিত কমল মণ্ডল। ইনসাফ যাত্রার জন্য অপেক্ষা।
তাঁর জীবন কেমন চলছে? ‘‘ছেলে লেখাপড়া শিখে বসে আছে। কখন ঘর থেকে বের হয় কখন আসে জানি না। বেকারত্বের যন্ত্রণায় ছেলেটা ছটফট করছে, অস্থির, বুঝতে পারি। উদাস হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। আমি কি ছেলেটাকে হারিয়ে ফেলব? কাজ করে বাবার হাতে পয়সা তুলে দিতে চায়, কিন্ত এমনই সরকার রয়েছে আমাদের দেশে রাজ্যে যে এই যুবক, যুবতীগুলোর দিকে একবারের জন্যও ভাবছে না। একটা প্রজন্ম শেষ হয়ে যাবে?’’
কমল মণ্ডলের ছেলের সঙ্গে দেখা হলো না। শালতোড়ার ইনসাফ যাত্রার মিছিলে যন্ত্রণাবিদ্ধ সেই যুবকও ডিওয়াইএফআই’র পতাকা হাতে নিয়ে পদযাত্রায় শামিল হয়েছে। কমল মণ্ডল, ফণীভূষণ মণ্ডল, জয়ন্ত হালদাররা জানান, তাঁদের ছেলেরা জানিয়েছে ঘরে বসে থেকে কি করব? রাস্তায় নামতে হবে। কাজ চাইতে হবে। যতদিন না কাজ দিচ্ছে ততদিন চিৎকার করে বলতেই হবে ‘আমাদের কাজ দাও।’
পাথর ক্রাসার, খাদানের জায়গা শালতোড়া। ২০২১সাল থেকে খাদান, ক্রাসার বন্ধ হয়ে আছে। কেন সরকার বন্ধ করল তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। মুখ্যমন্ত্রী তিনবার বাঁকুড়ায় প্রশাসনিক সভা করতে এসে জানিয়েছিলেন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে হবে। সেই আলোচনা হয়েছে, কোনও ফল হয়েছে? জানেন না মানুষ।
এই কাজের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৫০হাজার মানুষ বিপন্ন। পালিয়ে বেরতে হচ্ছে বহু শিক্ষিত যুবককে। যাঁরা এই ক্রাসার, খাদান করেছিলেন। গ্রামের পর গ্রামের যুবকরা বাইরে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে চলে গেছেন। সেখানে থেকে শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে ঘরে ফিরছেন অনেকে। এখানে এসে দেখছেন কোনও কাজ নেই। তাঁদের অনেকে এদিন শালতোড়ায় ইনসাফ যাত্রার মিছিলে এসেছিলেন। দাবি উঠেছে— সরকারি নিয়ম মেনে ফের শালতোড়ার বুকে পাথর শিল্পের কাজ শুরু হোক। পদযাত্রা এরপর গঙ্গাজলঘাটিতে যায়। সেখানেও অনেকে অপেক্ষা করছিলেন পদযাত্রীদের জন্য। সঙ্কট এখানেও একই রকম। কাজ নেই। রেগার কাজ করা খেতমজুর মজুরি পাননি। ধান যেটুকু হয়েছে তা কাটার পর খেতমজুর কি করবেন? নীরব পঞ্চায়েত। এদিন গঙ্গাজলঘাটি থানা এলাকায় একাধিক মানুষ এই কথা তুলে ধরেন। এলাকার বাসিন্দা সৌকত সিংহ, জগন্নাথ চক্রবর্তীরা জানান, লড়াই ছাড়া আর কোনও পথ আছে? সেই লড়াইটাই শুরু হোক। এদিন গঙ্গাজলঘাটির মানুষ পদযাত্রীদের দুপুরে খাওয়ান। একে একে ভরসার হাতগুলো পদযাত্রীদের সঙ্গে হাত মেলায়। দুপুরে বাঁকুড়া শহরে ঢোকে পদযাত্রা। পাঁচবাঘা মোড় থেকে শুরু হয় এই পদযাত্রা। লালবাজার পর্যন্ত যায়। বাঁকুড়া শহরের প্রতিটি মোড়ে মানুষ পদযাত্রীদের দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাঁরা ইনসাফ যাত্রাকে স্বাগত জানান। বিকালে ইসসাফ যাত্রা বেলিয়াতোড়ে প্রবেশ করে। বেলিয়াতোড় থেকে ডাকবাংলো পর্যন্ত মিছিল হয়। সেখানেও ছিলেন
অনেক মানুষ। সন্ধ্যায় ইনসাফ যাত্রা পৌঁছায় সোনামুখী শহরে। মানুষের ঢল নেমেছিল সোনামুখীতে। হাজারও মানুষ শুনতে চায় পদযাত্রীদের কথা। সোনামুখী শহরে খালি কালো মাথা। কৃষিতে উন্নত সোনামুখী ব্লকের খেতমজুরদের কাজ নেই। যন্ত্রে ধান কাটা হচ্ছে, লাগানো হবে আলুও।
কী করব আমরা? এই উৎকণ্ঠা নিয়েই ইনসাফ যাত্রায় এসেছিলেন সোনামুখীর কামারগোড়ের বাদল দাস, নৈমুদ্দিন শেখরা। খেতমজুরদের বক্তব্য যন্ত্রকে আটকানো যাবে না। কিন্তু সরকার, পঞ্চায়েতকে তো বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের জন্য। সেই লড়াই শুরু হোক। এদিন সোনামুখী বিজে হাইস্কুলে তিলধারণের জায়গা ছিল না। একাধিক মানুষ জানান, এরকম একটা ধারাবাহিক লড়াইয়ের বার্তা প্রয়োজন ছিল। রাতে এই পদযাত্রা পৌঁছায় ঐতিহাসিক শহর বিষ্ণুপুরে। বিকাল থেকেই বিষ্ণুপুরের মানুষ অপেক্ষা করতে থাকেন। রাজ্যে পালাবদলের পর ধারাবাহিক বিষ্ণুপুরের উপর হামলা নামিয়ে আনে তৃণমূলবাহিনী। তার মোকাবিলা করে টিকে থেকে এগিয়ে যাচ্ছে গণতান্ত্রিক আন্দোলন। তারই প্রতিফলন এদিন বিষ্ণুপুরেও দেখা যায়। হাজারও মানুষ শামিল হয়েছিলেন রাতের পদযাত্রায়। বিষ্ণুপুর বাইপাস মোড় থেকে রবীন্দ্র মূর্তি পর্যন্ত মিছিল হয়। পরে সেখানে সভা হয়। এদিন পদযাত্রার বিভিন্ন জনসভায় বক্তব্য রাখেন ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সম্পাদিকা মীনাক্ষী মুখার্জি, সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিমগ্নরাজ ভট্টাচার্য, ধ্রুবজ্যোতি সাহা, ছাত্র নেতা প্রতীক উর রহমান, প্রাক্তন যুব নেতা অমিয় পাত্র, জামির মোল্লা সহ নেতৃবৃন্দ।
Comments :0