Is state ready to fight against adino virus?

ফের প্রকোপ ভাইরাসের, আদৌ কি প্রস্তুত রাজ্য?

ফিচার পাতা

সত্যব্রত ভট্টাচার্য


অ্যাডিনো ভাইরাসের মারাত্মক হানার শিকার শিশু থেকে পূর্ণবয়স্ক মানুষ। সর্দি জ্বর এবং দীর্ঘস্থায়ী কাশির দাপটে জেরবার সকলেই। তবে বড়রা কিছুটা সামলে উঠলেও বেসামাল হয়ে পড়েছে শিশু এবং বয়স্করা। গত ২ মাসে ফুসফুস ও শ্বাসনালীর সংক্রমণ হয়ে ১২ শিশুর মৃত্যু উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে বহুগুণে। শিশু হাসপাতালগুলির আউটডোরের সামনে লম্বা লাইন এবং সেইসব হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটগুলি বুঝিয়ে দিচ্ছে পরস্থিতি কতটা গভীরে চলে গিয়েছে। টান পড়ছে ভেন্টিলেটরে। পাড়ায় পাড়ায় জেনারেল ফিজিশিয়ানদের চেম্বারে দুই বেলা রোগী উপচে পড়ছে। রাস্তাঘাটে বাসে ট্রেনে অনবরত হাঁচি এবং অতিমাত্রায় কাশি জানান দিচ্ছে সহজে এই রোগের হাত থেকে পরিত্রাণ নেই। হাসপাতালগুলিতে এখনও পরিকাঠামোর যথেষ্টই অভাব-ঘুম উড়েছে স্বাস্থ্যভবনেরও।


ওদিকে শহর থেকে জেলা-রাজ্যের প্রতিটি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে কাশি হতে হতে বুকে কাশ-কফ জমে প্রায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত মাঝবয়সি থেকে বয়স্ক মানুষের মানুষের ভিড়ও যথেষ্ট বেড়েছে। সর্দি জ্বর অল্প কয়েকদিন পর কিছুটা কমে গেলেও কমছে না এই কাশির দাপট। বেশিরভাগ সময়েই তা দেড় দু’মাস পর্যন্ত থেকে যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও করোনার বেশ ভালো রকম দাপট ছিল। এরপর ডেঙ্গু, এবং এখন অ্যাডিনো ভাইরাসের হানায় বিপর্যস্ত রাজ্যবাসী। রোগটি নিয়ে এখন টানা গবেষণা চলছে রাজ্যের বিভিন্ন জিনোম সিকোয়েন্স ল্যাবরেটরিগুলিতে। অত্যন্ত ছোঁয়াচে এই রোগ থেকে বাঁচতে আবার মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক করা হোক, পরামর্শ চিকিৎসকদের। 
শীতকালের শেষ থেকে বসন্তকালের সূচনায় প্রতিবছরই সর্দি কাশি জ্বর বা ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ বাড়ে। কিছুদিন পরে তা কমেও যায়। কিন্তু এবছর পরিস্থিতি অন্যরকম। সাধারণ সর্দি কাশি জ্বর বড় আকার নিয়ে নিচ্ছে, শরীরে তা থেকে যাচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে। বিশেষ করে কাশি, গলা ব্যথা। তারপরেই শুরু হয়ে যাচ্ছে শ্বাসকষ্ট। এতে যথেষ্ট কাবু হয়ে পড়ছেন রাজ্যবাসী। মারাত্মকভাবে আক্রান্ত শিশু থেকে বয়স্ক সকলেই। শিশুদের ক্ষেত্রে সংক্রমণের মাত্রা অনেক বেশি, ঘটছে একের পর এক মৃত্যুও। বিভিন্ন স্কুলে  স্কুলে আক্রান্ত ক্ষুদে পড়ুয়াদের মারফত ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগছে না। এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে কোভিডকালের মতোই সতর্ক থাকতে হবে, হাঁচি কাশি ছড়ানো চলবে না, একেবারে আইসোলেশনে না হলেও সবার থেকে একটু তফাতে থাকতে হবে বলে অভিমত চিকিৎসকদের।
গত ১০ দিনের মধ্যেই ২টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে কলকাতায়। তার মধ্যে একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে বিসি রায় শিশু হাসপাতালে, অন্য শিশুটির মৃত্যু ইন্সটিটিউট অব চাইল্ড হেলথে ঘটেছে। গত ২ মাসে এই দুই হাসপাতাল থেকে আরও কয়েকটি শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ভাইরাসঘটিত কারণে। এছাড়া কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও শিশু মৃত্যুর খবর মিলেছে। ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণের কারণে শ্বাসযন্ত্র বিকল হয়েই এই দু’টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। অ্যাডিনো ভাইরাস ডিটেকশনে কিছুটা সময় লাগলেও চিকিৎসকদের বক্তব্য, যেহেতু মিউটেশনের ফলে এখন আগ্রাসী চেহারা নিয়েছে নতুন করে উদয় হওয়া অ্যাডিনো ভাইরাস, সেহেতু বর্তমানে এই রোগের প্রকোপ হিসেবে দায়ী এই ভাইরাসই তাতে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। 


তবে নতুন করে নয়, এই অ্যাডিনো ভাইরাস বহু পুরানো একটি ডিএনএ ভাইরাস। মিউটেশনের ফলে তা এই মারাত্মক রূপ নিয়েছে এমনই মনে করছেন বিজ্ঞানী ও গবেষকরারা। কিন্তু এবছরেই বা কেন এই ভাইরাস এমন আগ্রাসী হয়ে উঠেছে তা নিয়ে ধন্দ্বে রয়েছেন তাঁরা। চিকিৎসকরা বলছেন, দেখা যাচ্ছে  কোভিডের পরে এই ভাইরাস শক্তিশালী হয়ে থাবা বসিয়েছে মানুষের শরীরে। তাহলে কি কোভিড এসে আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিয়েছে যার ফলে এই ভাইরাসের ছোবলকে রুখতে পারছে না আমাদের ইমিউন সিস্টেম? 
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কথায়, গত কয়েক মাস ধরে যে সর্দি কাশি জ্বর চলছে তার ৩২ শতাংশই অ্যাডিনো ভাইরাসের ফলে হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে অন্যান্য আরএসভি জাতীয় ভাইরাসও আছে সংক্রমণ ঘটানোর জন্য। এই অ্যাডিনো ভাইরাসের সংক্রমণে ফুসফুস তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলতে পারে, শ্বাসনালী আক্রান্ত হয়ে নিউমোনিয়া পর্যন্ত হতে পারে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে তা জটিল আকার নিতে পারে। ফলে ভেন্টিলেশনে রাখার প্রয়োজন হয় রোগীকে। শুধু তাই নয়, শ্বাসনালীর উপরিভাগ আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাশি থাকতে দেখা যাচ্ছে রোগীদের। রোগ বাড়াবাড়ি হলে বা কোমর্বিডিটি থাকলে মৃত্যুও ঘটতে পারে। সুতরাং রোগ বাড়াবাড়ি হওয়ার আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। 
রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের যে চিত্র গত কয়েক দিনে মিলেছে তা বেশ উদ্বেগজনক। শিশু হাসপাতালগুলিতে সাধারণ বেড তো বটেই, ভিড়ে উপচে পড়ছে আইসিইউ, নিকু, পিকু ইউনিট। বেশিরভাগই সর্দি কাশি জ্বর ও বুকে সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি। গ্রামীণ হাসপাতালে বহু মানুষ আসছেন দীর্ঘ সময়ে ধরে থাকা কাশি জ্বরের উপসর্গ নিয়ে। সিঙ্গল অ্যান্টিবায়োটিকে কাজ না হলে চিকিৎসকরা অনেক সময়েই ডবল অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্য নিচ্ছেন, কিন্তু তাতেও সমস্যার নিরসন হতে অনেকটাই সময় লাগছে বলে বক্তব্য রোগীদের। বহু ক্ষেত্রে এই রোগ করোনা ভাইরাসের কোনও নতুন ভ্যারিয়েন্ট কিনা, না অ্যাডিনো ভাইরাস থেকে হচ্ছে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। চিকিৎসকদের বক্তব্য, তা নির্ধারণ করতে পারে জিনোম সিকোয়েন্স টেস্টই।
অ্যাডিনো ভাইরাসের এই প্রকোপ বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য ভবনও। ইতিমধ্যে জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্য ভবনে বৈঠক হয়েছে রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিকর্তা থেকে জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক থেকে মেডিক্যাল কলেজের আধিকারিকদের নিয়ে। শিশু হাসপাতাল সহ বিভিন্ন হাসপাতালে ফিভার ক্লিনিক খোলার কথা বলা হয়েছে। কার্যক্ষেত্রে এই ধরণের ক্লিনিকের যথেষ্টই অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ বহু মানুষের। অভিযোগ, অপ্রতুল চিকিৎসক নিয়েও। যদিও চিকিৎসকদের এক বড় অংশের বক্তব্য, কোন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেই প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয় স্বাস্থ্য ভবন থেকে। সাধারণভাবেই তো একটি হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো, চিকিৎসা সরঞ্জাম সর্বক্ষণ যোগান রাখাই স্বাস্থ্য দপ্তরের দায়িত্ব।  

 
সামগ্রিকভাবে চিকিৎসকদের পরামর্শ- ক) রাস্তাঘাটে মাস্ক ব্যবহার করাই এইসময়ে সবচেয়ে সুরক্ষা দিতে পারে। খ)  হাঁচি বা কাশি এলে মুখে কাপড় চাপা দিতে হবে। না হলে দ্রুত ছড়িয়ে যাবে ভাইরাস। গ) যিনি এই ধরণের উপসর্গে আক্রান্ত হবেন তাঁকে একটু তফাতে থাকতে আর ৫ জনের থেকে। ঘ) বেশি করে জল খেতে হবে, বিশেষ করে প্রতিবারই একটু উষ্ণ জল পান করলে ভালো কাজ দেবে। ঙ) নুন জলে গার্গেল করতে হবে রোগের প্রাথমিক অবস্থায়। পারলে একটু  মধু, ভিটামিন সি ইত্যাদি খেলে ভালো, এগুলি রোগ প্রতিরোধে কাজে দেবে। চ) দিনে গরম থাকলেও রাতের দিকে অনেক সময়ে একটু ঠান্ডা হাওয়া চলাচল করে, সেই সময়ে ঠান্ডা লাগানো মোটেই চলবে না। ছ) বালিশ, চাদর, রুমাল এগুলি মাঝেমাঝেই কেচে ফেলতে হবে। রাস্তা ঘাটে হাত সাবান দিয়ে না ধুইয়ে বা স্যানিটাইজার ব্যবহার না করে  চোখে মুখে দেওয়া যাবে না।  বাইরে থেকে ঘুরে এসে আগে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। জ) দোকান থেকে কিনে মুড়ি মুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খেলে বিপদ বাড়বে, সুতরাং তা করা যাবে না। ঝ) বেশ কয়েকদিন ধরে কাশি থাকলে অথবা স্বাসকষ্ট হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে।
 

Comments :0

Login to leave a comment