CBI ABHISHEK

টাকা হাতে দিলে অভিষেক ব্যানার্জি যা বলবো মেনে নেবে

রাজ্য

- ঘরের মধ্যে কালীঘাটের কাকু কথায় তখন হইহই করে হেসে উঠলো কুন্তল ঘোষ, শান্তনু ব্যানার্জিরা। 
কেন? কী সেই কথা যা নিয়োগ দুর্নীতির কৌশল ঠিক করতে বসায় এমন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাতেও হেসে উঠতে হলো তাদের? 
কারণ তার কিছুক্ষণ আগেই কালীঘাটের কাকু তাঁর ‘সাহেব’ অভিষেক ব্যানার্জির প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘টাকা হাতে দিলে অভিষেক ব্যানার্জি, যা বলবো পৃথিবীর (সব) মেনে নেবে’!এটাই শুনেই সেই কথোপকথনে হেসে উঠল শান্তনু, কুন্তলরা।
যারা ততক্ষণে প্রাথমিকে নিয়োগপত্র পেয়ে গেছেন তাঁদের কাছ থেকেও টাকা চাই! টাকা না দিলে মামলা করে নিয়োগ আটকে দেওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন কালীঘাটের কাকুর ‘সাহেব’ অভিষেক ব্যানার্জি। 
নিজের বাড়িতে বসে তৎকালীন তৃণমূলের যুবনেতা কুন্তল ঘোষ, শান্তনু ব্যানার্জিদের সঙ্গে প্রায় ৭৩ মিনিটের কথোপকথনে সেই প্রসঙ্গও উঠে আসে। শুধু তাই নয়, এই ‘ঝামেলা, ক্যাওস’ আটকাতে প্রয়োজনে অভিষেক ব্যানার্জিকে ১৫ কোটি ছাড়াও আরও একটু বেশি টাকা দেওয়া নিয়েও আলোচনা হয়। কারণ কালীঘাটের কাকুর কথায় ‘টাকা হাতে দিলে অভিষেক ব্যানার্জি, আমরা যা বলবো পৃথিবীর সবাই মেনে নেবে’।
২০১৭ সালে বেহালায় নিজের বাড়িতে বসে সান্টুদা ওরফে কালীঘাটের কাকু ওরফে সুজয় কৃষ্ণ ভদ্রের একের পর এক এমন সব বিস্ফোরক দাবি, আলোচনার নথি কেন্দ্রীয় সংস্থার হাত ঘুরে আদালতে জমা পড়েছে। গত ২১ তারিখে প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতির চার্জশিটেই সেই কথোপকথনের রেকর্ডিংয়ের লিখিত অনুবাদ যুক্ত করে আদালতে জমা দিয়েছিল সিবিআই। তাতে কালীঘাটের কাকুর বাড়িতে নিয়োগ কাণ্ডে ধৃত শান্তনু ব্যানার্জি, কুন্তল ঘোষ, কুন্তলের ব্যবসার কর্মী অরবিন্দ রায় বর্মণ এবং সুরজিৎ চন্দ। সেই মিটিংয়ের কথোপকথনে মোবাইলে রেকর্ড করেছিল অরবিন্দ রায় বর্মণ। তদন্তে সিবিআই’র হাতে আসে তা।
সেখানে কার্যত প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, এসএসসি নিয়োগ প্রক্রিয়াকে খোলা বাজারের ব্যবসায় কীভাবে পরিণত করা হয়েছিল তার ভয়াবহ চেহারা গোটা কথোপকথনের ছত্রে ছত্রে। কীভাবে হাইকোর্টে মামলা করে নিয়োপ প্রক্রিয়া আটকে দেওয়া যায়, কীভাবে ‘ফ্রেশ’ নিয়োগপ্রার্থীরা কয়েকজন চাকরি পেয়ে গেলে আগাম দিয়ে রাখা অযোগ্য প্রার্থীদের ঢোকানোর জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল, কীভাবে অতিরিক্তি টাকা তোলার জন্য যাদের অবৈধভাবেও চাকরি পাইয়ে দেওয়া যাবেনা তাদের কাছ থেকেও টাকা তোলা হয়েছিল এসবের এমন খোলাখুলি আলোচনার যে নথি আদালতে জমা পড়েছে তাতে স্পষ্ট- ২০১২ ’র প্রাইমারি টেট থেকেই পশ্চিমবঙ্গে কার্যত কোনও নিয়োগ প্রক্রিয়া দুর্নীতি ছাড়া যেমন হয়নি তেমনি শাসক দলের নেতা,বাহিনীর একটা বড় অংশকে একেবারে শীর্ষমহলের মদতেই এই দুর্নীতি চক্রে এজেন্ট হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। শাসক দল-সরকার- প্রশাসনের যৌথ দুর্নীতির এক শিউরে ওঠা ছবি। 
একইসঙ্গে এই বিস্ফোরক কথোপকথনেই স্পষ্ট স্বাধীনতার পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের বুকে সবথেকে বড় এই নিয়োগ দুর্নীতির গোড়া থেকে আগা, প্রথম থেকে শেষ সবটাই জানতেন কালীঘাটের কাকুর ‘সাহেব’ অভিষেক ব্যানার্জি। সবটাই জানতো দলের এবং সরকারের শীর্ষ মহল, শুধু জানাই নয় সম্পূর্ণ দলীয় পৃষ্ঠপোকতায় এই দুর্নীতির জাল ছড়ানো হয়েছিল।  
সেই বিস্তারিত কথোপকথনের আরো খানিকটা অংশ এখানে তুলে দেওয়া হলো: 
সুজয়(কালীঘাটের কাকু): তোমায় গুরু ২০কোটি টাকা পৌছে দেবো, এটা মানিক বলবে। পার্থ চ্যাটার্জি চুপ হয়ে যাবে। পার্থ চ্যাটার্জি বলবেনা অভিষেকই ঐ, বলবে সেটা আমার দায়িত্ব, সেটায় তোমায় ভাবতে হবে না, তুমি শুধু অভিষেক ব্যানার্জিকে কিছু বলবে না। অভিষেক ব্যানার্জি যদি কিছু বলে তুমি আমার নামে দোষ দিয়ে দেবে। এবার অভিষেককে আমি সামলে নেবো। আমি অভিষেকের সঙ্গে সরাসরি আগেই কথা বলে নেবো , যে সাহেব এই এই ব্যাপার...এরা তো সব টাকা দিয়েছ, আবার টাকা দেবে, ফলে সেইটা মুশকিল, সেই টাকা টাকা ম্যানেজ করছে। কিছু এক্সট্রা করে তোমাকে এইটা দিয়ে  দেবে, তোমাকে আরো ৫ বেশি দেবে, ১০ বেশি দেবে (আগের বলা ১৫কোটি ছাড়াও আরো ৫ কোটি বেশির কথাই এখানে বোঝানো হয়েছে)। কারণ এই টাকাগুলো চলে গেছে, আর বেরোবে না গুরু! সব সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টের ল’ইয়ার ফ’ইয়ার খেয়ে নিয়েছে। পার্থ দা খেয়েছে সেটা তোমার কাছে স্বীকার করবে না। এখন এই টাকাটা আনতে গেলে এক দেড়শো লোক বেশি নিতে হবে। এটা অভিষেককে আমি খাইয়ে দিলাম। টাকা হাতে দিলে অভিষেক ব্যানার্জি আমার যা বলবো পৃথিবীর মেনে নেবে (শান্তনু ও কুন্তল ঘোষের হাসির শব্দ)। মানে ওর নামটা তো কোথাও আসছে না ফলে ওর কোনও প্রবলেম নেই...।
তার আগে এই কথোপকথনের লিখিত অংশের ১৫ নম্বর পাতায় অভিষেক ব্যানার্জি কীভাবে নিয়োগ হওয়ার পরেও চাকরি আটকে দিতে চাইছে সে কথা উল্লেখ করে কালীঘাটের কাকু শান্তনু ও কুন্তলদের কাছে টাকার পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলে।
সুজয়: আমি আটকাচ্ছি, টাকা দিলে সব ছেড়ে দেবো- অভিষেক আমায় বলল আমি আটকাচ্ছি, টাকা দিলে ছেড়ে দেবো। আমি বললাম সাহেব দু’বার টাকা এরা কোথা থেকে দেবে? সাড়ে ছয় লক্ষ টাকা করে দিয়েছে। বললো তাহলে হবে না। আমি বললাম কোর্ট অর্ডার আছে সাহেব। তুমি আটকাতে ফাইনালি পারবে না। কনটেম্পট ওফ কোর্টে পড়ে যাবে শিক্ষা দপ্তর। বলছে তখন? হুগলীর লোককে উত্তর দিনাজপুরে পাঠাবো, উত্তর দিনাজপুরের লোককে দক্ষিণ ২৪পরগনাটয় পাঠাবো।
শান্তনু: তাতে কী হবে, সরকারি চাকরি করবে...
সুজয়: আরে কথার কথা বলছি যে আমার সঙ্গে কথা হলো, আমি তোমাকে সেটা জানালাম।
শান্তনু: ক্যান্ডিডেটগুলোকে যেদিন বারণ করবে তার পর দিন কোর্টে চলে যাবে।এই অ্যাপয়নমেন্ট লেটার নিয়ে চলে যাবে, পরিষ্কার হিসাব। ওরা কী বসে থাকবে নাকি? কারণ সবাই তো দেখুন, কেউ তো ফ্রেশ নয়, সবাই তো পয়সা দিয়ে চাকরি পেয়েছে।
সুজয়: আমি তো অভিষেককে বললাম যে কনটেম্পট হবে...
শান্তনু: আমি আপনাকে বলধি আপনার কতগুলো ক্যান্ডিডেট আছে, টোটাল বলুন ট্রেইনড, নন ট্রেইনড মিলিয়ে কতগুলো আছে।
সুজয়: আমার তিনশো আছো।
শান্তনু: না দু’হাজার লিস্ট দিলে তো দু’হাজার ক্যান্ডিডেট লাগবে তো!
সুজয়: ক্যান্ডিডেট আমি সব দিয়ে দেবো...
কত অযোগ্য প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা তুলবে তা নিয়ে আলোচনার আরও খানিকটা পরে কালীঘাটের কাকু ফের তোলে অভিষেকের কথা।
সুজয়: আমাকে বললে, আমি অভিষেককে বলবো, তুমি এই ব্যাপারের মধ্যে ইন্টারফেয়ার করো না। ছেড়ে দিতে বলো, এই নাও তোমার ১৫ কোটি, কিন্তু আমাকে সেই অ্যাসুরেন্স দিতে হবে তো...অভিষেক তো ১৫ কোটি পেলেই খুশি, কিন্তু আরও ১০কোটি এক্সট্রা দেবে, যেটা সাহেবকে দিয়ে বলবো, তাহলে একটু বেশি করিয়ে নিচ্ছি সাহেব। বুঝেছ? কোর্টের জাজমেন্ট আছে তো। ৫-৭টা বেশি করিয়ে নিচ্ছি। ২৫ কোটি হাতে দিয়ে দেবো, জীবনে একটা কথা বলবে না। এবার আমি কী করবো? এই নাও সাহেব ৫কোটি। তুমি সব ছাড়তে বলো, আমার দায়িত্ব, তোমায় কথা দিলাম।

 

Comments :0

Login to leave a comment