Bengal story missing women

রাজ্যে ৫ বছরে দেড় লক্ষ মহিলা নিখোঁজ, ১ হাজার পাচার

জাতীয় কলকাতা

পাঁচ বছরে দেড় লক্ষ মহিলা নিখোঁজ হয়েছেন। আর পাচারের অভিযোগ দায়ের হয়েছে প্রায় ১ হাজার মহিলার ক্ষেত্রে। তাঁদের মধ্যে নাবালিকাই বেশি।
এটাই ‘বেঙ্গল স্টোরি।’ 
কেরালায় সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন সরকার সম্পর্কে দেশের মানুষকে ভুল বোঝাতে, কমিউনিস্টদের কোণঠাসা করতে ‘কেরালা স্টোরি’ নামের চলচ্চিত্রকে কাজে লাগাতে নেমেছে আরএসএস, বিজেপি। কেরালায় এই নিখোঁজ মহিলারা হিন্দু নয়তো খ্রিস্টান এবং তাঁদের ফুঁসলিয়ে নিয়ে যায় মুসলিমরা — প্রচারের মূল লক্ষ্য এটিও। সেক্ষেত্রে ধর্মীয় বিভাজন এবং মুসলিমদের সম্পর্কে ঘৃণা তৈরি এই চক্রান্তের অংশ। 
এই চলচ্চিত্রকে কর্ণাটকে নির্বাচনী প্রচারে হাতিয়ার করার চেষ্টা করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। 
ইতিমধ্যে গুজরাটে গত পাঁচ বছরে কত মহিলা নিখোঁজ হয়েছেন সেই তথ্যও সামনে এসে পড়েছে। বিভিন্ন সংগঠন তা সামনে এনেছে। 
এই সুযোগে তৃণমূলও ‘কেরালা স্টোরি’ নিয়ে সঙ্কীর্ণ রাজনীতিতে নেমেছে। ‘কেরালা স্টোরি’কে রাজ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সঙ্ঘের বিভাজনের রাজনীতিকেই অন্য দিক থেকে ব্যবহারের চেষ্টা শুরু করেছেন মমতা ব্যানার্জি। দেখাতে চাইছেন তিনি প্রবল বিজেপি-বিরোধী, সংখ্যালঘু-প্রেমী।
কিন্তু নারীদের নিখোঁজ হওয়া, নারী পাচারের প্রশ্নের সঙ্গে ধর্মীয় পরিচিতি সত্তাকে জড়িয়ে দিয়ে বিজেপি মূল প্রশ্নটিকেই আড়াল করার চেষ্টা করেছে। যা মূলত অর্থনৈতিক— কাজের অভাব, দারিদ্র। তৃণমূলও এই সুযোগে তা লুকিয়ে ফেলতে চাইছে। 
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নিখোঁজ মহিলাদের ধর্মের ভিত্তিতে চিহ্নিত করা যাবে না। রাজ্যে কী শুধু হিন্দু মহিলা নিখোঁজ হচ্ছেন? কিংবা শুধু মুসলিম মহিলারা? সিআইডি-র তথ্য অনুসারে চলতি বছরের প্রথম দু’ মাসে সিআইডি-র কাছে ১২৯জন মহিলার নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ জমা পড়েছে। তাঁদের মধ্যে ২৫জন সংখ্যালঘু মুসলিম পরিবারের। নিখোঁজ মহিলাদের মধ্যে তরুণীরাই সিংহভাগ। তাঁদের মধ্যে অবাঙালিও আছেন। 
সিংহভাগ নিখোঁজ মহিলা গ্রামবাসী এবং তাঁরা গরিব, মধ্যবিত্ত পরিবারের। পুলিশের রিপোর্টেই তা স্পষ্ট। 
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো(এনসিআরবি)-র রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০১৭ থেকে ২০২১ — এই পাঁচ বছরে রাজ্যের ১লক্ষ ৪৮হাজার ৭৭৬জন মহিলা নিখোঁজ হয়েছেন। ২০২২-র রিপোর্ট চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বেরোবে। ফলে গত বছরে কতজন নিখোঁজ হয়েছেন, তা উল্লেখ করা যাচ্ছে না। কিন্তু এনসিআরবি-তে রিপোর্ট পাঠায় রাজ্য সরকারই। রাজ্য সরকারের দেওয়া সেই রিপোর্ট অনুসারে ২০১৭-তে ২৮,১৩৩জন, ২০১৮-তে ৩১,২৯৯জন, ২০১৯এও ৩১,২৯৯জন, ২০২০-তে ২৭,৪৩৪জন এবং ২০২১-এ ৩০,৬১১জন মহিলা নিখোঁজ হয়েছেন রাজ্যে। রাজ্যের ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর এক আধিকারিক জানিয়েছেন,‘‘২০১৬-তে ২৪,৯৩৭জন মহিলার নিখোঁজ হওয়ার রিপোর্ট ছিল। ২০১৯-র ৩জুনে এনসিআরবি নিখোঁজদের সংক্রান্ত বিষয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। তা মূলত ব্যাখ্যামূলক। সেই সময় এনসিআরবি-র ডিরেক্টর ছিল রামফল পাওয়ার। যেহেতু তিনি পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, তাই সেই রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ছিল। তবে সেই রিপোর্টে ২০১৬ থেকে ২০১৮, এই তিন বছরের তথ্য, ব্যাখ্যা আছে।’’
রামফল পাওয়ার ডিরেক্টর থাকাকালীন নিখোঁজ মহিলা সংক্রান্ত সেই রিপোর্টে ২০১৮-র তথ্যের ভিত্তিতে মহিলা নিখোঁজের ক্ষেত্রে কলকাতা শহরকেই সবচেয়ে আশঙ্কাজনক বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তারপর যথাক্রমে নদীয়া, বারাসত, বারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট, মুর্শিদাবাদ, ডায়মন্ডহারবার, পশ্চিম মেদিনীপুর, বারুইপুর জেলা, কোচবিহার এবং হাওড়া গ্রামীণ পুলিশ জেলাকে আশঙ্কাজনক বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
রাজ্য পুলিশের এক আধিকারিকের কথায়,‘‘নিখোঁজ মানেই পাচার নয়। কেউ ইচ্ছা করে নিখোঁজ হতে পারেন। কারো মানসিক স্থিতি ঠিক না থাকলেও নিখোঁজ হতে পারেন। আবার অনেক সময়েই পাচারের জন্য নিখোঁজ কিনা, তা বোঝা যায় না বলে নিখোঁজ অর্থাৎ মিসিং ডায়েরি হয়। এখন নিখোঁজ নিয়েই বিতর্ক চলছে।’’ 
নারী পাচারের ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে সামনের দিকে থাকা রাজ্য। ২০১৭ থেকে ২০২১ — এই পাঁচ বছরে রাজ্যে ৯৯২জন মহিলাকে পাচারের কেস থানায় রুজু হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে নাবালিকাই ছিলেন বেশি — ৬৮৩জন। রাজ্য পুলিশ সূত্রে জানা যাচ্ছে, রাজ্যের থানাগুলিতে ২০১৭-তে ৩৬৫জন, ২০১৮-তে ২৪৪জন, ২০১৯-এও ২৪৪জন, ২০২০-তে ৬১জন এবং ২০২১-এ ৭৮জন মহিলাকে পাচারের অভিযোগ দায়ের হয়েছে। লক্ষ্যনীয় হল — ২০২০ থেকে পাচারের কেস থানাগুলিতে রুজু হওয়া কমে গেছে। তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে কৃষক আত্মহত্যার তথ্য না দেওয়ার অভিযোগ আছে। রাজ্যের কোনও কৃষক কোনও কারণে আত্মহত্যা করেন না— এমনই রিপোর্ট নবান্ন গত কয়েকবছর এনসিআরবি-তে পাঠিয়েছে। তা নিয়ে সিপিআই(এম) একাধিকবার সোচ্চার হয়েছে। নারী পাচারের অভিযোগ নেওয়াও রাজ্যের থানাগুলিতে কমিয়ে আনা হয়েছে — এনসিআরবি-র রিপোর্টেই নজর রাখলে তাই বোঝা যায়।  
বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নাবালিকাকে সোনাগাছিতে বিক্রির ঘটনা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেই দেখা গেছে। ওই নাবালিকাও গরিব পরিবারের। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঢোলাঘাটের নাবালিকাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে গিয়ে ৪০ হাজার টাকায় এক যুবক বিক্রি করে দেয়। এই ঘটনায় চারজন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের মধ্যে ১জন মহিলাও। মূল অভিযুক্তর বাড়ি সুন্দরবনের পাথপ্রতিমায়। আবার এই রাজ্যেই কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিল্লি নিয়ে গিয়ে বিক্রি করার ঘটনাও অনেকগুলিই পুলিশ পেয়েছে। শুধু দিল্লি নয়, ব্যাঙ্গালোর, হায়দরাবাদ, জয়পুরের মত অনেক এলাকাতেই কাজের লোভ দেখিয়ে মহিলাদের নিয়ে গিয়ে বিক্রির ঘটনা পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে।  
 

Comments :0

Login to leave a comment