বিজেপি উধাও হয়ে গেল। কেন্দ্রীয় বাহিনী আর রাজ্য পুলিশের মধ্যে তফাৎ মিলিয়ে গেল। নির্বাচনের সপ্তম দফায় মরিয়া তৃণমূল বুথ দখল করে দেদার ছাপ্পা ভোট করল। তবু কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের নির্বাচনের শেষ দিনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়ে গেলেন বামফ্রন্ট কর্মীরা এবং কিছু জায়গায় গ্রামবাসীরা। আক্রান্ত, রক্তাক্ত হলেন তাঁরা।
সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন,‘‘তৃণমূল যা করেছে বিজেপি’র কোলে বসে করেছে। তাই নির্বাচন কমিশন চুপ করে থেকেছে। তা সত্বেও সন্ত্রাসের মুখে লড়েছেন পার্টিকর্মীরা।’’ তবে নির্বাচন কমিশন এবং আধা সামরিক বাহিনীর প্রায় ধ্যানমগ্নের ভূমিকায় খুশি মমতা ব্যানার্জির দল। তাই তৃণমূলের পক্ষ থেকে ব্রাত্য বসু এদিন বলেছেন, ‘‘আগামী ৪ জুন আমরা সবুজ আবির খেলব।’’
‘আবির খেলা’র এই ইচ্ছার অনুপ্রেরণা হতে পারে ক্যানিং পূর্ব, রাজ্যের একটি বিধানসভা কেন্দ্র। তৃণমূলের নেতা সওকত মোল্লা সেখানকার বিধায়ক। জয়নগর লোকসভা কেন্দ্রের এই বিধানসভার ২৭২টি বুথের একটিতেও সিপিআই(এম)’র এজেন্টদের বসতে দেয়নি তৃণমূল। যতবার পার্টিকর্মীরা চেষ্টা করেছেন, তৃণমূল তাঁদের মেরে, ভয় দেখিয়ে বুথ থেকে বের করে দিয়েছে। এদিনই ক্যানিংয়ে ভোট দিতে গিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকরা তৃণমূলের হামলার শিকার হন। তাঁদের বেশ কয়েকজন রক্তাক্ত হয়েছেন।
শনিবার রাজ্যের ৯টি লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচন ছিল। ছিল বরানগর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনও। বসিরহাট, বারাসত, দমদম, কলকাতা উত্তর, কলকাতা দক্ষিণ, যাদবপুর, ডায়মন্ড হারবার, মথুরাপুর এবং জয়নগর— এই কেন্দ্রগুলিতে গড়ে ভোট পড়েছে ৭১ শতাংশ। তবে এই হিসাব সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত। সাংবাদিক সম্মেলনে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক আরিজ আফতাব এই তথ্য জানিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন,‘‘দু’ একটি ছোটখাটো ঘটনা ছাড়া সপ্তম দফার ভোট শান্তিতে হয়েছে। সকলকে অভিনন্দন।’’
তবে আফতাবই জানিয়েছেন, ‘শান্তি’র এই ভোটে ৪০ জন আহত হয়েছেন। তার মধ্যে ৪ জন পুলিশ কর্মী। পুলিশ কর্মীর আহত হওয়ার দাবি সন্দেশখালিতে। সেখানে এদিন পুলিশকে দেখা গেছে গ্রামবাসীদের দিকে ঢিল ছুঁড়তে। সেই ঘটনা সন্দেশখালির। কুলতলিতে আধা সামরিক বাহিনীর মারে মারাত্মক জখম হয়েছেন এক সাংবাদিক বান্টি মুখার্জি। তাঁকে কলকাতার হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
এমন ‘ছোটখাটো’ ঘটনার মধ্যে অবশ্যই বড়ো প্রসঙ্গ ডায়মন্ড হারবার। তৃণমূলের প্রার্থী এখানে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জি। দিনের শেষে এই কেন্দ্রের সিপিআই(এম) প্রার্থী প্রতীক উর রহমান বলেছেন,‘‘এটা ভোট হয়নি। ডায়মন্ডহারবার জুড়ে ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে। তৃণমূলের ভাড়া করা লোক এনে উৎসবের মেজাজে ছাপ্পা ভোট করিয়েছে। আর তা হয়েছে বিজেপি’র সঙ্গে হাত মিলিয়ে।’’ প্রতীক উর রহমানের পক্ষ থেকে ৩৮৮টি অভিযোগ জানানো হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। ডায়মন্ড হারবারে ভোট কেমন হয়েছে অভিযোগের এই সংখ্যা তার একটি উদাহরণ।
ডায়মন্ড হারবারের বিষ্ণুপুর, সাতগাছিয়া, ফলতার বিস্তীর্ণ এলাকায়, ডায়মন্ড হারবারের একাংশ, মহেশতলা, বজবজের বেশ কিছু জায়গায় দেদার ছাপ্পা ভোট দিয়েছে তৃণমূল। অনেক জায়গায় সিপিআই(এম)’র এজেন্টদের মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে, মেরেধরে বুথ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। একটি বুথে সিপিআই(এম)’র এজেন্ট হিসাবে বসে ছিল এক তৃণমূল কর্মী। প্রতীক উর রহমান তাকে বুথ থেকে বের করেন। সেই ভুয়ো এজেন্ট ছুটে পালায়।
যাদবপুরেরও কিছু জায়গায় তৃণমূল ছাপ্পা দিয়েছে। এই কেন্দ্রের সিপিআই(এম) প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্য বলেছেন,‘‘তৃণমূল ভোট লুট করেছে। বারুইপুর পূর্ব, বারুইপুর পশ্চিম, ভাঙড়, যাদবপুরে ভোট লুটের চেষ্টা করেছে তৃণমূল।’’ যাদবপুরের ১০১ নং ওয়ার্ডের একটি বুথে তৃণমূলের আক্রমণে মারাত্মক জখম হয়েছেন সিপিআই(এম)’র এক বুথ এজেন্ট। ১০৯নং ওয়ার্ডে অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে দুষ্কৃতীরা যাতায়াত করেছে। ওই ওয়ার্ডের শহীদ স্মৃতি কলোনি সহ কয়েকটি জায়গায় দেদার ছাপ্পা ভোট দিয়েছে তৃণমূল।
সবই ঘটেছে আধা সামরিক বাহিনীর সামনে। তারা চুপচাপ পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কী করে ভোট করে, তা দেখে গেছে। রাজ্য পুলিশের কনস্টেবল বুথে দাঁড়িয়ে তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার প্রচার করেছেন। সোনারপুরে এমন ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন নাগরিকরা। নির্বাচন কমিশনের আধিকারিকরা বাধ্য হয়েছেন অরুণকুমার পাল নামের সেই পুলিশ কর্মীকে বুথ থেকে সরিয়ে দিতে। ভোট লুট হয়েছে যাদবপুর লোকসভার অন্তর্গত ভাঙড়েও— বিশেষত ১নং ব্লকে। সেখানে ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক সওকত মোল্লার নেতৃত্বে বুথ দখল করে ‘ভোট করেছে’ তৃণমূল।
তৃণমূল তুলনামূলক চুপচাপ থেকেছে মথুরাপুর এবং বারাসত লোকসভা কেন্দ্রে। কলকাতা উত্তর কেন্দ্রের অল্প কিছু জায়গায় দলত্যাগী বিজেপি প্রার্থীকে বাধা দিয়েছে তৃণমূলীরা। কলকাতা দক্ষিণ কেন্দ্রে সেই তৃণমূল বেশ কিছু জায়গায় মরিয়া ছিল জাল ভোট দেওয়ার জন্য। বালিগঞ্জ বিধানসভার একটি বুথে সিপিআই(এম)’র এজেন্ট রোশেনারা মিশ্রকে ন্যক্কারজনক ভাবে হেনস্তা করে তৃণমূলীরা। সেই বুথে ছুটে যান সিপিআই(এম) প্রার্থী শায়রা শাহ হালিম। তিনি এদিন আরও অনেকগুলি বুথে যান। কয়েকটি জায়গায় তিনি তৃণমূলীদের বুথ দখলের চেষ্টা আটকান। দমদমেও সকাল থেকেই তৃণমূলীদের বিভিন্ন ধরনের অপচেষ্টা রুখতে ছুটে বেরিয়েছেন সিপিআই(এম) প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী। বসিরাহাটেরও বিস্তীর্ণ এলাকায় বুথ রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন বামফ্রন্ট কর্মীরা।
Comments :0