স্বীকার করলেন রাজ্যের গোয়েন্দা ব্যর্থতা। মেনে নিলেন এরাজ্যে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের ঘটনাকে। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণভাবে এরাজ্যে পড়শি দেশ থেকে উগ্রপন্থী ঢুকিয়ে হামলার পরিকল্পনাকে ‘কেন্দ্রীয় সরকারের নীল নকশা’ বলে মন্তব্য করেছেন মমতা ব্যানার্জি।
সঙ্ঘ পরিবারের মতোই মমতা ব্যানার্জি সচেতনভাবেই সীমান্তের সমস্যাকে টেনে আনলেন রাজ্যের অভ্যন্তরে। পড়শি দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনাকে যেভাবে এরাজ্যে মেরুকরণের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে আরএসএস-বিজেপি, কার্যত সেই পথেই এদিন রাজ্য প্রশাসনের পর্যালোচনা বৈঠক থেকে উসকানি দিয়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী। অনুপ্রবেশ ইস্যুতে এরাজ্যের রাজনীতিতে নতুন করে জিগির তৈরি করলেন মমতা ব্যানার্জি।
এরাজ্যের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত আছে বাংলাদেশের। ওই দেশের সাম্প্রতিক সময়ে তদারকি সরকারের আমলে সংখ্যালঘু হিন্দু নিপীড়নের ঘটনার পর থেকে তীব্র প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ঘটনাকে সামনে রেখে মেরুকরণের রাজনীতি করতে আসরে নামে সঙ্ঘ পরিবার। তাদের হাত ধরেই শুরু হয়েছে তীব্র বাংলাদেশ বিদ্বেষী প্রচার। একইভাবে পড়শি দেশেও জামাতের মদতে চলছে ভারত বিদ্বেষী প্রচার। বিজেপি’র এই প্রচারকে কার্যত উৎসাহ দিতে গিয়ে এদিন মুখ্যমন্ত্রী কী বললেন?
রাজ্য প্রশাসনের সদর দপ্তর থেকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘এখানে (এরাজ্যে) গুন্ডা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বর্ডার দিয়ে ঢুকে খুন করে চলে যাচ্ছে। এটা বিএসএফ’র ভিতরকার কাজ। এরমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের একটা ব্লু প্রিন্ট আছে। না হলে এটা হতে পারে না। আমাদের রাজ্যকে ডিস্ট্রার্ব করার জন্য জঙ্গী হামলাকে মদত দেওয়া মেনে নেওয়া হবে না।’’ রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমারকে মুখ্যমন্ত্রী তথ্য জোগাড় করার নির্দেশ দিয়েছেন। যার ভিত্তিতে মমতা ব্যানার্জি কেন্দ্রীয় সরকারকে কড়া চিঠি লিখবেন বলে এদিন বৈঠক থেকে জানিয়েও দিয়েছেন। নিশ্চিতভাবেই সেই চিঠি মমতা ব্যানার্জি প্রধানমন্ত্রীকেই লিখতে চলেছেন। অথচ রাজ্যে গত লোকসভা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী বারে বারে প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন, এরাজ্য কীভাবে অনুপ্রবেশকারীরা এসে রাজ্যের মানচিত্র বদলে দিচ্ছে। সংখ্যালঘুদের ‘ঘুষপেটিয়া’ বলে গত লোকসভা নির্বাচনে এরাজ্যে প্রচারে এসে একাধিক সভায় মোদী বলেছিলেন, ‘‘এই যে বাংলাদেশ থেকে ঘুষপেটিয়া ঢুকছে। এরা কাদের জমি কবজা করছে? আমাদের দলিত, আদিবাসী ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের জমি দখল করছে।’’ ফলে ফের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়ার অর্থই হলো, বিভাজনের রাজনীতির এই ইস্যুকে আগামী বিধানসভা ভোট পর্যন্ত কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই সচেতনভাবে জিইয়ে রাখতে চাইছে।
মুখ্যমন্ত্রীর এহেন মন্তব্যের পরেই প্রতিক্রিয়া চলে এসেছে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কাছ থেকে। নবান্নের প্রতিক্রিয়া শুনে নন্দীগ্রামে সাংবাদিকদের বিরোধী দলনেতা বলেছেন, ‘‘রাজ্যটা পুরোপরিভাবে জঙ্গীদের হাতে চলে গেছে। বাংলাদেশের ঘটনা ওপার বাংলা আর এপার বাংলার হিন্দুদের বাঁচার লড়াই।’’ ফলে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য বাংলাদেশের ঘটনার পর অনুপ্রবেশ ইস্যুতে নতুন করে মেরুকরণের রাজনীতি বাড়বে। আসলে সীমান্তের সমস্যাকে রাজ্যের অভ্যন্তরে নিয়ে এসে বিভাজনের রাজনীতিকে আরও শক্তপোক্ত করতে তৎপর বিজেপি ও তৃণমূল।
ইসলামপুর, সিতাই, চোপড়া এলাকা দিয়ে বিএসএফ এরাজ্যে অনুপ্রবেশ করাচ্ছে বলে বৃহস্পতিবার নবান্নে রাজ্য প্রশাসনের বৈঠকে মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। আরও বেশ কিছু এলাকার খবর তাঁর নজরে আছে বলেও জানিয়েছেন। আর বিএসএফ’কে মদত দিচ্ছে রাজ্য পুলিশের একাংশ। রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকার জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারদের উদ্দেশ্য করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বিএসএফ’এর সঙ্গে সমঝোতা করে আপনারা (পুলিশ সুপার) অনুপ্রবেশকারীদের ঢোকাচ্ছেন। কেউ প্রতিবাদ করছেন না। পুলিশের কাছে জেলার কোনও খবর থাকে না।’’ বৈঠক থেকেই মুখ্যসচিব মনোজ পন্থকে লক্ষ্য করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “মনোজ, পেয়েছো?’’ মুখ্যসচিবের উত্তর শুনে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘পাওনি। ডিআইবি, এসপি, ওসি এরা তাদের দায়িত্ব পালন করেনি।’’
রাজ্যের পুলিশ দপ্তর মুখ্যমন্ত্রীর নিজের হাতে। অথচ তাঁর দপ্তরের হাতে থাকা পুলিশ বিএসএফ’র সঙ্গে সমঝোতা করছে। এমনকি রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষস্তরে সেই খবর আসছে না। একইসঙ্গে রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা ব্যার্থতাও উঠে এসেছে। ডিজি রাজীব কুমারকে উদ্দেশ্য করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘আইবি-কে (ইনটেলিজান্স ব্রাঞ্চ) নিয়ে রাজীব তোমাকে একটা কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে। ডিআইবি একটা খবর রাখে না। একটা ইনফর্মেশন তারা দেয় না। পদটাকে নিয়ে তারা খেলা করছে। এগুলো সব চেঞ্জ করে দাও।’’
এরাজ্যে আইনশৃঙ্খলার কোনও অবনতির ঘটনা ঘটলেই মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশ মন্ত্রীকে নিজের দায়ভার ঝেড়ে সব প্রশাসনিক দায় পুলিশের ওপর চাপিয়ে দিতে বারে বারে দেখা গিয়েছে। এদিনই যেমন মালদহে দলের তাঁর পরিচিত নেতা খুনের পর পুলিশের গাফিলতিকে চিহ্নিত করে প্রকাশ্যেই পুলিশ সুপারকে অপদার্থ বলেছেন। বগুটুইতে পুড়িয়ে মারার ঘটনার পরও একইভাবে নিজের দায় ঝেড়ে ফেলেছিলেন। তবে এদিন অনুপ্রবেশ সহ এরাজ্যে বিএসএফ লোক ঢুকিয়ে উগ্রপন্থী হামলার ছক কষার মতো মন্তব্য যথেষ্টই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
Mamata infiltration
সঙ্ঘের ভাষ্য মতোই সীমান্ত সমস্যা নিয়ে জিগির তুললেন মুখ্যমন্ত্রী
×
Comments :0