Narada Sting Operation

এথিক্স কমিটি আর আদানি, নারদ হিমঘরে, মহুয়ায় রকেট গতি

ফিচার পাতা

 

শুদ্ধসত্ত্ব গুপ্ত

সিদ্ধান্ত নিয়েছে লোকসভার এথিক্স। অভিযোগ ওঠার পর অত্যন্ত দ্রুত সেরে ফেলা হয়েছে বহিষ্কারের পর্ব। তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ মহুয়া মৈত্রকে লোকসভায় ধ্বনি ভোটে বহিষ্কার করা হলো এথিক্স কমিটির সুপারিশেই। 
লোকসভার এথিক্স কমিটিই সিদ্ধান্ত নেওয়া তো দূর, অভিযোগ বিবেচনা করে উঠতে পারেনি নারদ ঘুষ কাণ্ডে। ২০১৬’তে বিধানসভা ভোটের কিছু আগে বেরিয়েছিল ভিডিও। নারদের ক্যামেরায় দেখা গিয়েছিল তৃণমূলের নেতা মন্ত্রী সাংসদদের হাত পেতে ঘুষ নিতে। মন্ত্রীদের একজন যদিও দল বদলে চলে গিয়েছেন বিজেপি’তে, বিধায়কও হয়েছেন। 
তখনও লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিজেপি’র। এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যানও দলের প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি।  
মহুয়া মৈত্রের বেলায় তৎপরতা কেন। অভিযোগ জানিয়ে লোকসভার অধ্যক্ষকে চিঠি দিয়েছিলেন বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। অধ্যক্ষ ওম বিড়লা দ্রুত অভিযোগ বিবেচনার জন্য চিঠি পাঠিয়েছেন এথিক্স কমিটিতে। দুবে পরিষ্কারই জানিয়েছিলেন তাঁর আপত্তির কারণ মহুয়া মৈত্র প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী এবং আদানি গোষ্ঠীর যোগাযোগ নিয়ে। অন্য ব্যবসায়ীর থেকে টাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মহুয়া। টাকা নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। যেমন নারদের বেলায় সরাসরি দেখা গিয়েছিল, তেমন কিছু হয়নি। আসল কথা মোদী-আদানি যোগ নিয়ে প্রশ্ন।
দীর্ঘদিন চিঠি চালাচালি চললেও তৃণমূল কংগ্রেস কিন্তু চুপ ছিল। ততদিনে কংগ্রেস, বিরোধী মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’-র একাধিক নেতা বা তার বাইরে অ-বিজেপি দলের থেকে নানা প্রশ্ন তোলা শুরু হয়ে গিয়েছে। সিপিআই(এম) স্পষ্ট করে বলেছে যে বিজেপি’র কোমর বেঁধে নামার কারণ আদানি। তৃণমূলের চুপ থাকারও কারণ এক- আদানি। বলা হয়েছিল যে গোপন নির্বাচনী বন্ডে তৃণমূলের তহবিলে একলাফে ৫শো কোটি টাকা বেড়ে যাওয়ার পিছনেও আদানি। বস্তুত নীরবতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে খানিক শোরগোলের পর অল্পস্বল্প মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছে তৃণমূল। আদানি-মোদী তো বটেই, নারদ রয়েছে বলেও সমস্যা আছে তৃণমূলের। 
২০১৬-র মার্চ মাসে এথিকস কমিটির কাছে নারদ স্টিং অপারেশনের ঘটনার অভিযোগ এসেছিল। লোকসভা থেকেই সিদ্ধান্ত হয় এথিকস কমিটি খতিয়ে দেখবে। আদবানিই ছিলেন চেয়ারম্যান। ভিডিও ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল এবং পরে সম্প্রচারিত হয়েছিল ৬ তৃণমূল সাংসদের অর্থ নেবার ঘটনা। একটি ভুয়ো কোম্পানির নাম করে সেই টাকা দেওয়া হয়েছিল ‘উৎকোচ’ হিসাবে। বিনিময়ে পশ্চিমবঙ্গে সুবিধা পাইয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। 
লোকসভার সদস্যদের মধ্যে সৌগত রায়, কাকলি ঘোষদস্তিদার, প্রসূন ব্যানার্জি, সুলতান আহমেদ (পরে প্রয়াত), শুভেন্দু অধিকারীর (পরে বিজেপি বিধায়ক, বিধানসভার বিরোধী দলনেতা) বিরুদ্ধে বেআইনি অর্থ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছিল। রাজ্যসভার সদস্য মুকুল রায়ের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠেছিল। মুকুল রায় পরবর্তী সময়ে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন। 
আদবানি কোনও সভাই ডাকেননি এথিক্স কমিটির। এই বিষয়ে কমিটিতে কোনও আলোচনাই করেননি। সেই বছরেই লোকসভায় পরপর দু’টি অধিবেশনে প্রসঙ্গ ওঠে। টেলিভিশন ক্যামেরায় সাংসদদের টাকা নিতে দেখা যাওয়া সত্ত্বেও এথিকস কমিটির কোনও হেলদোল নেই কেন, এই প্রশ্ন তুলেছিলেন সিপিআই(এম) সাংসদ মহম্মদ সেলিম। ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে এথিক্স কমিটি পুনর্গঠিত হয়। আদবানিকেই চেয়ারম্যান করে এথিক্স কমিটি তৈরি হয়। আবার, দু’বছর পরে সেই আদবানিকেই শীর্ষে রেখে এথিকস কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। তৃণমূল সাংসদদের বিরুদ্ধে অনৈতিকতার অভিযোগ সম্পর্কে কোনও উচ্চবাচ্যই করতে দেননি বিজেপি’র প্রবীণ নেতা!
সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য এবং লোকসভার সহকারী দলনেতা  সেলিম লোকসভার অধ্যক্ষকেও চিঠিও পাঠিয়েছিলেন। নৈতিকতা কমিটি যাতে নারদ ভিডিও নিয়ে নিজেদের বৈঠক করে, তার দাবি জানিয়েছেন তিনি। লোকসভা স্পিকার সুমিত্রা মহাজনের থেকে সেই চিঠির জবাব পাঁচ মাসেও পাননি সেলিম।
আদবানিকেই বললে কেবল চলে না। প্রধানমন্ত্রীর আসনে তখনও কিন্তু সেই নরেন্দ্র মোদী। যিনি রাজ্যে নিয়মিত আসছেন আর ঘুষখোর তৃণমূল নেতাদের জেলে ভরার হুমকি দিয়ে চলেছেন। 
পরবর্তী সময়ে নারদ কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যায় রাজ্য সরকার। শীর্ষ আদালতে সিবিআই তদন্তের রায়ই বহাল থাকে। যদিও সেই তদন্তের গতিও অস্বাভাবিক রকমের শ্লথ। কলকাতা পুলিশ পালটা মামলা সাজিয়ে নারদ নিউজের কর্ণধার ম্যাথু স্যামুয়েলসকে অভিযুক্ত করে। 
আদবানিই ফের চেয়ারম্যান হওয়ার সে সময়ে সাংসদ মহম্মদ সেলিম বলেছিলেন, ‘‘মমতা ব্যানার্জির কাছে খুবই সুখবর। তাঁর গডফাদার আবার এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন। এমনিতেই ধর্মঘট ভাঙতে তিনি যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছিলেন তাতে মোদী-শাহ জুটির পছন্দের তালিকায় তাঁর নাম পাকা হয়েছে। আশু ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত।’’
নারদ স্টিং অপারেশনের ফুটেজে পুলিশ আধিকারিক এসএমএইচ মির্জা, শোভন চ্যাটার্জি, ইকবাল আহমেদের কথোপকথনে একাধিকবার এসেছিল অভিষেক ব্যানার্জির নামও। 
টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা ইন্টারনেটে নারদ নিউজের স্টিং অপারেশনের সম্প্রচারিত ফুটেজে অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ পরিচয়ে এক যুবকের সঙ্গে লেনদেনের ছবিও দেখা গেছে। সঙ্গে মাঝবয়সি আরেকজন, যার পরিচয় দেওয়া হচ্ছে সুজয় কৃষ্ণ নামে। অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করা ঐ যুবকের নাম করণ শর্মা। সেই ওই ফুটেজে ম্যাথু স্যামুয়েলের কাছে দাবি ওই যুবক দাবি করেছে, একেবারে সঠিক ব্যক্তি (অভিষেক ব্যানার্জি)-র কাছে এসেছেন। যদিও ফুটেজে অভিষেক ব্যানার্জির সঙ্গে কোনও লেনদেনের ছবি দেখা যায়নি। 
নিউজের স্টিং অপারেশনের সম্প্রচারিত ফুটেজেও অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ পরিচয়ে এক যুবকের সঙ্গে লেনদেনের ছবি দেখা গেছে। সঙ্গে মাঝবয়সি আরেকজন, যার পরিচয় দেওয়া হচ্ছে সুজয় কৃষ্ণ নামে। অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করা ঐ যুবকের নাম করণ শর্মা। তিনি সেই সময় অর্থাৎ ২০১৪ সালে স্টিং অপারেশনের সময় তৃণমূলের যুব কংগ্রেসের রাজ্য কমিটির পদাধিকারী বলে দাবি করেছিলেন। ওই ফুটেজে ম্যাথু স্যামুয়েলের কাছে ওই যুবক দাবি করেছে, একেবারে সঠিক ব্যক্তির কাছে এসেছেন। করণ শর্মা অকপটে দাবি করেছেন সুজয় কৃষ্ণ নামে ওই ব্যক্তি রাজ্যের মন্ত্রীদের সঙ্গেও কথা বলিয়ে দিতে পারবে। অভিষেক ব্যানার্জির সঙ্গেও কথা বলিয়ে দিতে পারবে। দুজনেই অভিষেক ব্যানার্জির খুবই ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করেছে। যদিও ফুটেজে অভিষেক ব্যানার্জির সঙ্গে কোনও লেনদেনের ছবি দেখা যায়নি। 
অভিযোগের ‘গুরুত্বের কথা’ মাথায় রেখে নারদ নিউজের স্টিংকাণ্ডের তদন্তভার লোকসভার এথিকস কমিটির হাতে তুলে দিয়েছিলেন স্পিকার সুমিত্রা মহাজন। দিনটা ছিল মার্চের ১৬তারিখ। তারপর থেকে সাড়ে চার মাসেও কোনও বৈঠকে পর্যন্ত বসেনি এথিকস কমিটি। তারপরও না।
অথচ আদানি-মোদী ঘিরে প্রশ্ন তোলায় অভাবনীয় তৎপরতা! ১৬ অক্টোবর লোকসভার অধ্যক্ষকে চিঠি দিয়েছিলেন বিজেপি সাংসদ দুবে। আর মহুয়া মৈত্রের বহিষ্কার হলো ৮ ডিসেম্বর, দু’মাসেরও কম সময়ে। 
এক ব্যবসায়ী দর্শন হিরানন্দানির অভিযোগের ভিত্তিতে চিঠি দিয়েছিলেন দুবে। সেই ব্যবসায়ীর একটি হলফনামাই নথি বলে ধরে নেয় এথিক্স কমিটি। তাঁকে ডেকে জেরা পর্যন্ত করা হয়নি। টাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অভিযোগ জানানো এক আইনজীবীর বক্তব্যকেও নথি হিসেবে দেখানো হয়। এই আইনজীবী জয় আনন্দ দেহদ্রাইকেও জেরায় ডাকেনি এথিক্স কমিটি। কমিটির আলোচনা, নথি বারবার বের করা হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। অথচ সেসব পেশ হওয়ার কথা সংসদে! 
লোকসভার অধ্যক্ষ যখন সোমনাথ চ্যাটার্জি, ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে একাধিক সাংসদকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তদন্ত করেছিল অধ্যক্ষের গড়ে দেওয়া বিশেষ কমিটি। প্রত্যেককে আরেক সংস্থা ‘কোবরা পোস্ট’-র গোপন ক্যামেরায় সংসদে প্রশ্ন তোলার জন্য হাত পেতে টাকা নিতে দেখা গিয়েছিল। তারপরও সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের জেরা করেছিল সংসদীয় কমিটি। 
মহুয়ার বিরুদ্ধে প্রমাণিত একমাত্র অভিযোগ, সাংসদের ই-মেলের পাসওয়ার্ড ব্যবসায়ী হিরানন্দানিকে দেওয়া। মহুয়া মৈত্র নিজেই তা স্বীকার করেছেন। বিজেপি তাকেই বলেছে ‘দেশের সুরক্ষার পক্ষে বিপজ্জনক কাজ’। ই-মেলে প্রশ্ন পাঠানো ছাড়া আর কোনও নথি লেনদেন হওয়ার কথা নয়। সুরক্ষার পক্ষে বিপজ্জনক হলো কী করে, এই প্রশ্নেরও জবাব নেই। টাকা নিয়েছেন কিনা লোকপালের সুপারিশে সবে তার তদন্ত শুরু করেছে বলে জানিয়েছে সিবিআই।
নারদের সময়, ২০১৬’র এপ্রিলে দুর্গাপুরের জনসভায় ঘুষকাণ্ডে অভিযুক্তদের সপক্ষে রীতিমত সওয়াল করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এই প্রসঙ্গে সেদিন মমতা ব্যানার্জি বলেন,‘‘এত টাকা দেখাচ্ছে, ১লাখ, ২লাখ, ৫০হাজার টাকা। ছবিতে দেখাচ্ছে বলে তৃণমূল খারাপ? তাও তো সত্যি কিনা সব তদন্তের পর প্রমাণ হবে। কিন্তু যারা এত টাকা দিচ্ছে, তারাও অন্যায় করেছে।’’ বিরোধীদের আক্রমণ করে তৃণমূলনেত্রী এখানে বলেন, ‘‘আমাকে চোর বলছে, তোমরা কী!…সব ডাকু! দু’এক লাখ টাকা কে খাচ্ছে, সেটা খারাপ। কিন্তু যারা ক্যামেরার পিছনে কোটি টাকা খেলো, তাদের কী হবে?’’
তিন মন্ত্রী, ছয় সাংসদের সঙ্গে নোটের তোড়া দু’হাতে তুলেছিলেন কলকাতার মেয়রও। এথিক্স কমিটি সাংসদদের বাঁচিয়েছিল। বামপন্থীরা বলছেন, এখন এথিক্স কমিটি দলেরই এক সাংসদকে কোনও প্রমাণ ছাড়া। ফারাক করে দিচ্ছে আদানি-প্রধানমন্ত্রীর অটুট জোড়। যার মাঝে রয়েছে তৃণমূলও। সিপিআই(এম) সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্য বলতে পেরেছেন যে তদন্ত যদি করতে হয় তবে আদানিকে বিধি ভেঙে ব্যবসা করার অভিযোগেরও তদন্ত হওয়া জরুরি। 
তৃণমূলের কেউ এই কথাটুকুও বলতে পারলেন না।
 

Comments :0

Login to leave a comment