North India Rain

বর্ষার তাণ্ডবে উত্তর ভারতে মৃত ৩৪

জাতীয়

উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অংশ বর্ষার দাপটে কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শনিবার থেকে শুরু হওয়া লাগাতার ভারী বৃষ্টিতে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৩৪ জন। শুধু হিমাচল প্রদেশেই মৃত্যু ইতিমধ্যেই ২০ ছুঁয়েছে, তাও সরকারি হিসাবে। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড, রাজস্থান সহ রাজ্যে-রাজ্যে ভেঙে পড়েছে সেতু, বাড়ি-ঘর, দোকান। বন্ধ হয়ে গিয়েছে স্কুল। বাড়িতে জল ঢুকে নাজেহাল হয়েছেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। জাতীয় সড়ক সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সড়কপথ ধসের জেরে ভেঙে পড়েছে, কোথাও বা হড়পা বানে ভেসে গিয়েছে। গঙ্গা, যমুনা, বিপাশা, শতদ্রু সহ ছোট-বড় সমস্ত নদীই বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। জলের স্রোতে ভেঙে পড়েছে একাধিক সেতু। জল, খাবার সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগামী কয়েকদিনে আরও বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকায় বিপদ আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। 
ফুঁসছে বিপাসা থেকে চন্দ্রভাগা: 
হিমাচলে মানালি, কুলু, কিন্নর, চাম্বার উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে রবি, বিপাশা, শতদ্রু, সওয়ান, চন্দ্রভাগার মতো বড় বড় নদী। গত তিন দিনের লাগাতার বৃষ্টিতে নদীগুলি ফুঁসে উঠেছে। ধস এবং হড়পা বানে ভেসে গিয়েছে বহু দোকান, বাড়ি। ভেঙে গিয়েছে একাধিক নির্মাণ। স্বাভাবিক জনজীবন সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত। আবাসিক এলাকাগুলি কাদাজলে ডুবে গিয়েছে কার্যত। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ২০ জনের। চণ্ডীগড়-মানালি জাতীয় সড়ক, সিমলা-কিন্নর রোড সহ ১৩০০’র বেশি সড়কপথ এবং এক জেলা থেকে অন্য জেলার সংযোগকারী রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শহর এবং শহরতলিতে জমেছে হাঁটু জল। হরিদ্বারে গঙ্গা, দিল্লিতে যমুনা নদীর জলস্তরও বেড়ে গিয়েছে। বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে নদীগুলি। ফলে নিম্ন উপকূলবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ দূরত্বে সরানো হচ্ছে। উত্তরাখণ্ডেও টানা বৃষ্টিতে স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। 
হিমাচলে অস্বাভাবিক বৃষ্টি:
এবছর বর্ষার মরশুমে ১জুন থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত হিমাচলে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২৭১.৫ মিলিমিটার। স্বাভাবিক পরিমাণ বৃষ্টির (১৬০.৬ মিলিমিটার) থেকে ৬৯ শতাংশ বেশি। মঙ্গলবার এবং বুধবারও দিনভর বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সুখবিন্দর সিং সুখু রাজ্যবাসীর কাছে আবেদন করেছেন, দুর্যোগের মধ্যে বাড়ি থেকে না বেরনোর জন্য। তিনটি হেল্পলাইন নম্বরও চালু করা হয়েছে। রাজ্যজুড়ে আটকে পড়েছেন কমপক্ষে ৩০০ জন। মানালিতে আটকে রয়েছেন ২০ জন। আবহাওয়া দপ্তর এদিন হিমাচলজুড়ে লাল সতর্কতা জারি করেছিল, ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকায়। হিমাচল সড়ক পরিবহণ নিগমের ৮৭৬টি বাসরুট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টির জেরে আটকে পড়েছে ৪০৩টি বাস। মাণ্ডি, সোগি সহ বিভিন্ন জনপদে একেরপর এক ঘর-বাড়ি ভেঙে পড়েছে। ছবি, ভিডিও’তে দেখা যাচ্ছে সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য। আতঙ্ক ছড়িয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। বিপাসা নদীর জল বেড়ে যাওয়ায় নাগাওয়াই গ্রামে নিম্ন উপকূলবর্তী এলাকার বাসিন্দারা বিপদে পড়েন। রবিবার অনেক রাতে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী দড়ি, ক্রেন ব্যবহার করে উদ্ধার করেন তাঁদের। শুধু হিমাচলেই নয়, উত্তর পশ্চিমের একাধিক অংশে স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। উত্তরাখণ্ড, রাজস্থান, গুজরাটেও একাধিক বাড়ি ভেঙে পড়েছে। বিভিন্ন দুর্ঘটনায় জখম হয়েছেন অনেকে।
আদালত-স্কুল সবই বন্ধ:
ইউনেস্কোর হেরিটেজ সাইট জনপ্রিয় কালকা-সিমলা টয় ট্রেনের লাইনে ধস নেমে ভেঙে গিয়েছে বিভিন্ন জায়গা। ফলে আপাতত মঙ্গলবার পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে এই ট্রেন চলাচল। লাইন মেরামত হলে চালু করা হবে। স্কুল, কলেজ সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিও রাজ্যজুড়ে দু’দিন বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টে সোমবারও বন্ধ ছিল যাবতীয় কাজকর্ম। বার অ্যাসোসিয়েশন এদিনও নো ওয়ার্ক ডে’র ঘোষণা করেন। বৃষ্টির জেরে আইনজীবীরা আদালতে আসতে পারছেন না। রাস্তা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। দিল্লি, নয়ডা, গুরগাঁওয়ে সমস্ত স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কর্পোরেট অফিসগুলিতে কর্মীদের ওয়ার্ক ফ্রম হোমের নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
সঙ্গী প্রবল জলকষ্ট: 
লাগাতার বৃষ্টি-ধসে জল সরবরাহ প্রকল্পগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সিমলায় জল সরবরাহ ঠিক মতো হচ্ছে না। সিমলা জল প্রবন্ধন নিগম লিমিটেডের আধিকারিকরা জানান, সাধারণত প্রতিদিন ৪২ থেকে ৪৫ মিলিয়ন লিটার জল সরবরাহ হয়। কিন্তু সোমবার মাত্র ১১.০৩ মিলিয়ন লিটার জল সরবরাহ হয়েছে। চাহিদা এবং জল সরবরাহের মধ্যে বিরাট ফারাক হয়ে যাওয়ায় জলকষ্ট দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও তিন-চারদিন লেগে যাবে। 
অমরনাথ যাত্রা বন্ধ:
অমরনাথ যাত্রা সোমবারও বন্ধ রাখা হয়েছে। রামবানে জম্মু-শ্রীনগর জাতীয় সড়কে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। তিন দিন ধরে বন্ধ ২৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক। ভগবতীনগর বেস ক্যাম্পে ছ’হাজারের বেশি এবং চান্দেরকোটে পাঁচ হাজারের বেশি দর্শনার্থী আটকে রয়েছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই নতুন করে দর্শনার্থীদের অমরনাথ যাত্রায় অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। কাঠুয়া ও সাম্বায় লাল সতর্কতা জারি হয়েছে। 
তাপমাত্রা কমল দিল্লিতে:
দু’দিনের টানা বৃষ্টিতে সোমবার সকালে দিল্লির তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে দু’ডিগ্রি নিচে নেমে গেল। এদিন তাপমাত্রা ছিল ২৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিনও মেঘলা আকাশ এবং বৃষ্টির পূর্বাভাস দেয় আবহাওয়া দপ্তর। জমা জল পেরিয়ে এবং প্রবল যানজটের মধ্যেই সপ্তাহের প্রথম দিন নিত্যযাত্রীরা অফিস যেতে গিয়ে প্রবল অসুবিধায় পড়েন। হরিয়ানার হাথনিকুন্ড বাঁধ থেকে ১ লক্ষ কিউসেকের বেশি জল ছাড়ায় দিল্লি সরকার ১৬টি কন্ট্রোল রুম খুলেছে। 
জম্মু-কাশ্মীর, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান সহ উত্তর পশ্চিম ভারতের বিস্তীর্ণ অংশ কার্যত জলে ডুবে রয়েছে। দিল্লিতে ১৯৮২ সালের পর জুলাই মাসে একদিনে সর্বাধিক বেশি বৃষ্টি হয়েছে রবিবার। জলমগ্ন হয়ে পড়েছে দিল্লি প্রেস ক্লাব। 
উদ্ধারকাজে এনডিআরএফ:
পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড— এই চার রাজ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর (এনডিআরএফ) ৩৯টি দল মোতায়েন হয়েছে। পাঞ্জাবে কাজ করছে ১৪টি দল, হিমাচলে ১২টি, উত্তরাখণ্ডে আটটি এবং হরিয়ানায় পাঁচটি দল। প্রতিটি দলে রয়েছেন ৩০ থেকে ৩৫ জন কর্মী। নৌকা, দড়ি, গাছ কাটার যন্ত্র সহ একাধিক প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে বিভিন্ন প্রান্তে উদ্ধার কাজে শামিল হয়েছেন তাঁরা। 
গত দু’দিনের মতোই সোমবারও সারা দিন পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় বৃষ্টি হয়েছে। হাসপাতালে, বাড়িতে জল ঢুকে গিয়েছে। চণ্ডীগড়, পাঁচকুলা, যমুনানগর, আম্বালা, কার্ণাল, কুরুক্ষেত্র সহ হরিয়ানার বিভিন্ন অংশে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পাঞ্জাবে ফতেগড় সাহিব, মোহালি, রুপনগর এবং পাতিয়ালার অবস্থা সবথেকে খারাপ। এনডিআরএফ এই এলাকাগুলি থেকে সাধারণ মানুষকে উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে। 
বন্যার জলে উলটে গেল বাস:
হিমাচল প্রদেশ থেকে আসা একটি বাস হরিয়ানার আম্বালা-যমুনানগর সড়কের উপর বন্যার জলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উলটে যায়। বাসে আটকে থাকা যাত্রীদের দড়ির সাহায্যে কোনওরকমে উদ্ধারের চেষ্টা শুরু হয়। সেই ভিডিও এদিন সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, বাসের দরজা দিয়ে কোনওক্রমে বেরিয়ে দড়ি ধরে বন্যার জল পার করার চেষ্টা করছেন যাত্রীরা। আম্বালায় তিন নদী— মারকাণ্ডা, ঘাগ্গর এবং টাংরি বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। পাঞ্জাব-হরিয়ানার রাজধানী শহর চণ্ডীগড়ে লাগাতার বৃষ্টিতে ভেঙে গিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এক রাস্তার বিরাট অংশ। পাঞ্জাবে এক মাসে যে বৃষ্টি হওয়ার কথা তার ৭০ শতাংশই দু’দিনে হয়ে গিয়েছে। 
মাউন্ট আবুতে রেকর্ড বৃষ্টি: 
সিরোহি জেলায় মাউন্ট আবুতে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৩১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে সোমবার জানিয়েছেন আধিকারিকরা, গোটা রাজ্যে যা সর্বাধিক। সিরোহির পাশাপাশি আজমের, পালি, কারাউলি, জয়পুর, জালের, টঙ্ক, সিকরে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জয়পুরের মুরলিপুরায় বন্যার জলে ভেসে গিয়েছে সাত বছরের এক নাবালক। আলোয়ার, বংশওয়ারা, দুঙ্গারপুর, কোটা, প্রতাপগড় সহ একাধিক জায়গায় হলুদ সতর্কতা জারি হয়েছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment