BJP TMC panchayat

কমেনি, মোদী-শাসনে তৃণমূলের চুরি, সন্ত্রাস বেড়েছে

ফিচার পাতা

BJP TMC panchayat

নরেন্দ্র মোদীর সরকারের সময়েই তৃণমূলের চুরি, সন্ত্রাস বেড়েছে। যত বিজেপি বেড়েছে তত তৃণমূল বেপরোয়া হতে পেরেছে।
প্রমাণ রাজ্যের গ্রাম। 
মমতা ব্যানার্জির শাসনে এর আগে দু’বার পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছে। ২০১৩ এবং ২০১৮। দু’বারই ভোট লুট, বিরোধীদের আক্রমণ করেছে তৃণমূল। তবে ২০১৩-তে যখন ভোট হয়েছিল তখন কেন্দ্রে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার। ততদিনে ইউপিএ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন মমতা ব্যানার্জি। 
২০১৩’তে বিরোধী প্রার্থীদের উপর হামলা, ব্যাপক জবরদখল সত্ত্বেও ১৩টির বেশি জেলা পরিষদে জয়লাভ করতে পারেনি তৃণমূল। জলপাইগুড়ি, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর এবং মুর্শিদাবাদে তৃণমূল জিততে পারেনি। একইভাবে বহু পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েতেও বিরোধীদের জয় হয়েছিল। 
সেই নির্বাচনে রাজ্যের মোট ৪৮৮০০টি পঞ্চায়েতের আসনের মধ্যে নির্বাচনের আগেই, আতঙ্ক সৃষ্টি করে ৫৩৫৬টি আসন দখল করেছিল তৃণমূল। পঞ্চায়েত সমিতির ৯২৪০টি আসনের মধ্যে ৮৭৯টি আসনেরও একই কায়দায় দখল নিয়েছিল শাসক দল। রাজ্যে ১৭টি জেলা পরিষদের মোট আসন ৮২৫টি। তার মধ্যে ১৫টি আসনও একই কায়দায় দখল করেছিল তৃণমূল।


তারপরও যেগুলিতে নির্বাচন হয়েছিল, সেগুলিতে দেদার ছাপ্পা, ভোট লুট, বিরোধীদের মেরে বের করে দেওয়া, বুথ দখল করে পঞ্চায়েত দখল করতে চায় তৃণমূল কংগ্রেস। পাঁচ দফা নির্বাচন শেষে ফলপ্রকাশ ৩ আগস্ট। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘এই জয় গণতন্ত্রের জয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির জয়।’’ 
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা-বুথ দখল-ছাপ্পা ভোট-ভোট লুট করেই তৃণমূল জয়ী হয়েছিল ৫১% আসনে। তখন সতেরোটি জেলা পরিষদ ছিল। তার মধ্যে তেরোটা জেলা পরিষদ দখল করেছিল। যদিও গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের প্রায় অর্ধেক আসনে তৃণমূল হেরে গিয়েছিল। তাদের জয় হয়েছিল ৫১% আসনে। তার মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা সাড়ে পাঁচ হাজার আসনও রয়েছে। সেগুলি বাদ দিয়ে হিসাব করলে সোজাসুজি ভোটে লড়াই করে তৃণমূল জিতেছিল মাত্র ৪৫% আসনে। আবার এই শতাংশের হিসাবে বুথ দখল, ব্যাপক ছাপ্পা ভোট এবং গণনার সময় ভোট লুটের হিসাবও থাকছে। 
তবু বামফ্রন্ট জয়ী হয়েছিল ১৫,৫৯৩টি আসনে। শতাংশের বিচারে ৩২%। কংগ্রেস ৫৫০৬টি আসনে। শতাংশের বিচারে ১১%।

২০১৪-তে মোদী প্রধানমন্ত্রী হলেন। তার আগে মোদীকে ঘিরে দেশজুড়ে প্রবল প্রত্যাশা গড়ে তোলা হয়েছিল। সেই সময়েই দল ভাঙিয়ে পঞ্চায়েতের তিন স্তরেই দখলদারি শুরু হয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়াটি হলো নির্বাচিত সদস্যকে প্রাণে মেরে দেওয়া। সন্ত্রাসের পর্ব পেরিয়েই যেখানে বামপন্থীরা পঞ্চায়েত গঠন করেছিল, অঙ্ক কষে সেখানে খুনও করা হয়েছে। সভাপতি হিসাবে কাজ শুরুর আগেই নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম গাজিকে। পাটিগণিতের অঙ্কে সংখ্যা কমিয়ে এরপর সেই সমিতি দখলও করেছিলো শাসকদল। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফরাক্কায় খুন হন পঞ্চায়েত সমিতির নির্বাচিত সদস্য হাসমত শেখ। সব জেলাতেই এমন ঘটনা অজস্র ঘটেছিল। এই হিংস্র পদ্ধতিটিকেই তৃণমূলী নিয়মে পরিণত করার রেওয়াজ প্রতিষ্ঠিত করা হয়।

তৃণমূলের দখলের সবচেয়ে বড় উদাহরণ রয়েছে মুর্শিদাবাদে। ২০১৩-তে অনেক চেষ্টা করেও মানুষের ভোটে মুর্শিদাবাদ জেলায় দাগ কাটতে পারেনি তৃণমূল। ভোটের নিরিখে তাদের জনভিত্তি ছিল বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের তুলনায় অতি সামান্য, তারা ছিল তৃতীয় স্থানে। নির্বাচনী ফলাফলে তৃণমূল ২৫০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে মাত্র ৮টি পঞ্চায়েতে জয়ী হয়েছিল। পরে তৃণমূল ওই জেলায় ১৭৫টি পঞ্চায়েত দখল করে। জেলায় ২৬টির মধ্যে ১টি মাত্র পঞ্চায়েত সমিতি সাগরদিঘিতে জয়ী হয়েছিল তৃণমূল। পরে গা জোয়ারি করে তৃণমূলের দখলে ১৮টি পঞ্চায়েত সমিতি। আর জেলা পরিষদ? মোট ৭০টি আসনের মধ্যে তৃণমূল জয়ী হয়েছিল মাত্র ১টি আসনে। বাকি সবই ছিল বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস জিতেছিল। এমন জেলা পরিষদেও তৃণমূল দখলদারি কায়েম করেছিল ৪২ জনকে ভাঙিয়ে। 
তৎকালীন তৃণমূল নেতা ও পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী ছিলেন মুর্শিদাবাদ-দখলের কান্ডারি। পরবর্তীকালে দল ভাঙিয়ে দখলদারির এই ফরমুলা বা সূত্র মালদহ, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, উত্তর দিনাজপুর ইত্যাদি বহু জেলাতেই হয়েছে।


মমতা-শাসনে দ্বিতীয়বার নির্বাচন হয় ২০১৮’র মে-তে। তখন কেন্দ্রে মোদীর সরকার। সারদা, নারদ স্টিং অপারেশনে তৃণমূল নেতাদের দুর্নীতি উপচে পড়েছে বাইরে। তখন প্রচার ছিল, বিজেপি-ই পারে তৃণমূলকে আটকাতে। মোদীই টাইট দেবেন মমতা ব্যানার্জিকে। যদিও হয়েছে উলটো। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রায় ৩০ জন নিহত হয়েছিলেন। প্রায় ১ হাজার আহত হয়েছিলেন। মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয় কয়েক হাজার বামপন্থী কর্মীদের।
সেই নির্বাচনের আগেই ৩৪% আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করেছিল তৃণমূল। ভোটগ্রহণের আগেই ৩টি জেলা পরিষদ, ১২৫টি পঞ্চায়েত সমিতি এবং ১১২৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত শাসকদল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করে ফেলেছিল তৃণমূল। উদাহরণ হতে পারে বীরভূম। সেই জেলায় পঞ্চায়েতের তিনটি স্তর মিলিয়ে মাত্র ১৩ শতাংশ আসনে ভোট হয়েছিল। ২২৪৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে মাত্র ২৭৯টিতে, পঞ্চায়েত সমিতির ৪৬৫টি আসনের মধ্যে মাত্র ৬০টিতে ভোটগ্রহণ হয়।  আর জেলা পরিষদে ভোটের তো কোনও বালাই-ই ছিল না। তৃণমূলের ‘উন্নয়ন’ সবই দখল করেছে।


২০১৩-র থেকে তফাৎ ছিল ২০১৮-তে। তৃণমূলের দৌরাত্ম্য, দুর্নীতি, হামলা ছিল অনেক বেশি। লড়াই করার চেষ্টা করেছিলেন বামপন্থীরাই। তার আগে থেকেই বামপন্থীরা গ্রামের উন্নয়ন, রেগার টাকায় তৃণমূলের চুরির অভিযোগ তুলেছিল। কেন্দ্রীয় সরকার কোনও পদক্ষেপ নেয়নি।
২০১৮’র নির্বাচনে সন্ত্রাস ছিল আরও প্রবল। আরও ব্যাপক। খানাকুলে প্রার্থী পদ জমা দিতে গেছিলেন বামফ্রন্টের মহিলা প্রার্থীরা। তাঁদের ব্লক অফিসের বাইরে চুল ধরে মেরে, শাড়ি খুলে দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস খানাকুলে। এবার নির্বাচনই করতে দিতে চায়নি মমতা ব্যানার্জি— লক্ষ্য ছিল একটিই, দখল। প্রথম থেকেই, সব জেলায়, সব পর্যায়ে দখল করো। ২০১৮’র নির্বাচনে ৯টি জেলা পরিষদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করে তৃণমূল কংগ্রেস। যে জায়গায় ভোটে বিরোধীদের প্রার্থী ছিল, সেখানে জেলা পরিষদের আসনগুলির ৯৪% তে মমতা ব্যানার্জির দল জিতেছিল, স্রেফ বুথ দখল করে। দেদার ছাপ্পা, ভোট লুটের নজির হয়ে উঠেছিল এই পঞ্চায়েত নির্বাচন। 
বিরোধিতা করার ‘অপরাধে’ এক মহিলাকে জুতোর মালা পড়িয়ে কান ধরে ওঠবস করিয়েছিল তৃণমূলের নেতারা মেদিনীপুরে। সেই ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল দেশে। এ তো একটি নমুনা মাত্র। এমন ঘটেছে বহু। যেখানে প্রার্থী পদ জমা দেওয়ার কথা, সেই ব্লক অফিস দখল করেছিল তৃণমূল কংগ্রেসের সশস্ত্র বাহিনী। বীরভূমে তৃণমূলের নেতা-পালোয়ান অনুব্রত মণ্ডল বলেছিলেন,‘উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়।’ স্বৈরতন্ত্রর পক্ষে কী নিদারুণ, নির্লজ্জ ওকালতি!

বিজেপি কোনও ভূমিকা নিতে পারেনি। এমনকি গত পাঁচ বছরেও কেন্দ্রে মোদীর সরকার। রাজ্যে বিজেপি বিরোধী দল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে দুর্নীতির কোনও তদন্তেই বিশেষ অগ্রগতি হয়নি। সারদা, নারদ স্টিং অপারেশন গভীর জলে চলে গেছে। নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইও চলছে বামপন্থীদের নেতৃত্বে। মমতা ব্যানার্জির বারবার হুঙ্কার দিয়েছেন সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য সহ সিপিআই(এম) নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে।  

Comments :0

Login to leave a comment