Prakash Karat

আন্দোলনকে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করায় ঘাটতি আছে পার্টির

জাতীয়

— সাধারণ মানুষকে নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত করলেও তাদের সিপিআই(এম)’র রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করার ক্ষেত্রে পার্টির ব্যর্থতা রয়ে গিয়েছে, বললেন পার্টির পলিট ব্যুরোর কোঅর্ডিনেটর প্রকাশ কারাত। ইংরেজি দৈনিক দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেছেন, আরএসএস’র মোকাবিলার ক্ষেত্রেও পার্টি যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বিজেপি, আরএসএস সহ হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে লড়াই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে শুধু নির্বাচনী লড়াইয়ের মধ্যেই। একইসঙ্গে ইংরেজি দৈনিক দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, এখন সিপিআই(এম)’র প্রথম কাজ হলো বিজেপি-আরএসএস এবং যে প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী শক্তির তারা প্রতিনিধিত্ব করে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করা। তার জন্য একদিকে যেমন বিরোধী শক্তির ব্যাপকতম ঐক্যের কথা সিপিআই(এম) বলছে, তেমন পার্টির স্বাধীন শক্তি, রাজনৈতিক প্রভাব ও গণভিত্তিকে প্রসারিত করতে হবে। আগামী বুধবার (২ এপ্রিল) তামিলনাডুর মাদুরাইয়ে শুরু হচ্ছে সিপিআই(এম)’র ২৪তম কংগ্রেস। তার প্রাক্কালে এই দুই সংবাদপত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে খোলাখুলিই তিনি ব্যাখ্যা করেছেন পার্টির সাংগঠনিক দুর্বলতার জায়গাগুলিকে, স্পষ্ট করে দিয়েছেন সিপিআই(এম)’র আশু রাজনৈতিক কর্তব্যকে। দু’টি সাক্ষাৎকারই প্রকাশিত হয়েছে সোমবার। 
সিপিআই(এম)’র সাংগঠনিক দুর্বলতা, তার কারণ এবং পার্টির মূল লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে দু’টি সাক্ষাৎকারে কারাত বলেছেন, ‘‘আমাদের পার্টি বিশ্বাস করে, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নয়, জনগণের মধ্যে কাজ করার মধ্য দিয়ে এবং তাদের সমস্যার কথা শুনে ও তাদের নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে সিপিআই(এম)’র গণভিত্তি ও নির্বাচনী শক্তিকে বাড়াতে হবে। আমরা তা করছি, কিন্তু যে মানুষ আমাদের কাছে আসছেন, তাদের আমাদের রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে পারছি না। পার্টি, ট্রেড ইউনিয়ন বা অন্যান্য গণসংগঠনগুলি সাধারণ মানুষকে লড়াই-আন্দোলনে শামিল করতে সফল হলেও সেই সাফল্যকে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জায়গায় নিয়ে যেতে পারছে না। সেই রাজনৈতিক কর্তব্য বাকি পড়ে থাকছে। পাশাপাশি আরও কারণ আছে। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে আমরা যাদের শ্রেণি শত্রু ও বিরোধী বলে মনে করি, তাদের চরিত্রের পরিবর্তন হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের এই সব নতুন শ্রেণি এবং পুঁজিবাদী শোষণের নতুন ধরনগুলিকে অনুধাবন করতে আমরা ব্যর্থ। আমাদের বুঝতে হবে, কোন গোষ্ঠী বা শ্রেণিগুলির উপরে এর আক্রমণ নেমে আসছে। তাদের মধ্যে আমাদের কাজ করতে হবে।’’ তিনি বলেছেন, ‘‘এবারের পার্টি কংগ্রেসে তাই মূল যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে, তা হলো, কীভাবে সিপিআই(এম)’র স্বাধীন শক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাবকে বাড়ানো যাবে এবং তার গণভিত্তিকে প্রসারিত করা যাবে। আমাদের স্বাধীন শক্তি যথেষ্ট বাড়েনি, তার কারণ ও উপাদানগুলিকে চিহ্নিতও করা হয়েছে। তা নিয়ে পার্টি কংগ্রেসের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত আমাদের পার্টির অগ্রগতির পক্ষে ফলপ্রসূ হবে।’’
দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কারাত সিপিআই(এমর)’র সাংগঠনিক দুর্বলতার অন্যতম কারণ হিসাবে রাজনৈতিক ভূমিকা পালনে ঘাটতিকে ব্যাখ্যাও করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা। কারাত বলেছেন, ‘‘আমরা বিজেপি, আরএসএস এবং হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলি। কিন্তু ঠিক কীভাবে ওরা বেড়েছে? অধিকাংশ দলের মতো আমরাও শুধু নির্বাচনের সময়ে ওদের বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াই সংগঠিত করার কথা বলি। আমরা মনে করছি, নির্বাচনী লড়াইয়েই সব কাজের চূড়ান্ত ফল মিলবে। অন্যদিকে, আরএসএস কাজ করে চলেছে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বৃত্তের মধ্যে এবং আরও নানা ক্ষেত্রে। আমরা কোথায়? আমরা কি ওদের মোকাবিলার জন্য একইভাবে কাজ করছি? যেমন, আমাদের অবশ্যই ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে কাজ করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, আমরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে লড়াই করছি না। বরং আমরা তাদের বিরুদ্ধে, যারা (মানুষের) ধর্মীয় বিশ্বাসকে রাজনীতির জন্য ব্যবহার করছে। পার্টির আগের কংগ্রেসে সঠিকভাবেই এর অভিমুখকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু আমরা তা রূপায়ণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা করতে চাইনি বলে ব্যর্থ হয়েছি, তা নয়। কীভাবে এই কাজ করতে হবে, তা আমরা যথাযথভাবে ঠিক করে উঠতে পারিনি। গত ২০-৩০ বছরে সমাজে ধর্ম নিয়ে উন্মাদনা বেড়েছে আগের থেকে অনেক বেশি। প্রশ্ন হলো, কীভাবে সেই ধর্মীয় উন্মাদনার মধ্যে নিজের রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত বক্তব্যকে নিয়ে যাওয়া যাবে? তাদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলে, যারা বেশি বেশি করে ধর্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন।’’ কারাত এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘‘প্রচলিত ধারণা হলো, এক জন কমরেড হবেন নাস্তিক, তাহলে সেই কাজ করা কতটা কঠিন হবে?’’ উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘‘সিপিআই(এম)’র সদস্যদের মধ্যে অনেকেই আস্তিক। আমাদের পার্টির গঠনতন্ত্রে কোনও ধারায় বলা হয়নি, এক জনকে (পার্টির সদস্য হতে হলে) নাস্তিক হতেই হবে। পার্টিতে আস্তিক যাঁরা আছেন, তাঁরা যদি জনগণের মধ্যে কাজ করেন এবং জনগণের সমস্যাকে তুলে ধরেন, তাহলে ধর্মে বিশ্বাস করে না, এমন একটি পার্টির লোক হলেও জনগণ তাঁদের শ্রদ্ধাই করবেন। (আমাদের) পার্টির সদস্যদের ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে পৌঁছাতে হবে, ধর্মীয় বিশ্বাস ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সেই বিশ্বাসকে অপব্যবহারের চেষ্টার মধ্যে পার্থক্য তাদের বোঝাতে হবে।’’ 
দু’টি সাক্ষাৎকারেই এসেছে কেরালার প্রসঙ্গ। সম্প্রতি ওই রাজ্যের এলডিএফ সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য আইন তৈরি করেছে। সিপিআই(এম) যেখানে শিক্ষার বেসরকারিকরণের বিরোধী, সেখানে এই অবস্থান বদল কেন? প্রশ্ন করা হয়েছিল কারাতকে। উত্তরে তিনি বলেছেন, শিক্ষার বেসরকারিকরণ হচ্ছে এবং তা বাড়ছেও। একে রুখে দেওয়ার জায়গায় সিপিআই(এম) নেই। সিপিআই(এম) কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকলে অন্য কিছু করতে পারত। বহু রাজ্যেই শিক্ষার ব্যাপক বেসরকারিকরণ হয়েছে। কেরালা এই প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে। যেমন বিদ্যালয় শিক্ষায় কেরালার সরকারি ব্যবস্থা দেশের মধ্যে অন্যতম সেরা। গুণগত মানকে উন্নত করায় গত ৮-৯ বছরে লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী বেসরকারি বিদ্যালয় ছেড়ে ভর্তি হয়েছে সরকারি বিদ্যালয়ে, সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ে। উচ্চ শিক্ষাতেও তা করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সীমিত সম্পদের কারণে সবটা করা যায়নি। পরিণতিতে উন্নত মানের উচ্চ শিক্ষার জন্য কেরালা থেকে বহু ছাত্রছাত্রী দেশের অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে, অনেকে যাচ্ছে বিদেশেও। তিন দশকেরও আগে ভারতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। এখন দেশে সব মিলিয়ে ৪৭১টি এমন বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। কেরালার দুই প্রতিবেশী রাজ্য তামিলনাডু ও কর্নাটকেও ভাল সংখ্যায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এ‍‌ই অবস্থায় কেরালার ছাত্রছাত্রীরা যাতে রাজ্যের মধ্যেই উন্নত মানের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেতে পারে, তার জন্য এলডিএফ সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর কিছুটা সরকারি নিয়ন্ত্রণ রাখার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে ৪০ শতাংশ আসনে ভর্তি নিতে হবে কেরালার ছাত্রছাত্রীদের, আসন সংরক্ষিত রাখতে হবে তফসিলি জাতি ও আদিবাসীদের (এসসি-এসটি) জন্য এবং নির্বাচিত ছাত্র সংসদের ব্যবস্থা করতে হবে। ‍সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়েছিল কেরালার লোকসানে চলা রাজ্য সরকারি সংস্থাগুলিতে বেসরকারি বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও। কারাত বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)’র নেতৃত্বাধীন সরকার এই সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নিয়েছিল। কেরালা অনেকটা সময় নিল পরিস্থিতি বুঝতে। ইতিমধ্যে লোকসানে চলা বেশ কিছু রাজ্য সরকারি সংস্থাকে লাভজনক করে তোলা সম্ভব হয়েছে কেরালায়। কিন্তু ক‌য়েকটি‍‌কে পুনরিজ্জীবিত করা যাচ্ছে না। সেগুলিকে চালু রাখা ও কর্মীদের বেতন দিয়ে যাওয়া মানে সরকারি কোষাগারের অর্থের অপচয়। এমন সংস্থাগুলির ক্ষেত্রেই বেসরকারি বিনিয়োগকে যুক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, কিছু বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে আসবে। খুবই সীমিত ক্ষেত্রে এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। 
ইন্ডিয়া মঞ্চের ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে কারাত বলেছেন, লোকসভা নির্বাচনের পরবর্তী নয় মাসের মধ্যে ওই মঞ্চের কোনও বৈঠক হয়নি। লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে এই মঞ্চ গড়ে তোলা হয়েছিল। সংসদে বিজেপি’র গরিষ্ঠতা আটকাতে মঞ্চ আংশিক সফলও হয়েছে। কিন্তু লোকসভা ভোটের পরবর্তী পর্বে কী করণীয়, তা নিয়ে কোনও বোঝাপড়া গড়ে ওঠেনি। অবশ্য সংসদে যেসব বিষয় ও নীতির প্রশ্ন উঠছে, সেগুলি নিয়ে ইন্ডিয়া মঞ্চের সব দল সমন্বয় রেখে কাজ করছে। সংসদের বাইরেও সেই সমন্বয় নিয়ে আলোচনার দরকার আছে। সিপিআই(এম) মনে করে, সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলের একটি ব্যাপক মঞ্চ থাকা দরকার। নির্বাচনের পরে এই মঞ্চকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে, তার পরিকল্পনা করার প্রয়োজনও আছে। তবে সিপিআই(এম) এই বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কারণ, পার্টি তেমন বড় শক্তি নয়। সিপিআই(এম) চায়, সব দল একসঙ্গে বসে আলোচনা করে একটি অভিন্ন বোঝাপড়ায় পৌঁছাক এই মঞ্চকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যেহেতু তেমন কোনও বৈঠক এখনও হয়নি, তাই সাধারণভাবে এই ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ইন্ডিয়া মঞ্চ দিশাহীন হয়ে পড়েছে। 
সাক্ষাৎকারে দেশের স্বার্থে বাম ঐক্যের পুনরুজ্জীবনের কথাও বলেছেন কারাত। এক্ষেত্রে সিপিআই এবং সিপিআই(এম-এল) কোনও বাধা কি না, সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জোরের সঙ্গে বলেছেন, একেবারেই না। বাংলা ও ত্রিপুরায় সিপিআই(এম) দুর্বল হয়েছে বলে সামগ্রিকভাবে জাতীয় রাজনী‍‌তিতে বাম প্রভাব কমেছে। এখন সামগ্রিকভাবেই বাম শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা হচ্ছে। সেই লক্ষ্যে উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। বাজেটের পরেই সবকটি বামপন্থী দল একসঙ্গে প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল। গাজায় ইজরায়েলের আক্রমণের বিরুদ্ধেও একসঙ্গে রাস্তায় নেমেছে বাম দলগুলি। আরও বহু বিষয়েই বাম দলগুলি ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি নিচ্ছে। সিপিআই(এম) এই উদ্যোগকে আরও প্রসারিত করতে চায়। পার্টির ২৪তম কংগ্রেসের পরে নতুন উদ্যমে এগনো হবে সেই লক্ষ্যে।  

Comments :0

Login to leave a comment