আবাস যোজনার বাড়ি পাবেন কারা, তালিকা নিয়ে যাচাই করবে পুলিশ!
লুটের পঞ্চায়েতে গত এক দশকে ছাঁটাই হয়েছে মানুষের অধিকার। এবার পঞ্চায়েতের প্রশাসনিক ক্ষমতা পর্যন্ত কেড়ে নেওয়ার দিকে এগচ্ছে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পুলিশকে দিয়ে আবাস যোজনার তালিকা চূড়ান্ত করার নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে নবান্ন।
গ্রামসভায় মানুষের অংশগ্রহণে যে তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার কথা। সেই ব্যবস্থাকেই খর্ব করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে নবান্ন। শুক্রবার জেলা শাসকদের সঙ্গে অনলাইন বৈঠক করেন রাজ্যের মুখ্যসচিব। প্রশাসনিক ওই বৈঠকেই আবাস যোজনার উপভোক্তাদের ঘর পাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পুলিশের ওপর তুলে দেওয়া হয়েছে। নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, এদিনের বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ বলে জেলা শাসকদের কাছে পুলিশকে ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রীর আবাস যোজনার উপভোক্তাদের তালিকা চূড়ান্ত করার কথা জানান মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী।
সরকারের এই উদ্যোগের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সিপিআই(এম)-র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তাঁর বক্তব্য, ‘‘গ্রামসভায় মানুষের কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এ তো পুলিশ রাষ্ট্রের সব লক্ষণ ফুটে উঠছে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নির্বাচিত পঞ্চায়েতের প্রতি আস্থা নেই। একইভাবে প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদেরও তাদের আধিকারিকদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এইসব করেও কী দুর্নীতি আটকানো যাবে?’’
এদিন বৈঠকে ঠিক হয়েছে, গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার প্রতিটি সংসদ ধরে একটি টিম তৈরি করা হবে। আইসিডিএস, আশাকর্মী ও পুলিশকে রাখা হয়েছে এই টিমে। আবাস যোজনার তালিকায় নাম আছে এমন প্রতিটি পরিবারে গিয়ে টিমের সদস্যরা তদন্ত করবে। একইসঙ্গে পুলিশকে আলাদা করে উপভোক্তার তালিকা ধরে তদন্ত করতে বলা হয়েছে। ঘর পাওয়ার জন্য তালিকায় নাম থাকা উপভোক্তা আদৌ যোগ্য কীনা তা খুঁজে দেখবে পুলিশ। পুলিশের তৈরি করে দেওয়া চূড়ান্ত তালিকা পাঠানো হবে প্রশাসনের কাছে। তদন্ত করার সময় কোনও গাফিলতি নজরে আসলে পুলিশকে পদক্ষেপ নিতেও এদিন বৈঠক থেকে মুখ্যসচিব নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রশাসনিক বৈঠকে এই সিদ্ধান্তের পর রাজ্যের জেলাস্তরে আধিকারিক মহলে তুমুল শোরগোল পড়ে যায়। আবাস যোজনার টাকা খরচ নিয়ে ইতিমধ্যেই পঞ্চায়েত দপ্তরের তরফ থেকে গাইডলাইন তৈরি করে জেলা শাসকদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতেই ২২ ডিসেম্বর ঠিক হয়েছে গ্রামসভার বৈঠক শেষ করে ফেলার। ২৫ ডিসেম্বর থেকে বাড়ি তৈরির কাজে নামার কথা। পঞ্চায়েত দপ্তরের নিজস্ব পরিকল্পনাকে কার্যত উড়িয়ে দিয়ে নবান্ন থেকে পুলিশ নামিয়ে উপভোক্তা ঠিক করতে বলা হয়েছে।
যে কাজ মানুষের অংশগ্রহণে করার কথা, তা কীভাবে এড়িয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে ক্ষোভ গোপন করেননি পঞ্চায়েত দপ্তরের আধিকারিকরা। প্রশাসনিক এক সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্যের সিংহভাগ গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ শাসকদলের দখলে। তারপরেও পঞ্চায়েত ভোটের আগে আবাস যোজনার বাড়ি নিয়ে যাতে কোনোভাবে দুর্নীতি মাথাচাড়া দিতে না পারে তারজন্যই পুলিশকে ব্যবহার করার কথা ভাবা হয়েছে।
প্রশাসনের অন্য একটি সূত্র অবশ্য বলছে, পুলিশের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ ছেড়ে কার বাড়ি হবে সেই তালিকা যাচাই করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। তা মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা সকলেই জানেন। তাই পুলিশকে সামনে রেখে গ্রামসভাকে এড়িয়ে কার্যত শাসকদলের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে আবাস যোজনার কারা ঘর পাবে, তা তুলে দেওয়া হবে।
রাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার আইনে গ্রামসভার বৈঠক বসিয়ে আবাস যোজনায় কারা ঘর পাবে তার তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার কথা। গ্রামের মানুষের অংশগ্রহণে, আলোচনার ভিত্তিতে তালিকা তৈরি করে পাঠানো হবে ব্লকের কাছে। গোটা পর্বে পুলিশের কোনও ভূমিকাই নেই। তবে উপভোক্তা নিয়ে কোনও অভিযোগ আসলে ব্লক প্রশাসন তা যাচাই করতে পারে। গ্রামে গিয়ে সেই যাচাই পর্বে নিরাপত্তার সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকলে পুলিশের সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় ব্লক থেকে গ্রাম পঞ্চায়েতের কোনও কাজে স্বতপ্রণোদিত হয়ে পুলিশের ভূমিকা পালনের কোনও অধিকার নেই। পঞ্চায়েত প্রধান পুলিশের সাহায্য না চাইলে পুলিশ পঞ্চায়েতের কাজে আগ বাড়িয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না বলেই জানাচ্ছেন পঞ্চায়েত দপ্তরের আধিকারিকরা।
গত ২৪ নভেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকা এসেছে রাজ্যে। ১১ লক্ষ বাড়ি তৈরি করার জন্য কেন্দ্রীয় বরাদ্দের ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক। আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যেই চলতি আর্থিক বছরের জন্য বরাদ্দ টাকা খরচ করতে হবে রাজ্যের পঞ্চায়েত দপ্তরকে। এমনিতেই ৮ মাস পরে স্থগিত থাকা কেন্দ্রীয় সরকার আবাস যোজনার জন্য টাকা বরাদ্দ করেছে। ফলে টাকা খরচের জন্য রাজ্যের হাতে পড়ে আছে চার থেকে পাঁচ মাস। তাই প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা নিয়ে এদিন নবান্ন থেকে ভার্চুয়ালি জেলা শাসকদের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যসচিব। পঞ্চায়েত ভোটের আগে দ্রুত টাকা খরচের জন্য শেষ পর্যন্ত পুলিশকে ব্যবহার করতে চলেছে রাজ্য সরকার।
Comments :0