‘‘যখন তৃণমূলে ছিলে তখন রোজা রাখতে। তোমার জামা বদল হলেও ভিতরটা বদলায়নি। দেখো আবার লাল জামা পড়ো না।’’
শুভেন্দু অধিকারীর উদ্দেশ্যে বুধবার বিধানসভায় এই কথাগুলি বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। শুভেন্দু ‘লাল জামা’ পড়বেন না কখনও, তাঁকে বামপন্থীরা কখনো নেবে না জেনেও মমতা ব্যানার্জি শুভেন্দুকে সাবধান করেছেন শুধু ‘লাল জামা’ সম্পর্কে। তাঁর অনেক দিনের ভরসা বিজেপি’র মতোই শুভেন্দুও মমতা ব্যানার্জির অনেক দিনের কাছের। তাই সেই চেনা খেলোয়াড় শুভেন্দু সম্পর্কে মমতা ব্যানার্জি নির্দ্বিধায় বলতে পেরেছেন, ‘ভিতরটা বদলায়নি’।
দু’জনের সম্পর্ক এমনই—‘দিদি-ভাই’য়ের। ‘দিদি’ মমতা ব্যানার্জির হয়ে খেলছেন ‘ভাই’ শুভেন্দু অধিকারী। ক্ষমতা দখলের এই খেলায় ফুটবল করা হয়েছে ধর্মকে।
সেই খেলার অঙ্গ হিসাবেই বিজেপি’র পরিষদীয় দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী মঙ্গলবার আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনের পর তাঁর কর্মসূচি সম্পর্কে বলেছিলেন,‘‘বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়কে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাবো, আর ওদের (তৃণমূল) যে ক’টা মুসলমান বিধায়ক জিতে আসবে, বিজেপি সরকারে আসবে, চ্যাংদোলা করে তুলে রাস্তায় ফেলব। ১০ মাস পরে এই রাস্তায় ফেলব।’’
বেশ কিছুদিন সাংসদ, বিধায়ক থাকা শুভেন্দু ভালো করেই জানেন যে, এমন কথা সংসদীয় গণতন্ত্রে, ধর্মনিরপেক্ষ দেশে বলা উচিত নয়। তবু বলেছেন। মমতা ব্যানার্জি বুধবার বিধানসভায় শুভেন্দুর বাড়িয়ে দেওয়া পাস ধরে বলে নিয়েছেন, ‘‘মুসলমান এএলএ-দের ছুঁড়ে ফেলে দেবে? এত সাহস! আমি নিজে হিন্দু। আমার বাড়িতে কালীপুজো হয়, সব ধরনের পুজো হয়।’’ গুজরাটে সংখ্যালঘুদের উপর মোদী সরকারের সময় হিন্দুত্ববাদীদের অত্যাচারের পরেও বিজেপি’র সঙ্গী থাকা মমতা ব্যানার্জি এদিন বলেছেন, ‘‘ধর্ম বিজেপি’র কাছে শিখব না।’’
শুভেন্দু কেন মমতা ব্যানার্জিকে এই কথাগুলি বলার সুযোগ করে দিলেন? বামপন্থীরা কাজ, বাসস্থান, রেগার বকেয়া মজুরি, ফসলের দাম, খেতমজুরের মজুরির মতো বিষয়ে ব্রিগেড সমাবেশের প্রচার শুরু করেছেন। মৃত, জাল ভোটার ভর্তি ভোটার তালিকা সংশোধনের দাবিতে সিপিআই(এম) কর্মীরা সোচ্চার হয়েছেন। নারায়ণগড় থেকে বারুইপুর— মানুষের উপর যে কোনও অত্যাচারের প্রতিবাদে বামপন্থীরা ছুটে যাচ্ছেন, মিছিল-অবরোধ করছেন। এমন সময়ে ‘হিন্দু-মুসলমান’ এনে হাজির করেছেন শুভেন্দু অধিকারী। কারণ— তিনি মানুষের প্রধান দাবিগুলি থেকে নজর ঘুরিয়ে মমতা ব্যানার্জিকে সুযোগ করে দিচ্ছেন ধর্ম নিয়ে বলতে।
এই খেলাই খেলছেন মমতা ব্যানার্জি-শুভেন্দু অধিকারী। অনেকগুলির দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে যার বিরুদ্ধে, সেই অভিষেক ব্যানার্জিকে ভবিষ্যতে বিজেপি’তে পাঠানো হলে, শুভেন্দু তৃণমূলে ফিরতেও পারেন— এমন সম্ভাবনাও দেখছেন অনেক তৃণমূল নেতা। শুভেন্দু-ঘনিষ্ট, হলদিয়ার প্রভাবহীন বিধায়ক তাপসী মণ্ডল বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে গিয়ে সেই সম্ভাব্য খেলার একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন গত সোমবার।
গত ২৭ফেব্রুয়ারি নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রী বলেই দিয়েছিলেন যে, এবারও খেলা হবে। সেই ‘খেলা’ শুরু আগামী বিধানসভা নির্বাচনের জন্য। মূলত আর জি কর হাসপাতালে তরুণী ট্রেনি নার্সের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রাজ্যে গণআন্দোলন দেখে ‘ধর্ম’-কে ফের অ্যাজেন্ডায় নিয়ে আসার অঙ্ক সাজিয়েছে দু’দল। তৃণমূলের নেতারা এই বিষয়টি বুঝতে পেরে নিজেদের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। দিলীপ ঘোষের মতো বিজেপি’র নেতারা খেলাটি বুঝে দর্শকের আসনে বসেছেন। আর সুকান্ত মজুমদারের মতো বিজেপি’র ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর নেতারা প্রয়োজনীয় তাল দিচ্ছেন। এদিন বিধানসভায় মমতা ব্যানার্জি বলেছেন,‘‘সভাপতি হওয়ার জন্য এসব করছে। এভাবে সভাপতি হওয়া যায়? সভাপতি হয় দক্ষতা বিচার করে।’’
বিজেপি তাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সভাপতি এখনও ঠিক করেনি। কিন্তু বিজেপি’র সভাপতি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে মমতা ব্যানার্জির এই জ্ঞান নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। রাজ্যে সভাপতির দৌড়ে আছেন শুভেন্দু। তিনি এদিন বলেছেন,‘‘বিজেপি-তে এক ব্যক্তি এক পদ নীতি আছে।’’ কিন্তু এটি কথার কথা। শুভেন্দু ইতিমধ্যেই দিল্লিতে গিয়ে দলের নেতাদের বলে এসেছেন যে, ‘প্রাক্তন-বামপন্থী’ শঙ্কর ঘোষকে বাকি কয়েক মাসের জন্য পরিষদীয় দলনেতা করে তাঁকে দলের রাজ্য সভাপতি করা যায়। বিজেপি’র এক প্রাক্তন সাংসদ বলেছেন,‘‘বিষয়টি নেতৃত্বের বিবেচনায় আছে। এতে বামপন্থী ভোটারদের মধ্যে একটি ছাপ ফেলা যেতে পারে বলে শুভেন্দু মনে করছে।’’ এই সাংসদ কী মনে করেন? কড়া সুরে চড়া কথা বলায় তাঁর ‘খ্যাতি’ থাকলেও এদিন জোরে হেসে উঠে তিনি বলেছেন,‘‘আমি এখন দর্শক।’’
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিধানসভার বাইরে নন্দীগ্রামের বিধায়ক বলেছিলেন,‘‘এই সরকার মোল্লাদের সরকার। এই সরকার মুসলমানদের সরকার। এই সরকার কাশ্মীরি জঙ্গি জাভেদ মুন্সির সরকার। এই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মুসলিম তোষণকারী, হিন্দুবিরোধী, মুসলিম লিগ-২-এর সরকার।’’ এরপর শুভেন্দুর বিরুদ্ধে স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিস দেয় তৃণমূল। তা নিয়ে জলঘোলা হয়। বিধানসভায় সব ইস্যু ছেড়ে শুভেন্দুর এই বক্তব্য নিয়ে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘক্ষণ বলেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তিনি সেদিনও নিজের হিন্দু পরিচয় প্রকাশ করার সুযোগ ছাড়েননি। বলেছিলেন,‘‘আমি যে বাড়িটায় থাকি, ছোট থেকে, সেই বাড়িটায় একটি মন্দির আছে। শিবমন্দির। সেই দুয়ারে, যেখানে আমি মাথা রেখে ঘুমাই।’’ শিব তাঁর মাথায় থাকলে রাজ্যবাসীর কী লাভ, সেই প্রশ্ন স্বভাবতই বিধানসভায় বিজেপি করেনি। তিনি সেদিন আরও বলেছিলেন,‘‘আমিও কিন্তু ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে।’’
তিনিও যে হিন্দু—তা রাজ্যের সংখ্যাগুরুদের জানানোর সুযোগ ব্যবহার করেছিলেন তিনি, শুভেন্দুর বাড়ানো পাস ধরে।
Comments :0