SC on Avijit Ganguly

অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে নির্দিষ্ট মামলা থেকে সরাতে বলল সুপ্রিম কোর্ট

জাতীয়

এক টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ থেকে মামলা সরিয়ে নেবার নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। কোন্‌ মামলা, তা স্পষ্ট উল্লেখ না থাকলেও বলা হয়েছে যে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে শীর্ষ আদালতে এই প্রশ্ন এসেছিল। রায়ের বয়ানে ‘ইন দি কেস’ শব্দবন্ধই উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতিতে ধৃত কুন্তল ঘোষ সংক্রান্ত মামলারই উল্লেখ করা হয়েছে। 
ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের কয়েক ঘণ্টা পরেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের সেক্রেটারি জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁর সাক্ষাৎকারের যে বয়ান বা অনুবাদ শীর্ষ আদালতে পেশ করা হয়েছে তা তাঁকে পাঠাতে। শুক্রবার রাত ১২টার মধ্যে সেই বয়ান তাঁকে পাঠানোর জন্য স্বতঃপ্রণোদিত এই নির্দেশ দেন তিনি। যে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের রায় এসেছে, সেই সাক্ষাৎকারটির কোন্‌ বয়ান শীর্ষ আদালতে পেশ হয়েছে, তা জানতেই এই নির্দেশ। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, রাত সওয়া বারোটা পর্যন্ত তিনি চেম্বারে থাকবেন। তার মধ্যেই যেন তাঁকে ওই বয়ান পাঠানো হয়। 
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এই নির্দেশে ফের স্থগিতাদেশ দিয়ে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। শুক্রবার রাত আটটায় বিচারপতি এ এস বোপান্না ও হিমা কোহলির বেঞ্চ বিশেষ অধিবেশনে বসে। মৌখিক ভাবে বিচারপতি বোপান্না বলেন, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় যে নির্দেশ পাঠিয়েছেন তা যথাযথ নয়। সলিসিটর জেনারেলও একমত হয়ে বলেন, এই নির্দেশ পাঠানো ঠিক হয়নি। এই নির্দেশে স্থগিতাদেশ হোক। বিচারপতিরা লিখিত নির্দেশে বলেন, বিচারের প্রক্রিয়ায় এই ধরনের নির্দেশ দেওয়া যথাযথ নয়। বিশেষ করে বিচারবিভাগের শৃঙ্খলার কথা মাথায় রেখে এই নির্দেশ পাঠানো ঠিক হয়নি। এই নির্দেশ স্থগিত থাকবে। 
কলকাতা হাইকোর্টে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত ও ধৃত কুন্তল ঘোষ অভিযোগ করেছিলেন ইডি তাঁকে চাপ দিচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির নাম বলতে। ঘটনাচক্রে ঠিক তার কয়েকদিন আগেই এক জনসভায় অভিষেক একই অভিযোগ তুলে বলেছিলেন, দুর্নীতিকাণ্ডে ধৃতদের তাঁর নাম বলার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ইডি-কে বলেন, কুন্তল ঘোষ অভিষেক ব্যানার্জির কথা থেকেই সূত্র পেয়েছেন কিনা, তা খতিয়ে দেখতে উভয়কে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা যেতে পারে। এই নির্দেশের বিরুদ্ধেই অভিষেক ব্যানার্জি সুপ্রিম কোর্টে যান। প্রথম শুনানিতে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত জেরার ওপরে স্থগিতাদেশ পান। ২৪ এপ্রিল অভিষেক ব্যানার্জির আইনজীবী বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের কয়েক মাস আগে দেওয়া একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাক্ষাৎকারের বয়ান জমা দেন। তিনি অভিযোগ করেন, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এই সাক্ষাৎকারে বোঝা যাচ্ছে তাঁর পক্ষপাত রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় এবং পি এস নরসিমার বেঞ্চ কলকাতা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দেন বিচারপতি ওই সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কিনা, তা হলফনামা দিয়ে জানাতে। সেদিনই প্রধান বিচারপতি মৌখিক পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, সাক্ষাৎকার দেওয়া বিচারপতির কাজ নয়। 
শুক্রবার দুই বিচারপতির বেঞ্চ ওই সাক্ষাৎকারের বয়ান বা অনুবাদ বিবেচনা করেন। বিচারপতি চন্দ্রচূড় রায় দেন। তিনি বলেন, এই আদালতের নির্দেশক্রমে রেজিস্ট্রি হলফনামা পেশ করেছে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় যে নোট দিয়েছেন তা আমরা বিবেচনা করেছি। কলকাতা হাইকোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতিকে আমরা নির্দেশ দিচ্ছি এই মামলার বকেয়া প্রক্রিয়া অন্য কোনও বিচারপতিকে দিতে। যে বিচারপতিকে এই দায়িত্ব দেওয়া হবে তিনি কোনও আবেদন গ্রহণ করবেন কিনা সেই স্বাধীনতা তাঁর থাকবে। যদি কেউ কোনও আবেদন করতে চান তাহলে বিচারপতি তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। 
এই রায় দেবার পরেই সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা বলেন, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রায় গেলে বিচারপতিদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের আগেও একজন বিচারপতি ছিলেন। কিছু লোক পেপারওয়েট, চটি নিয়ে ঢুকেছিল। পোস্টার টাঙানো হয়েছিল। বিচারব্যবস্থার নৈতিক মনোবলের বিরুদ্ধে যায় এইসব ঘটনা। এরা আদালত কক্ষে যায়, বিচারপতিদের গালিগালাজ করে। শীর্ষ আদালতের এমন কিছু বলা উচিত যাতে বিচারপতিদের মনোবলে খারাপ প্রভাব না পড়ে।  
প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় তখন বলেন, স্পষ্ট করে একটা কথা বলে রাখা উচিত। বিচারপতিদের কঠিন কাজ করতে হয়। এই মামলার দায়িত্ব অন্য কাউকে দেবার কথা বলা হচ্ছে একটিমাত্র কারণে— ওই সাক্ষাৎকারের বয়ানের জন্য। অন্য কোনও কারণ নেই। যেন কেউ জনমসমক্ষে বলতে না পারে যে ওই বিচারপতি পক্ষপাতদুষ্ট। কোনও বিচারপতিকে হুমকি দেওয়া যায় না। প্রধান বিচারপতি হিসাবে বলতে পারি তেমন কোনও ঘটনা যদি আমার চোখে পড়ে তাহলে প্রশাসনিক পদ্ধতিতে ব্যবস্থা নেব। কিন্তু সাক্ষাৎকারের বয়ান শীর্ষ আদালতের রায়ের ন্যায্যতা প্রমাণ করেছে। 
শীর্ষ আদালতের রায়ে ইংরেজিতে ‘ইন দি কেস’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। কুন্তল ঘোষ সংক্রান্ত যে মামলাটি কলকাতা হাইকোর্টে রয়েছে সেটিই এর ফলে উল্লিখিত। এই মামলা প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগেরও ১২টি মামলা একসঙ্গেই চলছে। অন্য কোনও মামলায় বিচারপতি পরিবর্তনের কথা শীর্ষ আদালত বলেনি। 
এই রায়ের কয়েক ঘণ্টা পরেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এক নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টের সেক্রেটারি জেনারেলকে বলেন, স্বচ্ছতার স্বার্থে আমার সাক্ষাৎকারের যে সরকারি অনুবাদ শীর্ষ আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে, এবং রেজিস্ট্রার জেনারেল যে হলফনামা পেশ করেছেন শুক্রবার মধ্যরাতের মধ্যেই তা আমাকে জমা দিতে হবে। দুই সেট অরিজিনাল হাতে পাওয়ার জন্য আমি রাত সওয়া বারোটা পর্যন্ত চেম্বারে থাকব। বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর নির্দেশে বলেছেন, যেহেতু রায় ঘোষিত হয়ে গেছে তাই ওই দুই নথি আদালতের রেকর্ডে পরিণত হয়েছে। সুতরাং সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতিদের সামনে পেশ করা ওই দুই নথি আমার সামনে পেশ করা যায়। কিন্তু এই নির্দেশকে মান্যতা দেয়নি সুপ্রিম কোর্ট। 

Comments :0

Login to leave a comment