হরিয়ানা পুলিশের হামলায় প্রাণ হারালেন এক তরুণ কৃষক। শুভ করণ সিং নামের ২৪ বছর বয়সি তরতাজা ওই কৃষকের মাথায় আঘাত লেগেছিল পাঞ্জাব-হরিয়ানা সীমান্তের খানাউরিতে। পুলিশের ছোঁড়া রবার বুলেট সরাসরি এসে আঘাত করে তাঁর মাথায়। আন্দোলনরত কৃষক নেতৃত্বের আহ্বানে বুধবার তাঁরা দিল্লি অভিমুখে যাত্রা শুরু করতেই পুলিশের সঙ্গে ধুন্ধুমার সংঘর্ষ বেঁধে যায়। কাঁদানে গ্যাস, রবার বুলেট, জল কামান নিয়ে পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে কৃষকদের ওপর। ওই যুবক কৃষকের মৃত্যুর পাশাপাশি এদিনের পুলিশি নিপীড়নে জখম হয়েছেন ১৬০ জনেরও বেশি কৃষক। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে আন্দোলনরত কৃষক নেতৃত্বকে এদিন ফের বৈঠকে বসার আহ্বান জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রী অর্জুন মু্ণ্ডা।
স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) আইনি স্বীকৃতি সহ এক গুচ্ছ দাবিতে ‘দিল্লি চলো’র ডাক দিয়েছিল কয়েকটি কৃষক সংগঠন। পাঞ্জাব থেকে তাঁরা দিল্লি অভিমুখে যাত্রা শুরু করলেও হরিয়ানা সীমান্তের শম্ভু এবং খানাউরিতে তাঁদের আটকে দেওয়া হয়। পাহারাদার হিসাবে মোতায়েন করা হয় আধা সামরিক বাহিনীকে। ফলে ওখানেই ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ঘাঁটি গেড়ে রয়েছেন কৃষকরা। দুই সীমান্ত মিলিয়ে শিবিরে রয়েছেন দশ হাজারেরও বেশি কৃষক। মাঝে তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সঙ্গে চার দফা বৈঠক হলেও কোনও সমাধান সূত্র মেলেনি। সরকারের তরফে নানা ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হলেও কৃষকরা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ফলে তাঁরা ফের ‘দিল্লি চলো’র সিদ্ধান্তে অনড় অবস্থান নেন। কেন্দ্রের প্রস্তাবকে সারাসরি খারিজ করে দিয়ে তাঁরা এদিন দিল্লি অভিমুখে অভিযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই হরিয়ানার বিজেপি জোট সরকারের পুলিশ যাবতীয় প্রতিরোধী সরঞ্জাম নিয়ে আক্রমণ করে আন্দোলনরত কৃষকদের। নজরদারির জন্য আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল ড্রোন ক্যামেরা। কৃষকদের আটকাতে বহুস্তরীয় ব্যারিকেড গড়ে তুলেছিল হরিয়ানা পুলিশ। অন্যদিকে কৃষকরাও বুলডোজার, মাটি কাটার যন্ত্র (এক্সকাভেটর) নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন শম্ভু ও খানাউরি দুই সীমান্ত অঞ্চলে। এছাড়াও ট্রাক্টর, মিনি ভ্যান, পিক আপ ভ্যান ছিল তাঁদের সঙ্গে। তবে কৃষকদের তরফ থেকে এদিনও কোনও প্ররোচনা দেওয়া হয়নি। তা সত্ত্বেও পুলিশ তাঁদের আটকাতে হামলা চালায় বলে অভিযোগ। বিষয়টিকে লঘু করতে পরে হরিয়ানা পুলিশের তরফে জানানো হয় যে, ওই সীমান্তে কর্তব্যরত অবস্থায় এদিন অসুস্থ হয়ে পড়েন দুই পুলিশকর্মী এবং তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।
দু’দিন চুপচাপ থাকার পর এদিন কৃষকরা ফের দিল্লি অভিমুখে যাত্রার উদ্যোগ নেন। শম্ভু এবং খানাউরি— দুই সীমান্তেই এদিন আন্দোলনরত কৃষকদের ছত্রভঙ্গ করতে প্রথমে কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে পুলিশ। কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া পর আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন কৃষকরা। তাঁরা ওদিক-ওদিক ছোটাছুটি শুরু করে দেন, পুলিশি ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করেন। শম্ভুর পাশাপাশি খানাউরি সীমান্তেও পুলিশ প্রথমে কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে। পরে রবার বুলেট ছুঁড়লে জখম হন অনেকেই। এঁদের মধ্যে শুভ করণও ছিলেন। জখম অবস্থায় তাঁকে পাতিয়ালা সিভিল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে মৃত্যু হয় পাঞ্জাবের ভাতিন্দা জেলার ভালো গ্রামের ওই যুবকের। তবে কৃষক নেতৃবৃন্দ আপাতত দিল্লি অভিমুখে যাত্রা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ওখানেই ফের অবস্থান শুরু করেন। আন্দোলনরত কৃষকদের কোনও ধরনের প্ররোচনায় পা না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। কৃষক নেতা জগজিৎ সিং দালেওয়াল তাঁদের বলেন, ‘‘আপনারা এই লড়াইয়ে জিততে চান না কি হারতে চান? তাহলে আপাতত থেমে থাকার কৌশল নিন। শান্তি বিঘ্নিত হোক, তা আমরা চাই না।’’ আরেক নেতা সরওয়ান পান্ধার সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘‘আপনারা আমাদের মেরে ফেলতে পারেন। তাও কৃষকদের দাবিদাওয়াকে দমিয়ে রাখবেন না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, তিনি এগিয়ে এসে এমএসপি নিয়ে আইনি স্বীকৃতির কথা ঘোষণা করুন। আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করে আন্দোলনরত কৃষকদের আটকে রাখা হয়েছে হরিয়ানা সীমান্তে। এভাবে চললে মানুষ আপনাদের ক্ষমা করবে না।’’ এরই সঙ্গে তিনি জানিয়ে দেন, ‘‘না আটকালে শান্তিপূর্ণভাবেই কৃষকরা দিল্লি গিয়ে প্রতিবাদ জানাবেন।’’ জানা গিয়েছে, দু’দিন তাঁরা ‘দিল্লি চলো’ অভিযান স্থগিত রাখছেন।
কেন্দ্রের তিন মন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে চণ্ডীগড়ে চার দফায় বৈঠক করেন। সর্বশেষ বৈঠকে তাঁরা কৃষকদের যে মূল দাবি সেই এমএসপি না মেনে অন্য ধরনের প্রস্তাব দেন। এছাড়া ঋণ মকুবের দাবি মানেননি। ফলে সরকারের দেওয়া প্রস্তাব খারিজ করে দেন তাঁরা। এদিন পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেওয়ায় অর্জুন মুণ্ডা ফের তাঁদের বৈঠক বসতে আহ্বান জানিয়েছেন। এক্স হ্যান্ডেলে তিনি লিখেছেন যে, এমএসপি, শস্য বৈচিত্র, খড়ের গোড়া পোড়ানোর মতো বিষয় নিয়ে কৃষক নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁরা ফের আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। এরপরেই তিনি তাঁদের শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানান।
বিজেপি সরকারের অধীনে হরিয়ানা পুলিশের ২৪ বছর বয়সী যুবক কিষাণ প্রতিবাদী শুভ করণ সিংকে নৃশংসভাবে হত্যার তীব্র নিন্দা করেছেন সিপিআই(এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের অন্নদাতাদের উপর পুলিশের গুলি চালানোর নির্দেশ কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা জানাই।’’
এদিকে, আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর হরিয়ানা পুলিশের নৃশংস আক্রমণের তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা (এসকেএম), সারা ভারত কিষান সভা (এআইকেএস)। একই সঙ্গে সরকার এবং বিজেপি নেতৃত্বকে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন বিকেইউ নেতা রাকেশ টিকায়েত। এসকেএম এবং এআইকেএস কৃষক হত্যা ও পুলিশি অত্যাচারের কড়া ভাষায় নিন্দা করে বলেছে যে, প্রধানমন্ত্রী ও প্রশাসন প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে আগ্রহী নন। ফলে কৃষক হত্যা এবং বর্তমান সঙ্কটের জন্য দায়ী তাঁরাই। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি পর্যালোচনায় একেএম’র ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি এবং সাধারণ পরিষদ বৈঠক বসবে বৃহস্পতিবার। ওই বৈঠকেই পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচির পরিকল্পনা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
এআইকেএস এদিন এক বিবৃতিতে কটাক্ষ করে বলেছে, এই হত্যা মোদী সরকারের ‘কৃষক দরদি’ অবস্থানকে আরও উন্মোচিত করে দিলো। হরিয়ানার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টার কৃষকদের শত্রু হিসাবে বিবেচনা করে তাঁদের বিরুদ্ধে বস্তুত যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। হরিয়ানা এবং কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বর্বরোচিত আচরণের বিরুদ্ধে সারা দেশে সমস্ত শাখাকে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে এআইকেএস।
আবার পাঞ্জাবের আন্দোলনরত কৃষকদের সমর্থনে এদিন পশ্চিম উত্তর প্রদেশ জুড়ে ট্রাক্টর মিছিল করেছে ভারতীয় কিষান ইউনিয়ন (টিকায়েত)। ওই ট্রাক্টর নিয়ে তারা বিভিন্ন জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে ধরনা অবস্থানও করে। রাকেশ টিকায়েত এমনও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, ওই কৃষকদের দিল্লি অভিযানে বাধা দিলে নির্বাচনের সময় কোনও শাসক দলের নেতাদের গ্রামে ঢুকতে দেবেন না কৃষকরা।
রাতের দিকে এসকেএম আরেকটি বিবৃতি দিয়ে কৃষক শুভ করণ সিংয়ের মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছে। এরই সঙ্গে সমস্ত সংগঠনের সব স্তরের মানুষকে ওই নিহত তরুণ কৃষকের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। এরই পাশাপাশি দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কৃষক সম্প্রদায় আন্দোলন থেকে একবিন্দু সরবে না উলটে তীব্রতা আরও বাড়ানো হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে কেন্দ্রকে।
প্রতিবাদে সরব হয়েছে সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলিও। তরুণ কৃষকের মৃত্যু এবং বহু কৃষক জখম হওয়ার ঘটনায় শোক জানিয়ে প্রতিবাদ হিসাবে শুক্রবার দেশ জুড়ে কালা দিবস পালনের ডাক দিয়েছে।
খেতমজুর ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এদিন এক বিবৃতিতে কেন্দ্রের কাছে উলটে প্রশ্ন করা হয়েছে যে, রাম রাজ্যে কি কৃষককে হত্যা করা হয়? এরই সঙ্গে তরুণ কৃষক শুভকরণ সিংয়ের পুলিশি হামলায় মৃত্যুতে শোক জানানো হয়েছে।
Comments :0