West Bengal Teacher Recruitment Scam

৬৫ ঘণ্টা জেরার শেষে ধৃত তৃণমূলের বিধায়ক

রাজ্য

West Bengal Teacher Recruitment Scam

নাকতলার বাড়িতে টানা ২৬ ঘণ্টা ধরে জেরা, তল্লাশি শেষে নিয়োগ দুর্নীতিতে ইডি’র হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি।
এবার ৬৫ ঘন্টা। শুক্রবার দুপুর বারোটা থেকে সোমবার ভোর পাঁচটা— মুর্শিদাবাদের আন্দির বাড়িতে আটকে রেখেই বিস্তর নাটক, জেরা, তল্লাশি শেষে সিবিআই-এর হাতে গ্রেপ্তার আরেক তৃণমূলী বিধায়ক, অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত জীবন কৃষ্ণ সাহা। অভিষেক ব্যানার্জি থেকে মমতা ব্যানার্জি, ফিরহাদ হাকিম একের পর এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার ছবি সামাজিক মাধ্যমে রয়েছে। ভোর ৪-৫০ মিনিটে গ্রেপ্তার। কুড়ি মিনিটের মধ্যেই সেখান থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তায় এদিনই সকালে কলকাতায় নিয়ে আসা হয় নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে ধৃত বড়ঞার তৃণমূলী বিধায়ক জীবন কৃষ্ণ সাহাকে। এদিন দুপুরেই তোলা হয় আলিপুর আদালতে। বিচারক চারদিনের সিবিআই হেপাজতের নির্দেশ দেন। রাতে নিজাম প্যালেসেই শুরু হয় ফের জেরা পর্ব।


আদালতে, সংবাদমাধ্যমের সামনে রীতিমত ‘আত্মবিশ্বাসী’ দেখিয়েছে ধৃত তৃণমূলী বিধায়ককে। সিবিআই-এর দাবি, ঠান্ডা মাথায় গোটা অপরাধের নেটওয়ার্ক চালিয়েছেন এই তৃণমূলী বিধায়ক। যদিও ৬৫ ঘণ্টা তাঁর নিজের বাড়িতেই জেরায় রক্ষণ ভেঙে গেছে শনিবার রাতেই। 
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্রের দাবি, বাইরে, আদালতে, মিডিয়ার সামনে কিংবা মোবাইল ফেলে, ডিজিটাল এভিডেন্স নষ্ট করার চেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রভাবশালী মহলকে কোনও ‘বার্তা’ দিতে চাইছেন এই তৃণমূলী বিধায়ক! সেই ‘বার্তা’র প্রতিফলনই কি মিলেছে এদিন নবান্ন থেকে মুখ্যমন্ত্রীর কথায়? হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থীর নথি, কোটি কোটি টাকার হিসাব মিলেছে যে বিধায়কের বাড়ি থেকে, গ্রেপ্তারির পরে কার্যত যেন তাঁকে আড়াল করেই মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, ‘তৃণমূল বিধায়কদের টার্গেট করা হচ্ছে, এটা একটা গেম প্ল্যান’।


যদিও ইতিমধ্যে তাঁর বাড়িতেই জেরা পর্বে সিবিআই-এর কাছে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ কেলেঙ্কারি ও গোরু পাচারকাণ্ডে দলেরই ১০ জন বিধায়ক ও একজন সাংসদের নাম জানিয়ে দিয়েছেন এই ধৃত তৃণমূলী বিধায়ক। সিবিআই সূত্রে জানা গেছে, শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া পাঁচটা মোবাইল, হার্ডডিস্ক, একাধিক মেমোরি কার্ড ও ছয়টি ব্যাগ থেকে যে নথিপত্র মিলেছে তাতে প্রাথমিকভাবে প্রায় ৩৪০০জন পরীক্ষার্থীর নাম, অ্যাডমিট কার্ড পাওয়া যায়। প্রাইমারি ও নবম দশম শ্রেণির শিক্ষক পদের। প্রার্থী পিছু ১২ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা। প্রায় ৫১০ কোটির মানি ট্রেলের হদিশ মেলে। যদিও সোমবার সিবিআই-এর একটি সূত্রে জানা গেছে এই ধৃত বিধায়ককে এখনও পর্যন্ত জেরা করে তল্লাশি থেকে কেলেঙ্কারির চেহারার যে ধারণা মিলেছে তা ৭০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।


নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে পার্থ চ্যাটার্জি, মানিক ভট্টাচার্যের পরে বড়ঞার এই বিধায়ক জীবন কৃষ্ণ সাহার গ্রেপ্তারি তদন্তের গতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। নিয়োগ দুর্নীতিতে গত জুলাই মাস থেকে এখনও পর্যন্ত ইডি ও সিবিআই দুই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাতে তিন তৃণমূল বিধায়ক সহ ২৪ জন গ্রেপ্তার হলো। গত ২২জুলাই গভীর রাতে নাকতলার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জিকে। সেই শুরু, তারপর নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত যত এগিয়েছে ততই সামনে এসেছে শাসক তৃণমূলের যোগ। গোটা দুর্নীতিতে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে শাসক তৃণমূল।


তবে এর আগে বাকি ২৩টা গ্রেপ্তারি অভিযানকেও ম্লান করে দিয়েছে গত শুক্রবার দুপুর থেকে টানা ৬৫ ঘণ্টার জেরা পর্বের নাটকীয়তা। 
কী ছিল না তাতে? জেরা পর্বেই উদ্ধার হওয়া মোবাইল ফোন সিবিআই হাতে পেয়ে যাওয়ার পরেও তাদের অসতর্কতার সুযোগে তা ছিনিয় নিয়ে বাইরে পাঁচিলের ওপারে নিজেদের জমিতেই পুকুর ও ঝোপঝাড়ের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দেন তৃণমূলী বিধায়ক। পাঁচিল টপকে মোবাইল পুকুরে ফেলে দেওয়ার ঘটনায় স্তম্ভিত গোয়েন্দা আধিকারিকরাও। এরপরেই শুরু হয় আরও জেরা। নিয়োগকাণ্ডেই ধৃত অয়ন শীল, তৃণমূলী শান্তনু ব্যানার্জির মোবাইলের মতো তাহলে কী জীবন কৃষ্ণ সাহার মোবাইলও সোনার খনি? কোন শীর্ষ সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী প্রভাবশালীর সঙ্গে কথোপকথন, টাকার হিসাব রয়েছে? নিয়োগের জন্য প্রার্থীদের সঙ্গে যাবতীয় টাকার ডিলের তথ্যও কি লুকিয়ে আছে সেখানে?


নিয়োগকাণ্ডের তদন্তে এই প্রথম ব্যবহৃত হলো জেসিবি-ও। শুক্রবার রাত থেকে পুকুরে শুরু হয় তল্লাশি। অবশেষে রবিবার সকালে উদ্ধার হলো একটি মোবাইল ফোন। এরপর জীবন কৃষ্ণ সাহাকে নিয়ে বাড়ির ছাদে ওঠেন সিবিআই আধিকারিকরা। কীভাবে মোবাইল ছুঁড়ে ফেলেছিলেন জীবন? ঘটনার পুনর্নিমাণও করা হয়। সোমবার সকালে জীবন সাহাকে গ্রেপ্তার করার ঘণ্টা পাঁচেক পরে পুকুরের ধারে খেজুর গাছের নিচ থেকে উদ্ধার হয় দ্বিতীয় ফোনটি। পুকুর থেকে যে ফোনটি উদ্ধার হয় সেটা প্লাস্টিকে মোড়া ছিল, তাতে সিবিআই সিজার লিস্টের স্ট্যাম্প মারা ছিল। সিবিআই-এর একটি সূত্রে জানা গেছে গত প্রায় তিনদিনের তল্লাশি ও জেরা পর্বে একসময় বাড়ির ভিতরে জোর করে ঢুকে পড়ে অভব্যতা করছিলেন জনা দশেক স্থানীয় তৃণমূলী নেতা, কর্মীরা। একটা সময়ের পরে সেই দশজনকে জীবন সাহার বাড়ির একটি ঘরেই আটকে রাখা হয়। পরে তাঁদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে দিয়েই পুকুরের জল তোলার পরে কাদা ঘাঁটতে নামানো হয়। পরে অঞ্চলের তৃণমূল সভাপতিও একশো দিনের কাজের কয়েকজনকে নিয়ে আসেন পুকুর থেকে মোবাইল উদ্ধারের কাজে, সিবিআই-এর নির্দেশেই। 

 


তবে তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে দ্বিতীয় যে ফোনটি এদিন সকালে উদ্ধার হয়েছে তা আসলে ডেড ফোন এবং তা অনেকদিন ধরেই। তবে তা লোপাট করতে এত মরিয়া চেষ্টা কেন? জানা গেছে, একাধিক মেমোরি কার্ড ছিল জীবন সাহার। তাতেই আসলে দুর্নীতির ‘সোনার খনির’ হদিশ রয়েছে। তা সাধারণ ভাবে ডেড ফোনেই রাখতেন বিধায়ক। তা জানতেন তাঁর স্ত্রীও। সিবিআই তল্লাশির সময় ভয়ে সেই মেমোরি কার্ড মোবাইল থেকে খুলে নিজের শোয়ার ঘরের সিদুঁরের কৌটায় রেখেছিলেন। তা আবার জানতেন না বিধায়ক। ঐ ডেড মোবাইল তাই সিবিআই-এর হাত থেকে বাঁচাত ফেলে দিয়েছিলেন জীবন সাহা। তবুও শেষরক্ষা হলো না।
জানা গেছে, পড়াশোনা শেষ করে প্রাথমিক স্কুলে পড়াতেন জীবন কৃষ্ণ সাহা। পরে চাকরি পান হাইস্কুলে। ২০১৪ সালের পর থেকে হাত পাকান চাকরির দুর্নীতি চক্রে। ভুয়ো প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেটের চক্রও গড়ে তুলেছিল জীবন কৃষ্ণ সাহা। এই তৃণমূলের বিধায়কের অন্যতম বিশ্বস্ত এজেন্ট হিসাবে কাজ করত বড়ঞা বিধানসভা এলাকার বড়ঞা গ্রামের বাসিন্দা, দাপুটে তৃণমূল কর্মী কৌশিক ঘোষ। এই কৌশিক ঘোষকে গত ফেব্রুয়ারিতেই গ্রেপ্তার করেছিল সিবিআই। কৌশিক ঘোষের নাম মেলে অভিষেক ব্যানার্জির ‘আশীর্বাদে’ যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক বনে যাওয়া ধৃত কুন্তল ঘোষকে জেরা করে। সবই একটি চক্র হিসাবে কাজ করেছে। সেই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেই মানিক ভট্টাচার্যেরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল ধৃত বিধায়ক।

Comments :0

Login to leave a comment