TMC MLA Arrested

জীবনের চাকরি বিক্রি কেড়ে নিয়েছে বাবু, আব্দুরদের প্রাণ

রাজ্য

TMC MLA Arrested

মুখ্যমন্ত্রী পরোক্ষে দাঁড়িয়েছেন দুর্নীতিগ্রস্ত, হাজার হাজার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি বানানো তাঁর বিধায়ক পুত্রের পক্ষে। মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোরও ঘনিষ্ঠ তাঁর পুত্র, জানেন তিনিও।
তবুও একজন বাবা হয়েও নিজের পুত্রের এমন কাণ্ডকারখানার পক্ষে দাঁড়ানো তো দূরের কথা প্রকাশ্যেই সোচ্চার হয়েছেন ছেলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে!
শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে সোমবার সকালে সিবিআই গ্রেপ্তার করেছে তৃণমূল বিধায়ক জীবন কৃষ্ণ সাহাকে। বর্তমানে তাঁর বাবা থাকেন বীরভূমের সাঁইথিয়া পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের লাউতোরে। অভিযোগ, ছেলের অত্যাচারেই সাঁইথিয়া পালিয়ে আসেন বিশ্বনাথ সাহা। কিন্তু তাতেও ছেলের অত্যাচার থেকে রেহাই পাননি তিনি। 


প্রৌঢ় বিশ্বনাথ সাহা এদিন সংবাদমাধ্যমের সামনেই বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে ছেলের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। তারপর ও আমার ব্যবসায় অনেক ক্ষতি করেছে। ব্যবসা বন্ধের হুমকি দিয়ে গিয়েছিল। মিড ডে মিলের একটি চাল ডাল সরবরাহের দায়িত্ব বিডিও অফিসের মাধ্যমে পেয়েছিলাম। কিন্তু ছেলে মোটা টাকা ঘুষ নিয়ে আমার সেই অর্ডার বাতিল করিয়েছে। এমনকি সাঁইথিয়ায় এসে আমাকে মারধর করে গিয়েছিল। জেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে গিয়েছিল দিন সাতেক আগে’। 
জানা গিয়েছে, বিশ্বনাথ সাহার জন্মভিটা মুর্শিদাবাদের আন্দি গ্রামে। তিনি প্রথম বিয়ে করেন বেলারানি সাহাকে। প্রথম পক্ষের দুই মেয়ে, এক ছেলে। বিশ্বনাথ সাহা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন গায়ত্রী সাহাকে। এনিয়ে অশান্তি শুরু হওয়ায় দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে মুর্শিদাবাদের আন্দির পাট চুকিয়ে সাঁইথিয়া চলে আসেন। সেখানেই রাইস মিল করে ব্যবসা শুরু করেন। আন্দির বাড়িতে জীবনকৃষ্ণ সাহা তার মা বেলারানি সাহা এবং দুই বোনকে সঙ্গে নিয়ে থাকতেন। তাঁর বোনও এদিন তীব্র ক্ষোভ উগরে দিয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে বলেছেন, ‘ঐ লোকটা আমার দাদা হয় তা ভাবতে ঘেন্না হচ্ছে, লজ্জা লাগছে পরিচয় দিতে’। 


২০২১ সালে শারদোৎসবের মধ্যেই সপ্তমীর সকালে বড়ঞার বড্ডা গ্রামের বাড়িতে ঘর থেকে উদ্ধার হয় বাবু দলুইয়ের দেহ। এক টুকরো কাগজে বাবু লিখেছিলেন, ‘‘আমি, বাবু দলুই, বিদায় নিচ্ছি। আমাদের সমাজ ও রাজ্য খুব খারাপ’’। রাজ্যে নিয়োগ নিয়ে সরকারি প্রতারণায় কার্যত হতাশ হয়ে পড়েছিলেন মেধাবী চাকরিপ্রার্থী বাবু দলুই।   
নিজের উদ্যোগেই দিনমজুরের কাজ করে পড়াশোনা করেছিল বাবু। কিন্তু এই জীবন সাহাদের নিয়োগ দুর্নীতিতে পিএসসি’র রেজাল্ট বাতিল হয়ে যাওয়ার পরেই হতাশ হয়ে পড়েন তিনি।  


বাবু মাধ্যমিকে পেয়েছিলেন ৭৮% , উচ্চ মাধ্যমিকে পেয়েছিলেন  ৭৫%। দিনমজুরি করে, ডিএলএড পাশ করেন। পিএসসি ক্লার্কশিপ এর ফাইনাল তালিকায় নাম ছিল বাবু দলুইয়ের। টাকার বিনিময়ে জীবন সাহাদের চাকরি বিক্রির খেলায় বাতিল হয়ে যায় সেই তালিকা। পরের লিস্টে বাবু দলুইয়ের নাম ছিল অনেক পিছনে। কীভাবে ঘটল এই কাণ্ড ? উত্তর পরিষ্কার সকলের কাছেই। তবে দুর্নীতি মেনে নিতে না পেরেই শেষ পর্যন্ত অসহায়ভাবে আত্মঘাতী হয়েছিল বাবু দলুই। 
বাবু দলুইয়ের সহপাঠী উত্তম দাসের কথায়, জীবন কৃষ্ণ সাহার মতো মানুষের জন্যই আমরা আমাদের বন্ধুকে হারিয়েছিলাম। আমরা চাইছি যারা চাকরি নিয়ে দুর্নীতি করছে, তারা সকলেই শাস্তি পাক।
‘জীবন আমাদের জেরবারই’। বিধায়ক গ্রেপ্তারির পরে পর মন হালকা হলেও লাভ কিছু হবে ? সংশয় নিয়েই বলছেন বড়ঞার সেলিনা খাতুন, প্রকাশ মণ্ডলরা। টেট দিয়েছিলেন। ইন্টারভিউও দিয়েছিলেন। হয়নি চাকরি। শুধুই জোটে ওয়েটিং লিস্ট। চাকরি পেয়েছিল জীবন কৃষ্ণ সাহার স্ত্রী, শ্যালকরা। আর চাকরি পেয়েছিলেন জীবন কৃষ্ণ সাহার লিস্টে থাকা প্রার্থীরা। তারপর বিধায়ক হয়েছেন সেই জীবনই। 


চাকরি বিক্রির চক্রের প্রতারণায় ২০২২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর চাষের জমিতে বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হয়েছিলেন লালগোলার পাইকপাড়ার সারপাখিয়ার বাসিন্দা আব্দুর রহমানও । পরে উদ্ধার হয় সুইসাইড নোট। সেই নোটেই ওই যুবক জানিয়েছিলেন, এক দালালকে চাকরির জন্য প্রায় সাত লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু হয়নি চাকরি, সেই টাকা ফেরত দেয়নি ওই দালাল। টাকা চাইতে গেলে হুমকিও দেওয়া হয়। অবসাদে আত্মঘাতী হয়েছিলেন আব্দুর রহমান। জীবন সাহার গ্রেপ্তারি শুধু নয়, বিচার হোক চাকরি বিক্রির চক্রের সাথে জড়িত সব নেতাদের। চাইছেন আব্দুর রহমানের দাদা রমজান সেখ। ‘‘চাকরি দুর্নীতির ভয়ঙ্কর চক্রের কারণেই আমরা ভাইকে হারিয়েছি। নেতা, মন্ত্রী যেই হোক, নিয়োগ দুর্নীতির সাথে যুক্ত সকলের শাস্তি হোক। এটাই আমরা চাইছি’’।
শুধু কান্দি, বড়ঞা নয়, মুর্শিদাবাদের আনাচে কানাচে কান পাতলেই শোনা যাবে জীবনের ব্যবসার বৃত্তান্ত। টাকা দিলেই নাম উঠত জীবনের এক্সেল লিস্টে। তবেই নাকি সরকারি  চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। এই ব্যবসা জীবন চালাচ্ছেন ২০১১’র শেষদিক থেকেই। ২০১৬ সালের পর আরও পাকাপোক্ত হয় ব্যবস্থা। 


বিধায়ক হওয়ার অনেক আগে থেকে আন্দিতে বাবার রেশন দোকানের গোডাউন দখল করেই নিজের অফিস খুলেছেন জীবন কৃষ্ণ সাহা। সেই অফিস থেকেই চলত দুর্নীতির চক্র। চাকরি বিক্রির পাশাপাশি গায়ের জোর খাটিয়ে জমি দখলেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন বিধায়ক জীবন কৃষ্ণ সাহা। কুণ্ডলের বাসিন্দা বাসুদেব ঘোষের কথায়, জীবনের কাছে টাকা দিলেই বড়ঞায় যে কোনও চাষের জমি যে কারো নামে রেকর্ড, রেজিস্ট্রি করা যেতো। জীবনের গ্রেপ্তারিতে হাঁফ ছাড়ছে বড়ঞা।

Comments :0

Login to leave a comment