ভাস্কর দাশগুপ্ত
যার জন্য এত আয়োজন, এত ব্যস্ততা, এত সতর্কতা সেই বাঘিনী জিনাতের হদিস মিলল না বৃহস্পতিবারও। জঙ্গলের মধ্যে ফাঁদ পেতে সারাদিন বাঘিনীর অপেক্ষায় বসে থাকলো বন দপ্তরের কর্মীরা। গত চারদিনের মতো এদিনও খালি হাতেই ফিরল বনকর্মীরা। গত কয়েকদিন ধরে ভাড়ারিয়া পাহাড়ের জঙ্গলের যে জায়গাটায় কিছুক্ষণের জন্য বাঘিনীর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটা নাগাদ সেই জায়গাটায় চারটা দলে ভাগ হয়ে শতাধিক বন কর্মীদের ট্রেকিং টীম সেখানে পৌঁছায়। পাহাড়ের খাঁজে অর্ধেক খাওয়া দুটা ছাগলের দেহাবশেষ পাওয়া যায়। যে জায়গাটাতে বাঘিনীর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল সেখানে গিয়েও বিফল মনোরথ হয়ে ফিরতে হয় ট্রেকিং টিমকে। পাঁচটা নাগাদ পাহাড়ের জঙ্গল থেকে ট্রেকিং টিম নিচে নেমে আসে। বনদপ্তরের দাবি মানুষের অস্তিত্বের টের পেয়েই হয়তো ওই বাঘিনী হয়তো কোন নিরাপদ গুহায় আশ্রয় নিয়েছে। দিনভর ছটাট্রাকুলাইজার টিম ঘুরে বেড়িয়েও বাঘিনীর সন্ধান পায়নি।
একটার পর একটা আতঙ্কের রাত কাটাচ্ছেন জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের বাসিন্দারা। বন্ধ হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জনজীবন। রাহামদা, পোপো, যমুনাগোড়া, লেদাশোল প্রভৃতি গ্রামের মানুষ চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। মানুষজনের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই তারা বলছেন, ‘‘ভয়,খুব ভয়ে আছি। পেটে টান পড়েছে এবার। কোথাও যেতে পারছি না। তাড়াতাড়ি ধরুক বনদপ্তর। এভাবে থাকতে আর ভালো লাগছে না। দিনের পর দিন মাইকিং, প্রচার। স্থানীয় মানুষজন দোকান বাজারেও যেতে পারছেন না। সন্ধ্যের অন্ধকার নামলেই গ্রামের রাস্তা একেবারে শুনশান। দুয়ারসিনি এবং টটকোতে বড়দিনের ছুটিতে যে সমস্ত পিকনিক দল আসে এ বছর বাঘিনীর আতঙ্কে তারাও সেভাবে আসেনি।’’
এই অঞ্চলের মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে জঙ্গল। জীবিকার প্রয়োজনেই মানুষকে নিত্যদিন জঙ্গলে যেতে হয়। কিন্তু গত রবিবার থেকে জঙ্গলে যাওয়া বন্ধ। গ্রামীণ হাট গুলোতেও ক্রেতা এবং বিক্রেতার সংখ্যা একেবারে কম। লেদাসোল গ্রামের মহিলাদের বক্তব্য তারা জঙ্গল থেকে শাল পাতা সংগ্রহ করে এনে সেটা সেলাই করে বাজারে বিক্রি করেন। এখন এই শালপাতা আনাও বন্ধ। এভাবে যে কতদিন পেটে কিল মেরে থাকতে হবে তা বুঝে উঠতে পারছেন না স্থানীয় মানুষজন।
রেডিও কলার লাগানো বাঘিনীর হদিস পেতে বন কর্মীরা নাকানিচোবানি খাচ্ছেন দিনভোর। পুরুলিয়া বন বিভাগের কর্মীদের সাথে সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের প্রতিনিধি এবং সুন্দরবন অঞ্চলের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বনকর্মীরাও চষে বেড়াচ্ছেন পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। শুধু বাঘিনীকে বাগে আনাই নয় পাশাপাশি স্থানীয় মানুষজনকে সুরক্ষিত রাখার বিষয়টি ও ভাবতে হচ্ছে। রেডিও কলারে মাঝেমধ্যে বাঘের হদিশ পেলেও বাকি সময়টা অনুমানের উপর ভিত্তি করে টোপ, খাঁচার পাশে সতর্ক নজরদারি রাখা হচ্ছে। বন কর্মীদের টিমের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার দিনভোর হাই ফ্রিকুয়েন্সি এন্টেনা দিয়ে বাঘিনীর গলায় ঝোলানো রেডিও কলারের অবস্থান সার্চ করে বাঘের গতিবিধি জানার চেষ্টা করলেন বনকর্মীরা। জঙ্গলে বাড়ানো হলো ফাঁদের সংখ্যাও। টোপ হিসেবে নিয়ে আসা হলো দেশি ছাগল। তবুও ফাঁদ মুখী হলো না বাঘিনী। আবার সেই ভোরের অপেক্ষা।
ছবিগুলি তুলেছেন ভাস্কর দাশগুপ্ত।
Comments :0