Tripura 'commandante'

শেষ প্রহরেই প্রথম সভা ‘কমানদান্তের’

জাতীয়

যুব কর্মীরা ভালোবেসে নিয়ে এসেছে ‘চে’ টুপি। তারা খচিত সেই টুপি পরে নিলেন ‘কমানদান্তে’। ত্রিপুরার এবারের ভোটে লাল ঝান্ডার সেনাপতি শেষ বেলায় এসেছেন প্রচারে। সোমবার সাব্রুম মেলার মাঠে নির্বাচনী সমাবেশ শুরু হতে তখনও কিছু বাকি। সিপিআই (এম) রাজ্য সম্পাদক জীতেন্দ্র চৌধুরি বললেন, নিজের কেন্দ্রে আসার সময় করতে পারিনি। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতে হয়েছে বেশি। এটাই প্রথম জনসভা। পার্টিকর্মীরাই গোটা কেন্দ্রের বাড়ি বাড়ি প্রচার করেছেন। সোমবার দুপুরে ভিড়ে ঠাসা পার্টি দপ্তরে অধিকাংশই যুব কর্মী। প্রবল উদ্দীপনায় তাঁরা বললেন, উনি বাকি রাজ্যে সময় দিন বিজেপি’কে উৎখাত করতে। আমরা এখানে দেখে নেব। ওনার ‘পাশের’ চিন্তা নাই। 
সেনাপতি যদিও গোটা রাজ্যের ‘পাশ’ নিয়েই ব্যস্ত। রাজ্য সম্পাদক হিসাবে স্বাভাবিকভাবেই পার্টির নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে সবটা খেয়াল রাখতে হচ্ছে। তার উপরে নিজে প্রার্থী। এর পাশাপাশি বিবিধ জটিল পরিস্থিতি সামলাতে হচ্ছে। কংগ্রেসের সঙ্গে প্রাথমিক জটিলতা কাটিয়ে সম্পূর্ণ সমঝোতা। আবার তিপ্রা মথার বিষয়টিকেও ‘ডিল’ করতে হচ্ছে। উপজাতিদের আবেগকে সংবেদনশীলভাবে বিবেচনার পাশাপাশি পাহাড়ের মাটি কোনোভাবেই ছেড়ে দেওয়া হয়নি। গত বিধানসভার ভোট বা এডিসি ভোটের বিপর্যয়ের পরে, এখনও মথাকে ঘিরে প্রবল আবেগের মধ্যেও ত্রিপুরার পাহাড়-জঙ্গলে বসবাসকারী উপজাতিদের থেকে পুনরায় সমর্থন আদায়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করা হচ্ছে। সেই কাজেও স্বাভাবিকভাবেই অনেকখানি নেতৃত্ব দিতে হয়েছে তাঁকে। ফলে নিজের কেন্দ্রে আসতে দেরি।
বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে গুরুত্ব পেয়েছিল সাব্রুম। এই মহকুমা, এই কেন্দ্রের গা ঘেঁষে বয়ে চলে ফেনি। নদীটাই সীমান্ত বাংলাদেশের সঙ্গে। ওপারে চট্টগ্রাম। নদীর উপর সেতু বানানোর কাজ শুরু হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার থাকার সময়ে। মানিক সরকার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, যা কেন্দ্রের মনমোহন সিং সরকার অনুমোদন করেছিল। সেতু পেরিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ব্যবসা বাণিজ্য এবং শিল্প বিকাশের পরিকল্পনা করা হয়েছিল ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ত্রিপুরার। সেই মৈত্রী সেতু তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে। সেতুর কাছেই শিল্পের জন্য পরিকাঠামোও তৈরির কাজও পড়ে রয়েছে পাঁচ বছর আগের ছেড়ে যাওয়া অবস্থায়। শিল্প-বাণিজ্যের সম্ভাবনাকে ঘিরে সাব্রুম তথা গোটা ত্রিপুরার তরুণ-যুবরা এক সময়ে যে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন তার সমাধি ঘটেছে। কিন্তু কথা তো ছিল ডবল ইঞ্জিনে দৌড়বে ত্রিপুরার বিকাশ। 
বিকাশ হয়েছে তবে ব্যক্তির। সাব্রুমের বিধায়ক এবং এবারেও বিজেপি প্রার্থী শংকর রায় কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে স্থানীয়দের বিস্তর অভিযোগ। ‘আমার অনুমতি ছাড়া সাব্রুমের একটা পাতাও নড়ে না’ প্রকাশ্যে এমন কথা বলে বেড়ানো প্রার্থীকে নিয়ে ক্ষোভ গোপন নেই এলাকায়। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ত্রিপুরায় ভাষণ দিতে এসে বলছেন, বিজেপি’র বিরুদ্ধে কোনও দুর্নীতির অভিযোগ নেই। সাব্রুমে এলে তাঁরা চমৎকৃত হতেন দলের বিধায়কের লুটের পদ্ধতি দেখে। লুটের উদ্ভাবনী পদ্ধতিতে মোদীর বন্ধু আদানির থেকে ত্রিপুরার প্রান্তিক এলাকার বিধায়ক কোনও অংশে কম যান না। তাঁর বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ জমি হাতানোর। কোথায় সড়ক চওড়া হবে, কোথায় অন্য সরকারি প্রকল্প হবে এসব খবর আগেই তাঁর কাছে আসে। সেই মোতাবেক সরকারি খাস জমিকে ব্যক্তি মালিকানায় দিয়ে দেওয়া হয়। তারপর সরকারি বিজ্ঞপ্তি হলে, অধিগ্রহণের নোটিস দিলে সেই জমিই বহুগুণ বেশি দামে সরকারকে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার সম্পদ করেছেন। আর কাজের নমুনা ছড়িয়ে আছে চারপাশে। বামফ্রন্ট্রের সময়ের সাব্রুম হাসপাতাল তিন বার ‘উদ্বোধন’ করা হয়েছে। এখন গেট বানানো হচ্ছে, আরও একবার উদ্বোধন হবে বলে। মার্কেট কমপ্লেক্সও তৈরি হয়ে গিয়েছিল রঙ আর আলো লাগিয়ে বিজেপি সরকার এসে উদ্বোধন করেছে। যে মেলার মাঠে সমাবেশ, তার স্টেডিয়ামের কাজও বামফ্রন্ট প্রস্তুত করে গেছিল। এখন অটলবিহারী বাজপেয়ীর নামে করে দিয়েছে। 
সেই সমাবেশে জনঢল নামলো সোমবার দুপুরে। কাতারে কাতারে উপজাতি-বাঙালি মহিলা। দলে দলে যুবকরা এলেন নাচতে-গাইতে। ত্রিপুরায় ভোট উৎসবের পরিচিত ছবি অনেকদিন পরে ফিরল সাব্রুমে। সে কারণেই সম্ভবত এদিনই প্রথম পথে নেমে এলেন তুলনায় গোপনে থাকা শহরবাসীও। বামপন্থী কর্মীদের সঙ্গেই দলীয় পতাকা নিয়ে মিছিলে এসেছেন কংগ্রেস কর্মীরাও। স্থানীয় কর্মীরা জানালেন, এসেছেন তিপ্রা মথার কর্মীরাও। উল্লেখ্য, ২৪ শতাংশ উপজাতি ভোটার থাকলেও এই কেন্দ্রে প্রার্থী দেয়নি তিপ্রা মথা। 
মানুষের ভিড়ে ছোট হয়ে গেল ফেনির তীরের মেলার মাঠ। গ্যালারি আশপাশের বাজার দোকান, টিলা-রাস্তায় শুধু মানুষ আর মানুষ। সমাবেশের প্রধান বক্তা মানিক সরকার বক্তব্য রাখতে উঠে তীব্র সমালোচনায় বিঁধলেন বিজেপি সরকারকে। গত ভোটে মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করেছে বিজেপি। মোদী-শাহরা এইভাবে মানুষকে ঠকিয়েছেন। এদিনই ফের আগরতলায় সমাবেশ ছিল প্রধানমন্ত্রী মোদীর। মানিক সরকার তাঁর কাছে প্রশ্ন তোলেন, যুবকদের কাজ চাকরি নিয়ে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নীরব কেন? একই কথা তুললেন জীতেন্দ্র চৌধুরিও। কিভাবে সাব্রুমের বিকাশের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, যা থেকে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির বিপুল সম্ভাবনা ছিল। পাঁচ বছর সরকার চালিয়েই বিজেপি তা বরবাদ করেছে তা উল্লেখ করেন তিনি। 
সভায় উপস্থিত ছিলেন কংগ্রসের নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা অজয় কুমার এবং দলের নেত্রী অলকা লাম্বা। তাঁরা সমাবেশে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে জীতেন্দ্র চৌধুরিকে রাজ্যের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে চিহ্নিত করেন। যদিও অধীর চৌধুরি সহ একাধিক কংগ্রেস নেতা এর আগেই জীতেন্দ্র চৌধুরিকেই বামফ্রন্ট-কংগ্রেসের সরকার হলে মুখ্যমন্ত্রী বলে ঘোষণা করেছেন। তাও এদিনের ঘোষণায় ফের উদ্বেল হয়ে ওঠে ময়দান। সিপিআই(এম), বা বামফ্রন্ট মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে কোনও নাম ঘোষণা করেনি। কিন্তু ত্রিপুরা জুড়ে এটা প্রচারিত হয়ে গেছে, নতুন সরকার হলে জীতেন্দ্র চৌধুরি মুখ্যমন্ত্রী হবেন। সাব্রুমবাসীর কাছে যা বাড়তি আবেগ তৈরি করেছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment