Murshidabad Murder

ভোটের দিন নৃশংস মার, মৃত্যু হলো রিন্টু শেখের

রাজ্য

Murshidabad Murder

বুথের ১০০মিটারের মধ্যেই লোহার রড, লাঠি দিয়ে নৃশংসভাবে পেটানো হয়েছিল গত ৮জুলাই সকালে। ছিল না কেন্দ্রীয় বাহিনী, বুথে মোতায়েন ছিল মাত্র একজন পুলিশকর্মী। শাসক দলের বিধায়ক ও তাঁর পুত্রের মদতে চলে এই নৃশংস আক্রমণ।
এক সপ্তাহ ধরে কলকাতার এনআরএস হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন কমরেড রিন্টু শেখ (৪৩), মাথায় লোহার রডের গুরুতর আঘাত ছিল। অস্ত্রোপচারও হয়েছিল। অবশেষে রবিবার দুপুর দেড়টা নাগাদ এনআরএস হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন কমরেড রিন্টু শেখ। 
শাসক তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের হাত থেকে নিজের জন্মভিটের বুথ রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হলেন কমরেড রিন্টু শেখ। মুর্শিদাবাদ জেলায় এই নিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্বে সিপিআই(এম)’র দু’জন কর্মী, সংগঠক খুন হলেন তৃণমূলী দুষ্কৃতীদের হাতে। গত ৮ জুলাই ভোটের দিনই লালগোলায় ময়া ছাতিয়ানি প্রাইমারি স্কুলের বুথের বাইরে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা হামলা চালিয়ে খুন করেছিল সিপিআই(এম) কর্মী কমরেড রওশন মণ্ডলকে। রাজ্যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ভোটাধিকার রক্ষার লড়াইয়ে নির্বাচনী পর্বে গোটা রাজ্যে এই নিয়ে ৬জন সিপিআই(এম) কর্মী খুন হলেন।

কমরেড রিন্টু শেখ মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়া ব্লকের রায়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের নিয়ামতপুর গ্রামের বাসিন্দা। পরিযায়ী শ্রমিক। গ্রামে কাজ নেই। তাই পরিবারকে গ্রামে রেখেই চেন্নাই গিয়েছিলেন রাজমিস্ত্রির কাজে। ঈদের চারদিন আগে গ্রামে ফেরেন। একেবারে গরিব পরিবার। এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এদিন দুপুরে খবর আসার পরেই কান্নায় ভেঙে পড়ে শহীদ কমরেডের স্ত্রী জান্নাতন বিবি বলছিলেন, ‘কী অপরাধ ছিল আমার স্বামীর? ভোটে তো পাশ-ফেল আছেই। ওরা দিনদুপুরে পিটিয়ে মেরে দিল। আমি শাস্তি চাই ওদের। আমার সংসার শেষ করে দিল’। গোটা গ্রাম তখন ভেঙে পড়েছে কমরেড রিন্টু শেখের বাড়ির সামনে। এই নৃশংস খুনের ঘটনায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে ঘৃণা উগড়ে দিয়েছেন গোটা গ্রামের মানুষ।
ঠিক কী ঘটেছিল গত ৮ জুলাই, ভোটের দিন? হরিহরপাড়ার নিয়ামতপুর এসএসকে’তে দু’টি বুথ হয়েছিল। সেখানেই চলছিল ভোটগ্রহণ পর্ব। শাসক তৃণমূলের হুমকি উপেক্ষা করেই ভোটে শামিল হয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। এরপর সকাল দশটা নাগাদ বুথ লুটের উদ্দেশ্যেই নিয়ামতপুরে ঢোকে স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক নিয়ামত শেখ, তৃণমূল নেতা মীর আলমগীর পলাশ ও জেলা পরিষদের প্রার্থী বিধায়কপুত্র জিল্লার রহমান। বুথ থেকে ৬০০মিটার দূরেই কমরেড রিন্টু শেখের বাড়ি। ততক্ষণে বুথ জ্যাম শুরু করে দিয়েছে শাসক তৃণমূলের বাহিনী। বুথের সামনে যেতেই তৃণমূলী দুষ্কৃতীদের সঙ্গে বচসা বাধে রিন্টু শেখের। গ্রামের সিপিআই(এম)’র পরিচিত মুখ তিনি। তৃণমূলের বুথ লুটের চেষ্টায় বাধা দেন তিনি। তার আগে গ্রামে ততক্ষণে সিপিআই(এম)’র কর্মীদের মারধর শুরু করে দিয়েছে তৃণমূলী বাহিনী। বুথ লুটের চেষ্টায় বাধা দিতেই তৃণমূলী বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর ওপরে। লোহার রড, লাঠি দিয়ে বুথের তিনশো মিটারের মধ্যেই নির্বিচারে পেটানো শুরু হয় তাঁকে। বুথ রক্ষায় নিধিরাম সর্দার কেবল একজন পুলিশ কর্মী। তিনি স্বাভাবিক ভাবেই তখন দর্শক। রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়েন কমরেড রিন্টু শেখ। স্থানীয় গ্রামবাসী ও সিপিআই(এম) কর্মীরা ভোট চলাকালীনই তাঁকে কোনোমতে উদ্ধার করে প্রথমে বহরান প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান, সেখানে অবস্থার অবনতি হতে নিয়ে যাওয়া হয় বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি হওয়ায় এরপর সেখান থেকে তাঁকে ৮ তারিখেই নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়, এনআরএস হাসপাতালে। মাথায় গুরুতর চোট ছিল। অস্ত্রোপচারও হয়। শেষমেশ এদিন দুপুরে অসম লড়াইয়ে হার মানেন কমরেড রিন্টু শেখ।

এদিন দুপুরে দাদার মৃত্যুর খবর পেয়ে শোকে বাক্‌রুদ্ধ হয়ে পড়া ভাই জিনারুল ইসলাম বলছিলেন, ‘সেদিন তো ছাপ্পা ভোট চলছিল, ছাপ্পা মেরেই না হয় তোরা জিতেছিস। তা বলে খুন করে দিবি আমার দাদাকে? আমার আরেক ভাই লালটু শেখ, ওঁরও হাত ভেঙে দিয়েছে মেরে। আমাদের সবাইকে মেরেছে’। 
কিন্তু পরিকল্পনা করেই আক্রান্তদের বিরুদ্ধেই ভোটের দিন হরিহরপাড়া থানায় অভিযোগ দায়ের করে শাসক তৃণমূল। আক্রান্ত সিপিআই(এম) কর্মীরাই নাকি তৃণমূলের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়েছে। তৃণমূলের অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশও এফআইআর দায়ের করে। শহীদ কমরেড রিন্টু শেখের নামেই পুলিশ তড়িঘড়ি এফআইআর দায়ের করে রাখে। পুলিশ যখন এফআইআর দায়ের করছে রিন্টু শেখের বিরুদ্ধে, তখন তিনি বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজে রক্তাক্ত, সংজ্ঞাহীন অবস্থায়।

আর সেই ঘটনাকে হাতিয়ার করেই এদিন রিন্টু শেখের মৃত্যুর পরে তৃণমূলের দলদাসে পরিণত হওয়া পুলিশের তরফে বলা হয়, নিহতের বাড়ি থেকে তো কেউ কোনও অভিযোগ দায়ের করেনি। করা হলে দেখা যাবে ব্যাপারটা।
পালটা সিপিআই(এম) মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক জামির মোল্লা বলেন, পুলিশের কাছ থেকে এর থেকে বেশি আর কী বা আশা করা যায়? এক সপ্তাহ ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলেন রিন্টু শেখ। তাঁর বাড়ির লোকজন চিকিৎসা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তবে পরিবারের সদস্যরা এখন এফআইআর দায়ের করবেন। পুলিশ সেই এফআইআর-র ভিত্তিতে কতটা ব্যবস্থা নেয়, আমরাও দেখব। আমাদের স্পষ্ট অভিযোগ, বিধায়ক নিয়ামত শেখ, তাঁর ছেলে জিল্লার রহমান ও তৃণমূল নেতা আলমগীর পলাশ এই ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত, তাঁদের উপস্থিতিতে, তাঁদের মদতে এই ঘটনা ঘটেছে। এদিন বহরমপুরে সিপিআই(এম) জেলা দপ্তরে পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য রামচন্দ্র ডোম ও জামির মোল্লা সাংবাদিক বৈঠক করেন। সেখানেই জামির মোল্লা বলেন, নির্বাচন পর্বে গোটা মুর্শিদাবাদ জেলায় সন্ত্রাসের পরিস্থিতি তৈরি করেছে তৃণমূল, সঙ্গী পুলিশ। মোট ১২জনের মৃত্যু হয়েছে জেলায়। বুথ লুট রুখতে গিয়েই শহীদ হয়েছেন দু’জন সিপিআই(এম) কর্মী। এখনও চলছে সন্ত্রাস। অনেক মানুষ ঘরছাড়া।
রামচন্দ্র ডোম এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, গোটা রাজ্যের মত শাসক তৃণমূল ও পুলিশ শুধু ভোটের দিনই নয়, গণনার দিনও ভোট লুটের অভিযান চালিয়েছে। রাজ্যজুড়ে মৃত্যু মিছিল। দায়ী কে? দায়ী রাজ্য সরকার আর রাজ্য নির্বাচন কমিশন। এখনও মুর্শিদাবাদ জেলায় সন্ত্রাস চলছে। নির্বাচিত সদস্যদের ওপরেও এখন হামলা, হুমকি চলছে। ইসলামপুরের ঘুঘুপাড়ায় এখনও ৮০টি পরিবার ঘরছাড়া। পুলিশ প্রশাসন কোথায়? 

এদিন দুপুরে এনআরএস হাসপাতালে মৃত্যুর খবর পেয়েই আসেন সিপিআই(এম) বহরান এরিয়া কমিটির সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক সহ পার্টিকর্মীরা। রয়েছেন কমরেড রিন্টু শেখের পরিবারের সদস্যরাও। আব্দুর রাজ্জাক হাসপাতালে দাঁড়িয়েই সেদিনের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, নৃশংসভাবে মারা হয়েছিল রিন্টু শেখকে, বিধায়কের মদতেই। এদিন দুপুরে দেড়টা নাগাদ মৃত্যু হয় বলে হাসপাতালের তরফে জানানো হয়েছে। সোমবার মরদেহ হরিহরপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানা গেছে।

Comments :0

Login to leave a comment