Bharati Murmu

বল যার পায়ে মাঠ তার কথা শুনতে বাধ্য, ভারতীর মন্ত্র

রাজ্য খেলা ফিচার পাতা

মধুসূদন চ্যাটার্জি: বিষ্ণুপুর

‘‘মায়ের ছেঁড়া কাপড়গুলো একসঙ্গে করে শাড়ির পাড় দিয়ে মুড়ে বল করতাম। বাড়ির উঠানেই সেই কাপড়ের বল পায়ে পায়ে ঘুরত। বাবা, মা যাকেই সামনে পেতাম তাঁকে বলতাম একটু দূরে দাঁড়াও আমি শট মারব, ধরো। তাঁরা হাসতেন, বলতেন আমাদের বাড়ির ছেলে মেয়েরা কবে খেলেছে? তাও আবার মেয়ে। যতদিন গতরখাটার মতো জায়গায় আছি ততদিন যতটা পারিস পড়াশোনা কর, তারপর তো হয় শ্বশুড়বাড়িতে না হয় এখানে মাঠে কাজ করতে হবে।’’
বললেন ভারতী মুর্মু।
তবে এসব কথা শোনার সময় ছিল না তাঁর। একটাই আবদার দূরে যাও, বল পেটাবো তোমাকে ধরতে হবে। মেয়ের বায়না শুনে বাবা বিজয় বা মা সুমি মুর্মু খানিক দূরে দাঁড়াতেন। দূর থেকে ছুটে এসে সেই ন্যাকড়া, কানির বল পায়ের সব জোর দিয়ে পেটাতো ভারতী। কিন্তু সেটা আর উঠবে না, মাটিতে গড়িয়েই গোলকিপার হিসাবে দাঁড়ানো মা বা বাবার কাছে পৌঁছাতো। এরকমভাবে বেশ কয়েকবার চলত ভারতীর প্র্যাকটিস। এখন আর তার শট নেওয়া বল মাটিতে গড়ায় না, মাঠের সেন্টার পয়েন্ট থেকে ভারতীর মারা বল গোলকিপারের হাত ভেদ করে জালে ঢুকে যায়। রেফারির গোলের সঙ্কেতের বাঁশি তাঁর কানে এসে পৌঁছায়। 
ভারতী মুর্মু। বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর থানার এক তরুণী। এবছর তিনিই বাংলার মেয়েদের অনূর্ধ্ব ১৯এর ক্যাপ্টেন ছিল। পাঞ্জাবে দেশের সমস্ত রাজ্যের টিমের বিরুদ্ধে বাংলা খেলেছে। ভারতীর নেতৃত্বে ফাইনালে উঠেছিল বাংলা। ফাইনালে ঝাড়খণ্ডের কাছে বাংলা হেরে যায়। আফসোস ভারতীর। আফসোস একজন ক্যাপ্টেন ও একজন স্টপার পজিসনের খেলোয়াড় হিসাবে। ভারতী জানান,‘‘আর একটু মাথা খাটিয়ে খেললে বাংলার ঘরে চ্যাম্পিয়ান কাপ নিয়ে আসতে পারতাম। যাক অনেক কিছুই শিখেছি। আগামী দিনে এগুলো তো কাজে লাগবে। কত দারুণ দারুণ খেলোয়াড় দেখলাম, সবার সঙ্গে পরিচয় হলো। কি সুন্দর ব্যবহার সবার। খেলা বাদ দিয়েও তো এগুলো আমার কাছে বাড়তি পাওনা।’’
ভারতী মুর্মুর বাড়ি বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের বাঁকাদহ কামারপাড়ায়। তাঁর বাবা বিজয় মুর্মু এবং মা সুমি মুর্মু দু’জনেই খেতমজুর। নিজেদের যে কয়েক কাঠা জমি আছে তাতে সারা বছরের সংসার চালানোর খরচ ওঠে না। তাই চাষের সময় মাঠে আর অন্য সময় যেখানে যা গতর খাটার কাজ পান সেটাই করেন বলে জানান বিজয় মুর্মু। মোদ্দা কথা অত্যন্ত দরিদ্রতার ভেতর দিয়ে তাঁদের চলতে হয়। একদিন কাজে না গেলে সংসারে টান পড়বে। ঘটনা হলো এমনিতেই এখন আর মাঠে শিশু, কিশোর, যুবকদের খেলাধূলা করতে দেখা যায় না। ‘‘খেলার সময় হাতে মোবাইল নিয়ে সেখানে চোখ গেঁথে রাখাই হলো এখনকার দৃশ্য। সেখানে আমাদের এলাকার একটি কিশোরী বাংলার মেয়েদের ফুটবল দলে চান্স পাওয়া খালি নয়, ক্যাপ্টেন হওয়ার ঘটনায় আমরা আনন্দিত খুবই।’’ জানান এলাকার প্রবীণ শিক্ষক পদ্ম ঘোষ। 
ভারতী মুর্মুর কথায়, পাড়ার কিছু ছেলেকে দেখতাম বিকাল হলে মাঝে মাঝে ফুটবল খেলত। তবে শীতের সময় ক্রিকেটটা বেশি ছিল। ফুটবল খেলা তো আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। ছোট বেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আমাদের একটা আলাদা ভালোবাসা জন্মায়। একটা বল কার কাছে থাকবে এটাই একটা রহস্য। এটা যে নিজের পায়ে ধরে রাখতে পারবে মাঠও তার কথা শুনবে। তাই বলকে কিভাবে পায়ে নিয়ে আসতে হয় সেটাই সকাল বিকাল ঘরে প্র্যাকটিস করতাম ছোট বেলায়। সেটা ওই মায়ের কাপড়ের তৈরি বল।
শুরু হয়েছে ইউরো কাপ। কোপা আমেরিকাও। কিন্তু ভারতী মুর্মুর পক্ষে সেই টুর্নামেন্টগুলির কোনও খেলাই দেখা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, তাঁর বাড়িতে টিভি নেই। মেসি কলিংবা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, ভারতী চেনেন, কিছুটা জানেন তাঁদের সম্পর্কে। তবে তাঁর প্রিয় ফুটবলার ওডিশার সাধু মান্ডি। 
বাঁকাদহ প্রাথমিক বিদ্যালয় পরে হাইস্কুলে তিনি পড়াশোনা করেছেন। তাঁর বাবা মেয়ের এই ইচ্ছা, আত্মবিশ্বাস দেখে কষ্ট করেও একটা ফুটবল কিনে দিয়েছিলেন। ভারতীর কথায়, সেদিন যেন হাতে আমি পুরো মাঠ পেয়ে গিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে সেই নতুন ফুটবলের গন্ধ শুঁকেছি। সেটা নিয়ে নতুন ভাবে প্র্যাকটিস করি। তারপর থেকে একটা দিনের জন্যও থেমে ছিল না তার প্র্যাকটিস। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর বাঁকাদহ রামকৃষ্ণ সারদা সেবাশ্রম আশ্রম থেকে মহিলাদের ফুটবলের কোচিং শুরু হয়। সেখানে ভারতী ভর্তি হন। তিনি জানান বাইরে থেকে গৌর আড়ি নামে একজন কোচ আসেন শেখাতে। সপ্তাহে তিনদিন তিনি আসেন। তাঁর কাছে আমরা সবাই মেয়ের মতো। খুবই যত্ন করে শেখান। আবার ভুল হলে ধমকানি খেতে হয়। কিন্তু আমাদের খুবই ভালো লাগে তাঁর শেখানো। উঁচু থেকে নিচে নেমে আসা বলকে চোখের পলকে কিভাবে নিজের পায়ের পাতায় নিয়ে আসতে হয় তার অসাধারণ নিয়ম তিনি আমাদের শিখিয়েছেন। যা খেলার সময় প্রয়োগ করেছিলাম। এই আশ্রমের কোচিং সেন্টারে প্রশিক্ষণের পর ছোলা, বাদাম, গুড় এসব দেওয়া হয়। আমরা তো আর বাড়িতে এসব পাই না। বাড়িতে ভাতই একমাত্র খাবার। প্রতিদিন সকাল বিকাল দু’বেলাই প্র্যাকটিস করতেন তাঁরা। ভারতীর দেখে দশম শ্রেণির ছাত্রী বোন সুন্দরীও মাঠে আসে। তিনিও নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন। ভারতী জানায়,‘‘গত বছর রাজ্যের বিভিন্ন জেলার মধ্যে অনূর্ধ্ব ১৯ মহিলা ফুটবল প্রতিযোগিতা হয়। কোচবিহারে খেলা হয়েছিল সেখানে বাঁকুড়া বিজয়ী হয়।’’ সেই খেলা থেকেই অনেকের সঙ্গে তাঁকেও বাংলার দল ট্রায়ালে ডাকে। সেখানে সে উত্তীর্ণ হয় নিজের যোগ্যতাতেই। পরে বাংলার হয়ে খেলার সুযোগ ও ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পায়। জানুয়ারি মাসে সেই খেলা শেষ হয়েছে। 
এবছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করে ভারতী পাঁচমুড়া কলেজে ফিজিক্যাল এডুকেশন নিয়ে ভর্তি হচ্ছে। এখন খেলা না থাকলেও প্রতিদিন সকাল বিকাল দু’বেলাই সে প্র্যাকটিস চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর মাঝে তাকে ঘরের যাবতীয় কাজ করতে হয়। তিনি হেসে জানান, ভোর পাঁচটায় তিনি ঘুম থেকে ওঠেন। সকালে উঠেই বাবা, মা জনমজুরের কাজ করতে চলে যান। তাঁকেই রান্না করতে হয়। কারণ বোনের পড়াশোনা আছে আর ছোটভাই সুশান্ত সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। এক দিদি ছিল তাঁর বিয়ে হয়ে গেছে। তাই সব দায়িত্ব এখন তাঁর হাতে। সকালে রান্না করে মাঠে যান। সাড়ে দশটায় ফিরে আসেন। বিকালে ফের মাঠে। আগামী দিনে আরও বড় জায়গায় যাওয়ার প্রস্তুতিতে কোনও খামতি নেই বাঁকাদহের অষ্টাদশী ভারতী মুর্মুর। 
বল যার পায়ে মাঠ তার কথা শুনতে বাধ্য, এটাই ভারতীর মূল মন্ত্র। ঝালিয়ে যাচ্ছেন তিনি সেই কথা। তাই কোনও বিরাম নেই ভারতীর পায়ে।



 

Comments :0

Login to leave a comment