অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়
বিশ্বের যে সমস্ত দেশ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার মধ্যে ভারত অন্যতম। আর ভারতের বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন উপকূল এলাকাতেই সব থেকে বেশি তাণ্ডব চালায় ঘূর্ণিঝড়। বিশেষ করে পূর্ব উপকূলে। বঙ্গোপসাগরের পূর্ব উপকূলের চার রাজ্য অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাড়ু, ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গ বারবার সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উষ্ণ বঙ্গোপসাগরের অগভীরতা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ঝড়ের পরিস্থিতি বারবার জটিল করে তোলে।
মে মাসেই ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ বাড়ে। ২০০৯ সালে ২১ মে বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয়েছিলো ঘূর্ণিঝড় আয়লা। সেটি উপকূলে আছড়ে পড়ে ২৫ মে। আবার ২০২০ সালে করোনাকালের মাঝে ২০ মে উপকূলে আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড় আমফান। উদাহরণ আরও রয়েছে। এবারে ফের ‘রেমাল’-এর উদয় হচ্ছে। আর এবার আলোচনা শুরু হয়েছে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ নিয়ে। সেক্ষেত্রে অনেকেরই প্রশ্ন, বারেবারে এই মে মাসেই কেন তাণ্ডব চালায় ঘূর্ণিঝড় ? এর ভৌগোলিক বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যাখ্যা রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় সুগভীর নিম্নচাপ থেকে। জলীয় বাষ্প শুষে নিম্নচাপ ধীরে ধীরে শক্তি বাড়িয়ে সুগভীর নিম্নচাপ হয়। এরপরে শক্তি বৃদ্ধি হলে তখন সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের রূপ নেয়। তাই নিম্নচাপ আদপে ঘূর্ণিঝড়ের বীজ। তবে সব নিম্নচাপে ঘূর্ণিঝড় হয় না। আর নিম্নচাপ বা ‘লো প্রেসার’ হওয়ার সম্ভাবনাকে বলা হয় সাইক্লোজেনেসিস। আর এই সাইক্লোজেনেসিস কতগুলি অনুকূল পরিস্থিতিতে তৈরি হয়, যার অন্যতম সমুদ্র জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি (ওয়ার্ম সি সারফেস টেম্পারেচার)। মার্চ, এপ্রিল, মে মাসে সমুদ্রের জলের উপরের যে তাপমাত্রা তা অনেকটা বেশি থাকে।
সমুদ্র পৃষ্ঠের জলের তাপই শুধু বাড়ে না তা জলের প্রায় ৫০ মিটার গভীর পর্যন্ত থাকে। আর সেই কারণেই মার্চ-এপ্রিল-মে বা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কখনও কখনও জুন মাসেও ঘূর্ণিঝড় তৈরি হতে দেখা যায়। এরপর বর্ষা চলে এলে পরিস্থিতি আর তেমনটা থাকে না। এই জন্যই বঙ্গোপসাগরীয় ঘূর্ণিঝড়ের দেখা মেলে গ্রীষ্মকালে, বিশেষত মে-জুন মাসে। এবারেও মে মাসের শেষে উপকূলে আছড়ে পড়ার কথা ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’-এর। রেমালের গতি নিয়ে সোশাল মিডিয়া নানা রকমের কথা ছড়ালে আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর তেমন করে ভয়াবহতার কথা জানায়নি।
২২ মে বুধবার দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে যে নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে তা ধীরে ধীরে শক্তি বাড়িয়ে শেষে ঘূর্ণিঝড়ের রূপ পায়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ওয়ার্ল্ড মেটেরলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের তথ্য মতে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সামুদ্রিক ঝড়ের ক্ষেত্রে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬৩ কিলোমিটারের বেশি হলে একে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় বলা হয়। বাতাসের গতি এর থেকে কম হলে সেটা নিম্নচাপ। সেই জন্য ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ার পর সেটা শক্তি হারিয়ে নিম্নচাপে পরিণত হয়।
প্রাক বর্ষার মরশুম এলেই ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা বাড়ে। ঘূর্ণিঝড়ে হানার আশঙ্কা বাড়ে ভারতীয় উপকূলে। বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন দেশের পূর্ব উপকূল ঝড়ের সম্ভাবনা থাকে বেশি। অন্ধ্র প্রদেশ, ওডিশা, তামিলনাড়ু আর পশ্চিমবঙ্গ, মূলত এই চারটি রাজ্যেই সব থেকে বেশি ঘূর্ণিঝড় প্রবণ। পঞ্চম স্থানে রয়েছে পদুচেরি।
ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগের (আইএমডি) রেকর্ড বলছে, বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম উপকূলের থেকে পূর্ব উপকূল বেশি ঘূর্ণিঝড়প্রবণ। সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় (সাইক্লোন) সবচেয়ে বেশি হয় বঙ্গোপসাগরে। আরব সাগরে ঝড়ের সংখ্যা তুলনামূলক কম। তবে দেখা গেছে ভারতীয় এলাকায় থাকা আরব সাগরের তৈরি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে অন্য দেশে। বঙ্গোপসাগর জলোচ্ছ্বাস অন্য সাগরের তুলনায় বেশি হয়। বঙ্গোপসাগরের অবতল আকৃতি এই জলোচ্ছ্বাসের অন্যতম কারণ। সেই সঙ্গে সমুদ্রের সারফেসের তাপমাত্রাও একটি কারণ। বঙ্গোপসাগর আর পাঁচটা মহাসাগরের তুলনায় বেশি উষ্ণ।
বাংলার দুই মেদিনীপুর, দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া ও কলকাতা সব থেকে বেশি প্রভাবিত হয় ঘূর্ণিঝড়ে। অন্ধ্র প্রদেশের পূর্ব গোদাবরী, নেলোর ও কৃষ্ণা, ওডিশার বালাশোর, কটক, ভদ্রা, গঞ্জাম, কেন্দ্রাপাড়া, জগৎসিংপুরে ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি হয় প্রচুর। তামিলনাড়ুর চেন্নাই, থিরুভল্লুর, কাঞ্চিপুরম ও তিরুভন্নামালাই এবং পুদুচেরির ইয়ানমে ঝড়ের তাণ্ডব চলে বেশি। সেই সঙ্গে এদের নাম আগে থেকে ঠিক করা থাকে। উত্তর ভারত মহাসাগর তথা বঙ্গোপসাগর কিংবা আরব সাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের নাম ঠিক করে এই অঞ্চলের ১৩টি দেশ।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের ওয়ার্ল্ড মেটেরলজিক্যাল অর্গানাইজেশন প্যানেল সদস্য দেশেরা ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে এই নামগুলো গ্রহণ করেছে। ওই দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ও ইয়েমেন। এই দেশগুলোর নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী তৈরি তালিকা থেকে পর্যায়ক্রমে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ হয়। ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণের প্রচলন হয় ২০০০ সালে। ওয়ার্ল্ড মেটেরলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, একটি ঘূর্ণিঝড় এক সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এই সময়ের মধ্যেই একই অঞ্চলে আরও ঘূর্ণিঝড় হতেই পারে। তাই ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ভ্রান্তি এড়াতে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেমন শেষ পাঁচ ঘূর্ণিঝড়ের নাম, বিপর্যয়, তেজ, হামুন, মিধিলি, মিগজাউম। এবারে আসছে রেমাল।
Comments :0