গেরুয়া বাহিনীর নৈরাজ্য এবং মোদী সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের মাত্রা চড়চড় করে বাড়লেও আমেরিকা তাদের পাশে আছে এই আনন্দেই তারা তৃপ্ত এবং রীতিমতো উৎফুল্ল। এই তৃপ্তির আভাস মিলেছে একদিকে শ্রীলঙ্কায় বন্দর নির্মাণের জন্য মোদী বন্ধু আদানিদের মার্কিন সরকারি সংস্থার আর্থিক সাহায্য ঘোষণায়, অন্যদিকে ভারত-মার্কিন পঞ্চম টু প্লাস টু (দু’দেশের বিদেশ মন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী) বৈঠকে আমেরিকার অধস্তন সহযোগী হবার রাস্তা প্রশস্ত হবার পর। আমেরিকার সামরিক ও ট্র্যাটেজিক চক্রব্যুহে ঢোকার বাসনায় মোদী সরকার এতই মশগুল যে ভারতের প্রতিষ্ঠিত বিদেশ নীতিকে পরিত্যাগ করতেও দ্বিধা করছে না। আসলে স্বঘোষিত বিশ্ব গুরু ভারতকে বিশ্বের মহাশক্তিধর দেশে পরিণত করতে যে খোয়াব দেখিয়ে চলেছেন বিগত কয়েক বছর ধরে সেটা যে অবাস্তব তা আড়াল করতেই আমেরিকার লেজুড়ে হয়ে নিজেকে কেউকেটা জাহির করতে চাইছেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী বলয়ে প্রবেশাধিকারের অন্যতম প্রধান শর্ত দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি নয়, বরং সমর শক্তিতে উন্নতি। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বৈদেশিক আক্রমণের অলীক ভীতি তৈরি করেছে। ক্রমাগত যুদ্ধ জিগির তুলে গেছে। দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে এমন এক উদ্বেগজনক আবহাওয়া তৈরি করতে পারলেই সামরিক খাতে বাজেট বরাদ্দ বা ব্যয় অনেকটা বাড়িয়ে দেওয়া যায় অনায়াসে। বস্তুত মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ধাপে ধাপে বেড়েছে প্রতিরক্ষা বাজেট। অতীতে কোনও সময়, এমনকি চীন-ভারত অথবা পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ও এত উচ্চ হারে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানো হয়নি। অতীতে ভারত ছিল জোট নিরপেক্ষ, শান্তিকামী দেশ। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তি আন্দোলনের নেতা ছিল ভারত। তাই প্রতিরক্ষায় বিশেষ ব্যয়ের প্রয়োজন হয়নি। বদলে জোর দেওয়া হয় দেশের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এবং গণতান্ত্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উন্নয়নে।
মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেই উলটো পথে হাঁটা শুরু করে। গণতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণের বদলে মোদীরা চায় কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা। তাই তাদের স্লোগান এক নেতা, এক দেশ, এক দল, এক সরকার, এক ভাষা, এক ধর্ম ইত্যাদি। শক্তিশালী রাজ্যের বদলে চায় কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল রাজ্য। জনকল্যাণ রাষ্ট্রকে কর্পোরেট কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। অর্থনীতি ও বাণিজ্যে রাষ্ট্রের ভূমিকা নস্যাৎ করে পুরোপরি বৃহৎ পুঁজি তথা কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে চায়। দেশের যাবতীয় সম্পদও তুলে দিতে চায় পছন্দের কর্পোরেটের হাতে। দল চালাতে চায় জনগণের বদলে কর্পোরেটের অর্থ। এমন একটি আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী দলের সরকার যে আমেরিকার লেজুড় হতে হত্যে দিয়ে বসে থাকবে তাতে আশ্চর্য কি।
অবশ্য আমেরিকা আপন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ ছাড়া অন্য কোনও দেশকে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করে না। বিশ্ব শক্তি হিসাবে বিকাশমান চীনকে থামিয়ে নিজের বিশ্ব শক্তির তকমা বজায় রাখতে অন্য অনেক দেশের মতো ভারতকেও তাদের সঙ্গে রাখা প্রয়োজন। তাই ভারতকে মার্কিন বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে উসকে দিয়ে ভারতে তাদের পা রাখার শক্ত ভূমি তৈরি করতে চায়। তেমনি চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন অভিযানে ভারতকে সামনে রাখতে চায়। কোয়াদ আসেরিক সেই স্ট্র্যাটেজিক চাতুরিরই ফসল। আমেরিকার সঙ্গে থাকতে সমরশক্তি বাড়াতে হবে। মোদী সরকারকে সেই কাজটি মন দিয়ে করতে হচ্ছে। মেক ইন ইন্ডিয়া ও অন্যান্য সরকারি প্রকল্পে এখন পর্যন্ত যেসব বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে তার প্রধান অংশই সামরিক প্রকল্পে।
Comments :0