Kumortuli

চাহিদা বাড়লেও মূল্যবৃদ্ধির ফাঁসে আটকে কুমোরটুলি

কলকাতা ফিচার পাতা

পুজোর কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে। হাতে মাত্র আর কয়েকটা দিন।  চারিদিকেই এখন শুধুই পুজোর গন্ধ। আর এর মধ্যেই কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে শুরু হয়েছে প্রবল বৃষ্টিপাত। এই অবস্থায় কেমন আছেন কুমোরটুলির শিল্পীরা? কেমন আছে শিল্পীর হাতের তৈরি প্রতিমা! সাধারণত শারদ উৎসবের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন কুমারটুলির মৃৎশিল্পীরা। বিগত বছরগুলিতে করোনার কারণে শেষ বেচা-কেনা শিকেয় উঠলেও এই বছর বাজার তুলনামূলকভাবে চাঙ্গা হয়েছে। কিন্তু তাতেও সিঁদুরে মেঘ দেখছেন মৃৎশিল্পীরা। একদিকে একটানা বৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটছে ঠাকুর তৈরির কাজে; অন্যদিকে আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে আশানুরূপ বায়না দিতে আসতে অসুবিধায় পড়ছেন সাধারণ মানুষ। অনবরত বৃষ্টির জেরে মাটির ঠাকুর শুকোতে লাগছে দীর্ঘ সময়। ফলে অর্ডার থাকা সত্ত্বেও কাজ এগোচ্ছে না। এদিকে হাতেও সময় কম। তার মধ্যে রাস্তায় জমে থাকার ফলে ঠাকুর তৈরির প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিও কিনতে যেতেও সমস্যা হচ্ছে। 


প্রতীমা শিল্পী সুজিত পাল জানান, যদিও আগের তিন বছরের তুলনায় অল্প হলেও কর্মব্যস্ততা বেড়েছে শিল্পীদের। যেই পূজা কমিটিগুলো ৫-৬ ফুটের প্রতিমা বায়না করেছিল এবার সেটা কেউ বাড়িয়ে করেছে ১০ ফুট তো কেউ ১৬ ফুট। বায়না এসেছে প্রায় ৯৫%। বাকিটুকুও শীঘ্রই হয়ে যাওয়ার আশা করছেন শিল্পীরা। কিছুটা হলেও পরিস্থিতি ভাল বিদেশি বায়নার, যদিও তাতেও বেড়েছে করের বোঝা।  তবে শুধু ভালো বায়না এলেই তো সব সমস্যা আর মিটে যায় না। শেষ তিন বছরে ব্যাপকভাবে দাম বেড়েছে কাঁচা মালের। মাটি, বাঁশ, খড়, পোশাক, শ্রমিক সব কিছুর দাম হয়েছে দ্বিগুণ। আগে নৌকা বা লঞ্চে করে কুমোরটুলি ঘাটে মাটি আসত। কিন্তু এখন জল পুলিশের জ্বালায় তাও বন্ধ। জল পথে মাটি আনতে গেলেই পুলিশকে দিতে হচ্ছে মোটা টাকা ঘুষ। তাই কিছুটা বাধ্য হয়েই ডায়মন্ডহারবার থেকে লরি করে মাটি আনতে হচ্ছে। কিন্তু তাতেও কি কোনও লাভ হচ্ছে? না। তাতেও কোনও লাভ নেই। কারণ তেলের দাম বাড়ার কারণে বেড়েছে গাড়ি ভাড়া। লড়ি পিছু মাটির দাম বেড়েছে দু‘হাজার টাকা, যা আগে ছিল ১১০০টাকা। 
মাটির মতো বাঁশের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। জল পথে যেই বাঁশ ১২৮ টাকায় কেনা হতো তা এখন কিনতে হচ্ছে ১৫৩ টাকা দিয়ে। খড়ের দামও ৫ বান্ডিল ২০০ টাকা থেকে এক লাফে বেড়ে হয়েছে ৩০০ টাকা। 


এতো নয় গেল কাঁচা মালের কথা। যেই জিনিসটা না হলে প্রতিমার কাজ শেষ হয় না তা হলো প্রতিমার সাজ। তারের সাজ হোক বা শোলার, জিএসটির গেরোয় দাম বেড়েছে সেসবের। আর এই সবের ফলে ১০ থেকে ২০ শতাংশ দাম বেড়েছে ঠাকুরের।  যদিও এই দাম বৃদ্ধি ২০১৯ সালের দামের সঙ্গে খাপ খায় কিন্তু চলতি মুদ্রাস্ফীতির অণুপাতে অনেকটাই কম।
তবে কুমোরটুলি তে শ্রমিক মালিকের সম্পর্কটা সম্পূর্ণ আলাদা। উভয় উভয়ের সমস্যা বোঝে। তাই শেষ তিন বছর যখন ভালো ব্যবসা হয়নি তখন শ্রমিকরা কখনো দাবি করেনি মজুরি বাড়ানোর। এবার যেহেতু বাজার মন্দের ভালো তাই এবার শ্রমিকদের মজুরি অনেকটাই বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কেএমডিএ সূত্রে জানা যাচ্ছে, কেন্দ্রের জেএনইউআরএম প্রকল্পে, কেএমডিএ’র তত্ত্বাবধানে নতুন কুমোরটুলি তৈরির পরিকল্পনা হয়েছিল। ৩৫শতাংশ টাকা কেন্দ্র ও ৩৫ শতাংশ রাজ্য দিচ্ছিল ৩০শতাংশ ব্যাঙ্ক ঋণ। বাস্তিবাসীদের কথা মাথায় রাখা হয়েছিল। বলা হয়েছিল একজনকেও উচ্ছেদ করা হবে না। কেন্দ্রের প্রথম ইউপিএ সরকার ৩৫% টাকা দেওয়ার বদলে বস্তিবাসীদের উন্নয়নের কথা শুনে আরও অতিরিক্ত ১৫% টাকা দেবে বলে জানিয়েছিল। প্রায় ৫৫০জনের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিল গঙ্গাধার লাগোয়া জনস্বাস্থ্য কারিগরি দপ্তরের গুদামে। আধুনিক কুমোরটুলিতে তৈরি হতো ১৫ ফুট উঁচু সিমেন্টের দেওয়ালের স্টুডিও। উপরে বসবাসের জন্য ঘর। স্টুডিওর সামনে চওড়া রাস্তা। যেখানে এখনকার মতো ট্রাম লাইন আটকে লরি রাখতে হতো না। একদম স্টুডিওর সামনেই গাড়ি ঢুকে যেত। আধুনিক পয়ঃপ্রণালী, নিকাশি ব্যবস্থা। পার্ক, শৌচালয়। বিরাট কর্মশালা কেন্দ্র। আধুনিক অডিটোরিয়াম। বিদেশি বা ভিন রাজ্য থেকে আগত মানুষজন বিখ্যাত শিল্পীদের তৈরি করা মূর্তি থেকে মৃৎশিল্পী সংক্রান্ত বিভিন্ন ব্যাপারে সহজে জানতে পারবেন সেখান থেকে। এমনটাই পরিকল্পনা ছিল বামফ্রন্টের। 


কুমোরটুলি শিল্পীরা জানিয়েছেন, ২০০৯-র কাছাকাছি সময় অস্থায়ী পুনর্বাসন দেওয়াও শুরু হয়েছিল। প্রথম অবস্থায় সাময়িকভাবে জমি নিয়ে জটিলতা দেখা দিলে হস্তক্ষেপ করেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তবে সেই সময় উচ্ছেদ হওয়ার মিথ্যা আশঙ্কা ছড়িয়ে ৮-১০জনকে দিয়ে এই প্রকল্প আটকে দিতে তৎপর হয় তৃণমূল। তাঁরা ‘কুমোরটুলি বাঁচাও কমিটি’ গড়ে অনশন শুরু করেন। ২০১০ কলকাতা কর্পোরেশনের ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। আর তার পরের বছরেই রাজ্যের ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। ফলে এই প্রকল্পের কাজ ঠান্ডা ঘরে চলে যায়। এরপরও একাধিক শিল্পী বর্তমান সরকারের সঙ্গে দেখা করে আধুনিক কুমোরটুলি প্রকল্প রূপায়ণের কথা জানালেও সেকথায় কোনও কর্ণপাত করেনি এই সরকার। এখন কুমারটুলিতে প্রায় সারাবছরের সতর্কবার্তা—‘ডেঙ্গু সম্পর্কে সাবধান’। জমা জল, নোংরা থেকে ডেঙ্গু ছড়ালেও, পটুয়াপাড়ার কিছুই করার নেই। বিকল্প নেই। কুমোরটুলির আধুনিকীকরণ আজ শুধুই ‘স্বপ্ন’। সেই জল-কাদায় বাঁশের কাঠামো আর টিনের চালই রয়ে গেছে। 


বাংলা দুর্গাপুজো ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্বীকৃতি পেয়েছে। সারা বছর বহু বিদেশি পর্যটক কুমোরটুলিতে আসা-যাওয়া করেন। এসে ছবি তোলে শিল্পীর কথা শোনে। কিন্তু বিদেশিরা তাদের কথা শুনলেও বর্তমানে রাজ্য সরকার তাদের কথা শোনে না। তাদের দিকে ফিরেও দেখে না, আক্ষেপ সুজিত পালের। পুজো এলেই প্রত্যেকটা মানুষের মনে একটা আনন্দ জাগে নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী বছরের ওই চারটে দিন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তারা আনন্দে কাটাতে চায়। কিন্তু শেষ ১২ বছর কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা বা শ্রমিকরা সেইভাবে আনন্দে মেতে উঠতে পারছেন না। রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার যতদিন ক্ষমতায় ছিল ততদিন পর্যন্ত মাঝেমধ্যেই কুমোরটুলির শিল্পীদের দাবি-দাওয়া চাওয়া পাওয়া নিয়ে ভাবতো এমনটাই বলছেন অনেক মৃৎশিল্পী। বামফ্রন্ট সরকারের পক্ষ থেকে পূজার আগে কুমোরটুলির শিল্পীদের বিশেষ রেশন প্যাকেজ দেওয়া হতো। বামফ্রন্ট সরকার কখনো এটা ঢাক পিটিয়ে প্রচার করেনি। তাই সাধারণ মানুষের অজানা থেকে গিয়েছে তার সরকারের একাধিক প্রকল্প যা তৃণমূল স্তরের মানুষদের উপকারে এসেছে, জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মৃৎশিল্পী। বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন পূজার আগে খাদ্য দপ্তরের পক্ষ থেকে চাল ডাল গম ৪০ লিটার কেরোসিন তেল কম দামে দেওয়া হতো। সেই তেল দিয়ে প্রতিমা তৈরির বিভিন্ন কাজ যেমন মাটি ছাঁচ শুকনোর জন্য স্টোভ জ্বালানো ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে আসতো। কিন্তু তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার হলে পর এই বিশেষ রেশন প্যাকেজ বন্ধ হয়ে যায়। ৪০ লিটার কেরোসিন তেল দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু শেষ কয়েকটা বছর কেরোসিন তেলের দাম বাড়ার কারণে এই তেল আর শিল্পীরা কেনেন না। প্রতিমা শিল্পীরা গ্যাসেই প্রতিমা তৈরির যাবতীয় কাজ সেরে ফেলেন। হঠাৎ করে এই রেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহু শ্রমিক সমস্যার মুখে পড়েছেন। তবে এত সমস্যা থাকলেও হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটা দিনেই মৃৎশিল্পীরা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তারপরেই মণ্ডপে মণ্ডপে পৌঁছে যাবে উমা।  তাদের এই কাজ দেখার জন্য রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ নামবেন ছবি তুলবেন।  মেতে উঠবে গোটা বঙ্গবাসী। তারই প্রতিচ্ছবি দেখা কুমোরটুলিতে।
 

Comments :0

Login to leave a comment